Image description
অভিযান ও সংঘর্ষে ১১ মাসে মারা গেছেন ৩১ জন

ফের বেড়েছে হেফাজতে মৃত্যু। আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর হেফাজতে থাকা ব্যক্তিদের এমন অকাল-করুণ মৃত্যুতে নানান প্রশ্নের সৃষ্টি করেছে। দেশজুড়ে অভিযানে কঠোরতা, রাজনৈতিক অস্থিরতা ও যৌথ বাহিনীর অভিযানে গত ১১ মাসে অন্তত ৩১ জনের মৃত্যু হয়েছে। মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে, হেফাজতে মৃত্যু, কথিত বন্দুকযুদ্ধ এবং গুলিবিদ্ধ হয়ে মৃত্যু কয়েক মাসে অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে। তাদের অভিযোগ, আটকের পর নির্যাতন, সময়মতো চিকিৎসা না দেওয়া, স্বচ্ছ তদন্তের অভাব এবং গ্রেপ্তার প্রক্রিয়ায় অনিয়মের কারণে এসব ঘটনা নিয়ন্ত্রণে আসছে না।

জানা গেছে, ১১ জুলাই রাজধানীর ভাটারায় পুলিশ হেফাজতে বিষপানে ফিরোজা আশরাফী নামে এক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষিকার মৃত্যু হয়; যা নতুন করে হেফাজত পরিস্থিতি প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। অতিসম্প্রতি ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) ও সিরাজগঞ্জে ডিবি পুলিশের হেফাজতে মুক্তার হোসেন ও শাহাদত হোসেন নামে দুই নাগরিকের মৃত্যু আগুনে ঘি ঢালার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে।

ভুক্তভোগী পরিবার এবং মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটির (এইচআরএসএস) তথ্য বলছে, জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন জায়গায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে আট, নির্যাতনে চার, হেফাজতে ১২ ও গুলিতে সাতজন নিহত আর পুলিশের ভয়ে পালাতে গিয়ে প্রাণ হারিয়েছেন আরও সাতজন।

মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) হিসাবে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ২২ নভেম্বর পর্যন্ত বিভিন্ন থানা, র‌্যাব, পিবিআই ও ডিবির হেফাজতে কমপক্ষে ১৫ নাগরিকের মৃত্যু ঘটেছে। এটা কেবল পরিসংখ্যান নয়, দায়িত্বহীনতা, জবাবদিহির অভাব ও প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতার সংকট আরও স্পষ্ট করে তুলেছে।

আসকের দাবি, রাষ্ট্রীয় হেফাজতে থাকা ব্যক্তিদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দায়িত্ব ও সাংবিধানিক কর্তব্য। এ ধরনের মৃত্যু আমাদের জাতীয় মানবাধিকার অঙ্গীকার, সংবিধান এবং আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের সঙ্গে সামঞ্জস্য রক্ষার প্রয়াসে নতুন করে আলোচনা ও মূল্যায়নের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে।

২১ নভেম্বর সিরাজগঞ্জ জেলা গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের হেফাজতে শাহাদত হোসেন (৪৫) নামে হত্যা মামলার এক সন্দেহভাজন আসামির মৃত্যুর অভিযোগ উঠেছে। ওই দিন বেলা সাড়ে ৩টার দিকে পুলিশ তাঁকে সিরাজগঞ্জ ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে গেলে দায়িত্বরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। চিকিৎসকরা তাঁর শরীরে আঘাতের চিহ্নের কথা বললেও পুলিশের দাবি শ্বাসকষ্টে মৃত্যু হয়েছে। শাহাদত সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলার কালিয়া হরিপুর ইউনিয়নের মৃত খলিল হোসেনের ছেলে। এ বিষয়ে সিরাজগঞ্জের পুলিশ সুপার ফারুক হোসেন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘এ ঘটনায় তদন্ত কমিটিকে ১৪ দিন সময় দেওয়া হয়েছে। প্রতিবেদন অনুযায়ী কেউ জড়িত থাকলে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’ জানা গেছে, জাতিসংঘের নির্যাতনবিরোধী সনদে স্বাক্ষরকারী দেশ হিসেবে বাংলাদেশ এ আইনটি প্রণয়ন করে। নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন, ২০১৩ অনুযায়ী কেউ নির্যাতনের শিকার হলে আদালতে অভিযোগ করতে পারেন। শারীরিক এবং মানসিক নির্যাতন প্রমাণিত হলে শাস্তি হিসেবে ন্যূনতম পাঁচ বছরের কারাদণ্ড অথবা ৫০ হাজার টাকা জরিমানার বিধান রয়েছে। এ ছাড়া নির্যাতনের ফলে মৃত্যু হলে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড অথবা অর্থদণ্ড হতে পারে।

