Image description

আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে জামায়াতে ইসলামী নানান কৌশলে অগ্রসর হচ্ছে। তাদের রাজনৈতিক কৌশল মোকাবিলায় বিএনপিসহ অন্য রাজনৈতিক দলকে বেশ হিমশিম খেতে হচ্ছে। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের আলোচনায় অংশ নিয়ে জামায়াত রাজনৈতিক কৌশলের আশ্রয় নেয়। তারা জুলাই সনদ বাস্তবায়ন এবং এর আইনি ভিত্তির জন্য গণভোটের দাবি জানায়। আর এসব দাবি আদায়ে সমমনা কয়েকটি দলকে সাথে নিয়ে পিআর পদ্ধতির নির্বাচনসহ আরো কয়েকটি বাড়তি দাবিতে আন্দোলন শুরু করে। তাদের এই আন্দোলন যে প্রতিদ্বন্দ্বী দল এবং সরকারের কাছ থেকে সুবিধা আদায়ের রাজনৈতিক কৌশল তা রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা আগেই বলেছেন। আর এই কৌশলের মাধ্যমেই জামায়াত উচ্চকক্ষে পিআর এবং গণভোটের দাবি বিএনপিকে মানতে বাধ্য করেছে।

এবার জামায়াতে ইসলামী আসন্ন নির্বাচনে চূড়ান্ত প্রার্থী মনোনয়নেও কৌশলী অবস্থান গ্রহণ করছে। বিশেষ করে ইসলামী দলগুলো থেকে প্রার্থী নির্বাচনের বিষয়টিকে জামায়াত খুব গুরুত্ব দিচ্ছে। তারা হেফাজতে ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ নেতা মাওলানা মামুনুল হকের দল বাংলাদেশ খেলাফত মজলিশ এবং ড. আহমদ আব্দুল কাদেরের নেতৃত্বাধীন খেলাফত মজলিশ থেকে কয়েকজনকে মনোনয়ন দেওয়ার চিন্তাভাবনা করছে। এসব দলের নেতাদের পূর্ণ সমর্থন অর্থাৎ সব ধরনের সহযোগিতা দিয়ে নির্বাচন করার আশ্বাস দিয়েছে দলটি। এ ছাড়া চরমোনাই পীর সাহেবের দলকে জামায়াতে ইসলামী খুব গুরুত্ব দিয়ে বেশ কয়েকজনকে তাদের সমর্থন দেওয়ার বিষয় জানিয়েছে। হেফাজত-সংশ্লিষ্ট এবং অন্য ইসলামী দলগুলোর প্রতি জামায়াতে ইসলামীর এই যে শর্তহীন সমর্থন তাও তাদের একটি রাজনৈতিক কৌশল বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইসলামী দলগুলোর সাথে জামায়াতের সখ্যতা যত বাড়বে বিএনপির ওপর চাপ তত বৃদ্ধি পাবে। এর ফলে বিএনপি ইসলামী দলগুলোকে গুরুত্ব দিতে বাধ্য হবে। তখন বিএনপিও ইসলামী দলের সাথে আসন সমঝোতায় যাবে। এতে করে আগামী নির্বাচনে আলেম-ওলামাদের অনেকে পার্লামেন্ট সদস্য নির্বাচিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। আর পার্লামেন্টে যত বেশি আলেম-ওলামা থাকবে তাতে আখেরে জামায়াতে ইসলামীই লাভবান হবে।বিশিষ্ট রাজনৈতিক বিশ্লেষক ডা. জাহেদ উর রহমান বলেন, ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে জামায়াতে ইসলামী বিভিন্ন রাজনৈতিক কৌশল গ্রহণ করছে। তারা একদিকে বিভিন্ন দাবিতে রাজপথে যেমন আন্দোলন করছে, ঠিক অন্যদিকে প্রার্থী ঘোষণা করে নির্বাচনী প্রচরণাও বেশ ভালোভাবে চালিয়ে যাচ্ছে। এটা তাদের একটা বড় কৌশল। এই কৌশলের মাধ্যমে দলটি বিএনপির কাছ থেকে উচ্চকক্ষে পিআর এবং গণভোটের দাবি আদায় করতে পেরেছে। এখন দলটি বিভিন্ন ইসলামী দলের সাথে নির্বাচনী সমঝোতা করে বিএনপিকে আবার চাপে ফেলার কৌশল নিয়েছে। এতে করে বিএনপিও ইসলামী দলগুলোর দিকে ঝুঁকতে বাধ্য হবে।

