Image description
১৪৫ মামলার একটিরও তদন্ত শেষ হয়নি । জুলাই আন্দোলনের আসামিও এনসিপির সদস্য!

২০২৪ সালের জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে সিলেটে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার ওপর হামলার ঘটনায় করা ১৪৫টি মামলার তদন্ত যেন শেষ হতেই চায় না! অস্বাভাবিক ধীরগতি। ১৪ মাসে একটি মামলারও তদন্ত সম্পন্ন হয়নি। আইনজ্ঞরা বলছেন, এটা ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে গভীর উদ্বেগের। এ সুযোগে আসামিরা গোপনে জামিন নিয়ে পলাতক হচ্ছেন। এছাড়া আসামিদের কেউ কেউ নিজেদের রক্ষায় দ্রুত ভোল পালটে আড়ালে মিশে যাচ্ছেন জুলাই আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী ও তাদের সংগঠনের সঙ্গে!

সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশ (এসএমপি), সিলেট জেলা পুলিশ ও আদালত সূত্রের তথ্য অনুযায়ী, জুলাই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় ৯ হাজার ৯২৫ জনকে আসামি করা হয়েছে। পুলিশ এ পর্যন্ত গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়েছে মাত্র ৬৫৮ জনকে। মামলার তদন্তে এই অস্বাভাবিক ধীরগতির সুযোগে অনেক আসামিই গোপনে জামিনে মুক্তি পেয়েছেন। বর্তমানে তারা পলাতক। উদ্বেগের বিষয়, এসব পলাতক আসামির অনেকেই স্থানীয় পর্যায়ে নানা নাশকতামূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছে, মারাত্মকভাবে ব্যাহত করছে সামাজিক স্থিতিশীলতাকে।

জুলাই-পরবর্তী মামলা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে থাকা একটি সূত্র যুগান্তরকে জানায়, সিলেটের আওয়ামী লীগপন্থি প্রভাবশালী শ্রমিকনেতা জাকারিয়া আহমদকে গত ২৮ এপ্রিল রাতে পুলিশ গ্রেফতার করে। গ্রেপ্তারের পরদিন দুপুরেই মাত্র ১২ ঘণ্টার মধ্যে জামিনে বেরিয়ে যান জাকারিয়া। অথচ তার বিরুদ্ধে ছাত্রজনতার আন্দোলনে হত্যা ও নাশকতার অভিযোগে মোট পাঁচটি মামলা হয়েছে। জাকারিয়া আহমদ বাংলাদেশ সড়ক পরিবহণ শ্রমিক ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় কমিটির আইনবিষয়ক সম্পাদক এবং সিলেট জেলা শ্রমিক লীগের সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক। জাকারিয়া আহমদের দ্রুত জামিনের পক্ষে অবস্থান নেওয়ায় সিলেট জেলা শ্রমিক দলের যুগ্ম আহ্বায়ক আলী আকবর (রাজন)-কে দল থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য বহিষ্কার করা হয়। এতে স্থানীয় বিএনপি তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করে, জাকারিয়াকে ‘ডেভিল’ আখ্যা দিয়ে ‘বিচারিক স্বচ্ছতা ও প্রশাসনিক নিরপেক্ষতা’ নিয়ে প্রশ্ন তোলে। জামিন লাভের পর তার মোবাইল ফোন বন্ধ। তিনি আত্মগোপনে বলে জানা যায়।

সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশ জানায়, ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পট পরিবর্তনের পর থেকে চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত নগরীর ৬টি থানায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্রজনতার ওপর হামলার ঘটনায় মোট ১০৪টি মামলা হয়েছে। ৬টি থানার মধ্যে কোতোয়ালি মডেল থানাতেই সবচেয়ে বেশি, ৭৩টি মামলা। আসামি ৫ হাজার ৫০৮ জন। এর মধ্যে গ্রেপ্তার হয়েছে ৩২৬ জন। অন্যদিকে সবচেয়ে কম মামলা মোগলাবাজার থানায়, মাত্র একটি।

এছাড়া জেলা পুলিশের ১১টি থানায় ছাত্রজনতার ওপর হামলার প্রতিবাদে মোট ৪১টি মামলা করা হয়। এতে এজাহারনামীয় আসামি করা হয়েছে ২ হাজার ৬৬৮ জনকে। গ্রেপ্তার হয়েছে ১৫৫ জন। এই ৪১টি মামলার মধ্যে ১১টি অত্যন্ত স্পর্শকাতর হত্যা মামলা রয়েছে। যার মধ্যে ৩টি জেলা পুলিশ এবং বাকি ৮টি পিবিআই ও সিআইডি তদন্ত করছে। তবে তদন্ত বড় মন্থর।

সিলেটে জুলাই বিপ্লবে সবচেয়ে বেশি শহীদ হয়েছেন গোলাপগঞ্জ উপজেলায়। এ ব্যাপারে দায়ের করা ১৫টি মামলায় আসামি ১ হাজার ৩১১ জন। এর মধ্যে এজাহারনামীয় ৪৯ জন গ্রেপ্তার হয়েছেন।

কোম্পানীগঞ্জ উপজেলায় ৩টি মামলায় এজাহারনামীয় ৯ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। ওসমানীনগর, বালাগঞ্জ ও জৈন্তাপুর উপজেলায় দায়ের হওয়া মামলাগুলোতে কোনো গ্রেফতার নেই!

জুলাই-২৪ এর গণ-অভ্যুত্থানে সিলেটের গোলাপগঞ্জ উপজেলায় ৭ জন, বিয়ানীবাজার উপজেলায় ৪ জন এবং সিলেট সদর উপজেলায় ২ জন নিরীহ ছাত্র ও জনতা শহীদ হয়েছিলেন। এছাড়া শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবিপ্রবি) শিক্ষার্থী দিনাজপুরের রুদ্র সেনও বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় বর্বরোচিত হামলায় শহীদ হন। শহীদের রক্তের বিনিময়ে হওয়া এসব মামলার অগ্রগতি না হওয়ায় শহীদদের পরিবারে বর্তমানে গভীর হতাশা ও ক্ষোভ বিরাজ করছে। তাদের ন্যায়বিচার প্রাপ্তির আশা ক্রমশ হতাশায় পরিণত হচ্ছে।

সিলেটে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে হামলার অভিযোগে মামলার আসামি মো. কাওসার হোসেন সম্প্রতি জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সিলেট জেলা কমিটির সদস্য হয়েছেন। তার বিরুদ্ধে শুধু বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের মামলাই নয়- তার বিরুদ্ধে চেক ডিজঅনার, প্রতারণা, ধর্ষণ, বলাৎকার, ছিনতাই, চুরি, ডাকাতিসহ মোট ১৫টি মামলা রয়েছে। একাধিক মামলায় তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানাও জারি আছে। একসময় নিজেকে জামায়াতের সমর্থক হিসাবে পরিচয় দিতেন কাওসার। সম্প্রতি তাকে এনসিপির কর্মসূচিতে দেখা যাচ্ছে। গত রোববার সিলেট শহীদ মিনারে ও মিছিলে সামনের সারিতে হাসিমুখে তার উপস্থিতি দেখা গেছে। কাওসার হোসেনের বিরুদ্ধে গোলাপগঞ্জ থানায় জুলাই যোদ্ধা একলিম উদ্দিন মামলা করেছেন।

সিলেট জেলা এনসিপির সদস্য সচিব প্রকৌশলী কামরুল যুগান্তরকে জানান, কেন্দ্র থেকে কমিটি ঘোষণা করা হয়েছে। তদন্ত করে সত্যতা পেলে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।