মানবাধিকারকর্মী ও গুম কমিশনের সদস্য নূর খান লিটন বলেন, ‘স্বৈরাচারের শাসনামলে হেফাজতে মৃত্যু ভয়াবহ রূপ নিয়েছিল। তবে আমাদের প্রত্যাশা ছিল ৫ আগস্টের পর এটা শূন্যের কোঠায় নেমে আসবে। রকমফের এসব ঘটনা এখনো ঘটেই চলেছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘রাষ্ট্রের উচিত হবে প্রতিটি ঘটনায় প্রভাবমুক্ত বিচার বিভাগীয় তদন্ত করে দোষীদের আইনের আওতায় আনা। এগুলো চলতে থাকলে গণতন্ত্র এবং আইনের শাসন বলতে কোনো কিছু থাকবে না।’

যত ঘটনা : গত ১৩ জানুয়ারি নোয়াখালীর সোনাইমুড়ীতে যৌথ বাহিনীর অভিযানে আটক হওয়ার পর নির্যাতন ও চিকিৎসা না পাওয়ায় ছাত্রদলের সাবেক সহসাধারণ সম্পাদক আবদুর রহমান (৩৪) হাসপাতালে মারা যান। ৩১ জানুয়ারি গভীর রাতে বাড়ি থেকে যৌথ বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হওয়ার পর অমানবিক নির্যাতনে কুমিল্লার পাঁচথুবী ইউনিয়ন যুবদলের আহ্বায়ক তৌহিদুল ইসলাম (৪০) মারা যান। ২০ ফেব্রুয়ারি গভীর রাতে রাজধানীর মোহাম্মদপুরের চাঁদ উদ্যান এলাকায় যৌথ বাহিনীর অভিযানে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হন দুই যুবক মিরাজ হোসেন ও মো. জুম্মন। বরিশালের উজিরপুর-আগৈলঝাড়া সীমান্তে বাহেরঘাট এলাকায় ২১ ফেব্রুয়ারি মাদকবিরোধী অভিযানে র‌্যাবের গুলিতে সিয়াম মোল্লা (১৮) নিহত হয় এবং একই ঘটনায় রাকিব মোল্লা (১৭) গুরুতর আহত হয়। ৬ জানুয়ারি কিশোরগঞ্জের কটিয়াদীতে পুলিশের পিটুনিতে ইয়াসিন মিয়া নামে একজন সিএনজিচালিত অটোরিকশাচালক মারা যান বলে তাঁর পরিবার অভিযোগ করেছে। ১৬ সেপ্টেম্বর সিলেটের জৈন্তাপুরে তানভীর চৌধুরী নামে এক ব্যক্তি র‌্যাব-৯-এর হেফাজতে থাকা অবস্থায় মারা যান। র‌্যাব বলছে, হাজতখানায় কম্বল পেঁচিয়ে তানভীর আত্মহতা করেন। তানভীর স্ত্রী হত্যা মামলার আসামি ছিলেন। এর আগের দিন মৌলভীবাজারে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) হেফাজতে মো. মোকাদ্দেস মিয়া নামে এক আসামির মৃত্যু হয়েছে।

২২ অক্টোবর সিলেটের জৈন্তাপুরে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) গুলিতে আলমাস উদ্দিন (২৩) নামে এক যুবক নিহত হন বলে পরিবার জানিয়েছে।

পিবিআই পুলিশ সুপার (অতিরিক্ত ডিআইজি) জাফর হোসেন গতকাল জানান, মোকাদ্দেস হেফাজতে থাকা অবস্থায় লুঙ্গি ছিঁড়ে গ্রিলের সঙ্গে ঝুলে আত্মহত্যা করেন। মোকাদ্দেস কমলগঞ্জ উপজেলার পতনঊষার ইউনিয়নের কোনাগাঁও গ্রামের মৃত লাল মিয়ার ছেলে। তিনি লিটন মিয়া (২৭) হত্যা মামলার আসামি ছিলেন।

অনুসন্ধান বলছে, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই নিহতদের পরিবার বলছে আটকের পর কী ঘটেছিল, কেন তারা গুলিবিদ্ধ বা আহত হলো কিংবা মারা গেল-এসব প্রশ্নের সঠিক উত্তর পায়নি। অনেকেই বলছে, পুলিশ বা যৌথ বাহিনীর ব্যাখ্যা ঘটনাগুলোর সঙ্গে মেলে না।

যদিও ঢাকা মহানগর পুলিশের উপকমিশনার (মিডিয়া) তালেবুর রহমান বলেন, ‘ডিএমপির প্রতিটি ঘটনায় তদন্ত হয়। কারও দোষ পাওয়া গেলে বিভাগীয় শাস্তির মুখোমুখি হতে হয়। ভাটারা থানার ঘটনায়ও দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগে দোষীদের বিভাগীয় শাস্তি দেওয়া হয়েছে।’