জাতীয় সংসদের ৩০০ সংসদীয় আসনে আরো দুই মাস আগেই প্রার্থী ঠিক করে ভোটের প্রচারণা শুরু করেছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। এ দলটির আগে আর কেউ পোস্টার-ব্যানার দিয়ে রাজধানীসহ সারাদেশে প্রচারণা শুরু করেনি। এটিও জামায়াতে ইসলামীর একটি বড় রাজনৈতিক কৌশল। ভোটের মাঠে প্রচারণার পাশাপাশি এ দলটি পাঁচ দফা দাবিতে আট দলের নেতৃত্বে আন্দোলনও করছে। এই আটটি দলের সাথে তারা নির্বাচনী আসন সমঝোতা করতে যাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে দলের সংখ্যা আরো বাড়তে পারে বলে দলীয় সূত্রে জানা গেছে। এসব দলকে বেশ কিছু আসনে ছাড় দেওয়া বিষয়েও দলটি সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এর ফলে গত দুই মাস আগে জামায়াত যে প্রাথমিক প্রার্থী তালিকা ঘোষণা করেছিল তা থেকে অনেককে বাদ দিতে হবে। আগামী নির্বাচনে যেসব প্রার্থীর জয়ী হওয়ার সম্ভাবনা বেশি তাদের তারা আসন ছেড়ে দেওয়ার চিন্তা-ভাবনা করছে। এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট দল থেকে তাদের সম্ভাব্য প্রার্থী তালিকা জামায়াতের কাছে এসেছে। জামায়াত তাদের বিভিন্ন সোর্সের মাধ্যমে এসব আসনে জরিপ করছে। জরিপে যাদের যেখানে জয়ী হওয়ার সম্ভাবনা আছে তাদের মনোনয়ন দেওয়া হবে এবং জামায়াতের পক্ষ থেকে এসব প্রার্থীকে বিজয়ী করার জন্য সর্বাত্মক সহযোগিতা করা হবে।

