Image description
কেরানীগঞ্জের পানগাঁও নৌ-কনটেইনার পোর্ট

আগামী ২২ বছর পরিচালনার জন্য ঢাকার কেরানীগঞ্জের পানগাঁও নৌ-কনটেইনার পোর্ট বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়েছে। সুইজারল্যান্ডের মেডলগ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি হলেও এর নেপথ্যে কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ নেতা সাবের হোসেন চৌধুরীর সংশ্লিষ্টতার তথ্য পাওয়া গেছে।

মেডলগ সাবের চৌধুরীর মেডিটেরিয়াল শিপিং কোম্পানির সহযোগী প্রতিষ্ঠান বলে বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে। প্রতিষ্ঠানটি মেডিটোরিয়াল শিপিং কোম্পানির লজিস্টিক ও ট্রান্সপোর্ট সাপোর্ট দিয়ে আসছে।

জানা যায়, গত ১৭ নভেম্বর ঢাকার ইন্টার কন্টিনেন্টাল হোটেলে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়াল অ্যাডমিরাল এসএম মনিরুজ্জামান এবং মেডলগ বাংলাদেশ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এটিএম আনিসুল মিল্লাত পানগাঁও নৌ-কনটেইনার পোর্ট ইজারার চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন।

অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন সুইজারল্যান্ডের রাষ্ট্রদূত রেতো রিংলি এবং নৌপরিবহন উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন।

এই চুক্তি নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বে রয়েছেন পানগাঁও নৌ-কনটেইনার পোর্ট কর্মকর্তা-কর্মচারী ও স্থানীয় শ্রমিকরা। তাদের মধ্যে হতাশা ও কাজ হারানোর ভয় আর আতঙ্ক কাজ করছে। তড়িঘড়ি করে করা চুক্তি নিয়ে সংশয় প্রকাশ করছেন বন্দর ব্যবহারকারী ও বিশেষজ্ঞদের অনেকেই। তাদের দাবি, পানগাঁও পোর্ট পরিচালনার দায়িত্ব বিদেশিদের হাতে দেওয়া চুক্তি জনসম্মুখে প্রকাশ করা হোক।

গণতান্ত্রিক অধিকার কমিটির সদস্য অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেছেন, অন্তবর্তী সরকার কদিন পর দায়িত্বে থাকবে না। তখন এই চুক্তি নিয়ে সমস্যা তৈরি হলে এ বিষয়ে জবাবদিহি করবে কে?

বাংলাদেশ ফ্রেশ ফ্রুটস ইমপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সিরাজুল ইসলাম জানান, সরকার তাড়াহুড়ো করে চুক্তি করায় দেশের স্বার্থ বিনষ্ট হলো কি না, তা ভেবে দেখা দরকার।

নাম না বলার শর্তে পানগাঁও নৌ-কনটেইনার পোর্টের কর্মকর্তারা জানান, বিদেশিদের হাতে কনটেইনার পোর্ট ইজারা দিলে রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব ঝুঁকিতে থাকে। অর্থনৈতিক ক্ষতিসাধন হয়, অভ্যন্তরীণ ও ফরেন পলিসি প্রণয়নে বৈদেশিক হস্তক্ষেপসহ দেশি মূল্যবোধ ও কৃষ্টি-কালচারে বৈদেশিক আগ্রাসন বৃদ্ধি পায়।

তারা বলেন, দেশি মালিকানা বা উদ্যোক্তা থেকে বিদেশি প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী বা শ্রমিকে রূপান্তর এবং দেশি প্রতিষ্ঠান দেউলিয়াকরণের পথ তৈরি হয়। এ কারণে আমরা আমাদের নৌ-কনটেইনার পোর্ট বিদেশিদের কাছে ইজারা দেওয়ার বিরোধিতা করেছি। কিন্তু একটি অদৃশ্য শক্তি তাড়াহুড়ো করে এক সপ্তাহের মধ্যে চুক্তি সম্পাদন করেছে, যা দেশ ও দেশের সার্বভৌমত্ব হুমকির কারণ হতে পারে।

পোর্টের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, সুইজারল্যান্ডভিত্তিক যে মেডলগ বাংলাদেশ প্রাইভেট লিমিটেডের সঙ্গে পানগাঁও টার্মিনাল ইজারা দেওয়ার ব্যাপারে চট্টগ্রাম নৌবন্দরের চুক্তি হয়েছে, সেটি আসলে আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক মন্ত্রী সাবের হোসেন চৌধুরীর ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান মেডিটেরয়ান শিপিং কোম্পানির (এমএসসি) অঙ্গপ্রতিষ্ঠান। তাই কঠোর গোপনীয়তা ও তাড়াহুড়ো করে এই চুক্তি করা হয়েছে।

তিনি বলেন, ৬ নভেম্বর পানগাঁও পোর্ট ইজারা দেওয়ার জন্য কারিগরি মূল্যায়ন কমিটি প্রতিবেদন জমা দেয়। ৯ নভেম্বর আর্থিক মূল্যায়ন কমিটি প্রতিবেদন জমা দেয়। ১০ নভেম্বর বন্দর থেকে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন পাঠানো হয়। ১৭ নভেম্বর চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এত দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, যা বন্দরের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা জানেন না।

এদিকে গত বুধবার পানগাঁও নৌ-কনটেইনার এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, টার্মিনাল ভবনের আশপাশে এবং ভেতরে শ্রমিকরা জড়ো হয়েছেন। তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তারা এসেছেন পানগাঁও টার্মিনাল ম্যানেজারের সঙ্গে কথা বলতে। তাদের চোখে-মুখে লক্ষ করা গেছে আতঙ্কের ছাপ।

এ বিষয়ে আইসিটি শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি জাকির হোসেন আমার দেশকে জানান, পানগাঁও নৌ-কনটেইনার পোর্ট বিদেশিদের হাতে ছেড়ে দেওয়ার জন্য চুক্তি করা হয়েছে। চুক্তি সম্পর্কে তাদের কিছুই জানানো হয়নি। তারা চুক্তিতে কী আছে, তা জনসম্মুখে প্রকাশ করার দাবি জানান।

তিনি বলেন, পানগাঁও পোর্টে ৩৯১ শ্রমিক মালামাল লোড-আনলোডের কাজ করেন। এদের সবাই চট্টগ্রাম নৌবন্দর কর্তৃপক্ষের নিবন্ধনকৃত শ্রমিক। পোর্ট বিদেশিদের হাতে ছেড়ে দিলে তারা তাদের নিজস্ব লোক দিয়ে মালামাল লোড-আনলোড করবে। তখন আমাদের শ্রমিকরা কাজ হারাবেন। তিনি বলেন, স্থানীয় শ্রমিকদের বাদ দিয়ে চুক্তি করা হলে গণআন্দোলন গড়ে তোলা হবে।

এ ব্যাপারে পানগাঁও নৌ-কনটেইনার পোর্ট ম্যানেজার আশরাফ করিম চৌধুরীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, চুক্তিতে কী আছে, তা আমার জানা নেই। তবে যারা ইজারা পেয়েছে, তারা স্থানীয় শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে বিষয়টি সমাধান করবে বলে শ্রমিকদের আশ্বস্ত করেছে।

এ ব্যাপারে চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব ওমর ফারুকের সঙ্গে মোবাইলে যোগাযোগ করা হলে তিনি আমার দেশকে বলেন, মেডলগ বাংলাদেশ লিমিটেড কোম্পানিটি সাবের হোসেন চৌধুরীর কি না, তা তিনি জানেন না। চুক্তিতে কী আছে, তাও তিনি বলতে পারবেন না।

তিনি বলেন, উচ্চ লেভেলে চুক্তি হয়েছে। টেন্ডারের মাধ্যমে ইজারা দেওয়া হয়েছে। কোন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কার লিংক রয়েছে এটা আমরা বলতে পারব না। মেডলগ বাংলাদেশ লিমিটেড টেন্ডারের মাধ্যমে ইজারা পেয়েছে। এর বেশি কিছু বলতে পারব না।

শ্রমিকদের ব্যাপারে ওমর ফারুক বলেন, তারা তো বিদেশ থেকে শ্রমিক নিয়ে আসবে না। এখানকার শ্রমিকরাই কাজ করবেন।