জামায়াতের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের কয়েকজন নেতার সাথে কথা বলে জানা যায় যে, আগামী মাসের প্রথম সপ্তাহেই দলটি তাদের চূড়ান্ত প্রার্থী তালিকা ঘোষণা করবে। এক্ষেত্রে দলটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদসহ (ডাকসু) কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ নির্বাচনের প্যানেল মনোনয়নকে মডেল হিসেবে সামনে রাখছে। কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী বাছাইয়ে ইনক্লুসিভ (জাতি, ধর্ম, লিঙ্গ নির্বিশেষে সবাইকে অন্তর্ভুক্ত করে) পদ্ধতি প্রয়োগ করেছিল ইসলামী ছাত্রশিবির। এ কারণেই ব্যাপক জয় এসেছে। শিবিরের এই বিজয়ের পর জামায়াতে ইসলামীও তাদের প্রার্থী মনোনয়নে ইনকøুসিভ পদ্ধতি নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে।দলটির সূত্রে জানা গেছে, আন্দোলনরত দলগুলোকে আসন ছাড়ার পর বাকি আসনগুলোতে তাদের প্রার্থী বাছাইয়ে আরো ইনক্লুসিভ করার চিন্তাভাবনা করছে জামায়াত। দলের নীতিনির্ধারকরা এবারের নির্বাচনে বিজয়ী হতে সর্বোচ্চ কৌশল অবলম্বন করতে চান। এর অন্যতম হলো এবারই প্রথমবারের মতো নারীদের প্রার্থী করার কথা ভাবছে দলটি। জামায়াতে মহিলা বিভাগের নেত্রীদের বেশির ভাগই কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। এ ছাড়া চিকিৎসক-ইঞ্জিনিয়ারসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পেশায় থেকে সুনামের সাথে দায়িত্ব পালন করছেন তারা। এসব নারীর মধ্য থেকে কয়েকজনকে প্রার্থী করার বিষয়ে দলটি সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ইতোমধ্যে তাদের নারী নেত্রীদের বিভিন্ন সেমিনারে আলোচক হিসেবে অংশ নিতে বলা হচ্ছে। কূটনৈতিকদের সাথে বৈঠকেও নারী নেত্রীদের রাখা হচ্ছে। দলটির আগের কার্যক্রমে এমনটি ছিল না। এ ছাড়া এবার সংখ্যালঘু প্রার্থী দেয়ার কথাও চিন্তা করছে জামায়াত। হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টানসহ বিভিন্ন উপজাতির মধ্য থেকে কয়েকজনকে প্রার্থী করতে পারে দলটি। ইতোমধ্যে খুলনায় হিন্দুদের নিয়ে দলের সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ারের সমাবেশ দেশে বেশ সাড়া ফেলেছে। বিভিন্ন এলাকা থেকে হিন্দুরা জামায়াতে ইসলামীতে আনুষ্ঠানিকভাবে যোগদান করেছেন। জামায়াত বর্তমানে যেসব প্রার্থী দিয়েছে এর বেশির ভাগই চিকিৎসক, আইনজীবী, শিক্ষকসহ বিভিন্ন পেশায় কর্মরত রয়েছেন বা ছিলেন। এর পাশাপাশি পেশাজীবী শীর্ষ নেতাদের মধ্য থেকেও আরো প্রার্থী করার পরিকল্পনা রয়েছে জামায়াতের। তবে এবার জামায়াতের প্রার্থী করার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় চমক হবে জুলাই অভ্যুত্থানের সেই তরুণ যোদ্ধাদের থেকে প্রতিনিধি দেয়া। এ ক্ষেত্রে ডাকসুর ভিপি সাদিক কায়েমের নাম ইতোমধ্যেই আলোচনায় এসেছে। এ ছাড়া জাকসু, চাকসু ও রাকসুতে ভিপি-জিএসসহ বেশির ভাগ পদেই শিবিরের নেতারা বিজয়ী হয়েছেন। তাদের মধ্য থেকেও প্রার্থী করা হতে পারে।

জামায়াতের কেন্দ্রীয় প্রচার ও মিডিয়া বিভাগের প্রধান অ্যাডভোকেট এহসানুল মাহবুব জোবায়ের ইনকিলাবকে বলেন, আমরা ৮ দল ৫ দফা দাবিতে আন্দোলনের মাঠে আছি। আমাদের সাথে আরো কয়েকটি দল যুক্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এসব দলের সাথে আমাদের আসন সমঝোতার বিষয়টি প্রায় চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। এক্ষেত্রে কোন দল কতটি আসনে নির্বাচন করবে সেটি বিবেচ্য বিষয় নয়। আমাদের বিবেচ্য বিষয় হবে কে কোন আসন থেকে বিজয়ী হতে পারবে, সেটি বিবেচনায় নিয়েই মনোনয়ন চূড়ান্ত করা হবে। আমাদের লক্ষ্য হবে ইসলামকে বিজয়ী করা। প্রার্থী মনোনয়নের ক্ষেত্রে নারী, বিভিন্ন সংখ্যালঘু সম্প্রদায় এবং জুলাই অভ্যুত্থানের তরুণ যোদ্ধাদেরও প্রাধান্য দেওয়া হবে।