শেখ পরিবারের সদস্যসহ আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা বিদেশে আয়েশে থাকলেও দেশে ভালো নেই দলটির তৃণমূলের নেতাকর্মীরা। পলাতক নেতাদের উসকানিতে রাজপথে নামতে গিয়ে প্রতিনিয়তই প্রতিকূল পরিস্থিতিতে পড়তে হচ্ছে অনেকটা নিরীহ গোছের এসব কর্মীকে।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মুখোমুখি হওয়ার পাশাপাশি সাধারণ জনগণেরও রোষানলে পড়ছেন তারা। শেখ হাসিনাসহ বিদেশে পলাতক নেতাদের কথিত বার্তায় আন্দোলন করতে গিয়ে পদে পদে বাধার মুখে পড়তে হচ্ছে তাদের। ঝুঁকিতে ফেলছেন তাদের পরিবারকেও। অবশ্য বিদেশে অবস্থানরত নেতাদের হাঁকডাকে দেশে আত্মগোপনে থাকা এসব নেতাকর্মী মাঠে নেমেও কোনো অবস্থান তৈরি করতে পারছেন না। এতে মনোবল হারিয়ে দিনদিন হতাশগ্রস্ত হয়ে পড়ছেন তারা।
দেশের বিভিন্ন স্থানে আত্মগোপনে থাকা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের সঙ্গে আলাপকালে এসব তথ্য জানা গেছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরাও বলছেন, আওয়ামী লীগের তৃণমূলের কর্মীদের বড় একটি অংশ ক্ষমতায় থাকতে মূল্যায়িত হননি। দেশে ঘোলাটে পরিস্থিতি তৈরি করতে এসব নেতাকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। এদের মাধ্যমে নতুন কোনো পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে তার সুবিধা শেখ পরিবারের পলাতক নেতারাই ভোগ করবেন।
আওয়ামী শাসনামলের সাড়ে ১৫ বছরে লুটপাট করে অবৈধ সম্পদের পাহাড় গড়েছে ফ্যাসিবাদের শিরোমণি শেখ পরিবার। সেই সঙ্গে লোপাট করে হাজার হাজার কোটি টাকা কামিয়েছেন আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে স্বৈরাচার শেখ হাসিনা লাখ লাখ নেতাকর্মীকে দেশে ফেলে ভারতে পালিয়ে যান। শেখ হাসিনা নিজে পালিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি শেখ পরিবারের সব সদস্যের আগে-পরে নিরাপদ প্রস্থান নিশ্চিত করেন।
এছাড়াও দুর্নীতিগ্রস্ত আওয়ামী লীগের শীর্ষ প্রভাবশালী নেতারাও দেশ থেকে পালিয়ে যেতে সক্ষম হন। বর্তমানে তারা ভারতসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অবস্থান করছেন। এসব নেতা কেবল নিজেরাই বাংলাদেশ ছেড়ে পালিয়ে যাননি, তাদের স্ত্রী-সন্তানদেরও সঙ্গে নিয়ে গেছেন। এমনকি বাসার কাজের লোক ও পিয়ন-চাপরাশিদেরও সঙ্গে নিয়ে বিদেশে নতুন সাম্রাজ্য তৈরি করে আরাম-আয়েশে দিন কাটাচ্ছেন।
সাড়ে ১৫ বছরের লোপাটের অর্থ দিয়ে ভোগ-বিলাস করছেন। যারা দেশে থেকে যান, তাদের অনেককেই বিভিন্ন মামলায় আটক হয়ে জেলে যেতে হয়েছে ও হচ্ছে। অনেকেই গা-ঢাকা দেন। কেউ কেউ রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড থেকে গুটিয়ে নিয়ে স্বাভাবিক জীবনযাপন শুরু করেন।
স্বয়ং শেখ হাসিনাসহ বিদেশে অবস্থানরত নেতারা বিভিন্ন সময় কথিত আন্দোলনের ঘোষণা দিয়ে দেশে অবস্থানরত দলের সাধারণ নেতাকর্মীদের উসকে দিচ্ছেন। নিজেরা বিশেষ ফায়দা লুটতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভিডিও ও অডিও বার্তায় নানা ‘কর্মসূচির ডাক’ দিয়ে বাংলাদেশে বসবাসকারী অহিংস নেতাকর্মীদের সহিংস করে তুলছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গত বছরের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পরপরই ১৫ আগস্ট শেখ মুজিবের মৃত্যুবার্ষিকী ‘জাতীয় শোক দিবস’ পালনের নামে বিদেশ থেকে প্রথম উসকে দেওয়া হয়। তাদের উসকানিতে পা দিয়ে আওয়ামী লীগের বেশকিছু কর্মী-সমর্থকসহ সাধারণ মানুষ ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে গিয়ে জনরোষের শিকার হন। ওই দিন বেশ কয়েকজন ছাত্র-জনতার গণপিটুনির শিকার হন। অনেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে আটক হন। এছাড়াও গত বছরের ১০ ডিসেম্বর নূর হোসেন দিবসের কর্মসূচি পালন করতে গিয়েও একই পরিস্থিতির শিকার হন তারা।
ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে শেখ মুজিবের বাড়ি বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়ার জন্য আওয়ামী লীগের তৃণমূলের নেতাকর্মীরা শেখ হাসিনাকেই দায়ী করেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে দলের বেশ কয়েকজন কর্মী আমার দেশকে বলেন, শেখ হাসিনার ওই দিন ফেসবুক লাইভে এসে বক্তব্য দেওয়ার কারণেই ঐতিহাসিক ৩২ নম্বরের বাড়িটি জনআক্রোশের মুখে পড়ে। গত ৫ ফেব্রুয়ারি হাসিনা ফেসবুক লাইভে আসবেন বলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক প্রচার চালানো হয়। এতে জুলাই আন্দোলনের পক্ষের শক্তি ক্ষুব্ধ হয়ে ধানমন্ডি ৩২ নম্বর সড়কে শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়ি বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়ার ঘোষণা দেয়। শেখ হাসিনার বক্তব্যের জেরে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাড়ির অর্ধেকের বেশি অংশ ভেঙে ফেলা হয়। এছাড়াও সেদিন শেখ হাসিনার বাসভবন সুধা সদন ও গুলিস্তানের শহীদ আবরার অ্যাভিনিউস্থ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আগুন দেওয়া হয়েছিল। এর আগে হাসিনার সরকারের পতনের পরও বাড়িটি আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল।
শেখ হাসিনা ছাড়াও আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক, যুগ্ম সম্পাদক হাছান মাহমুদ, মাহাবুব-উল আলম হানিফ এবং আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিমসহ দলের বেশ কয়েকজন পলাতক নেতা বিভিন্ন সময় ভিডিও ও অডিও বার্তায় কথিত কর্মসূচি দিয়ে বাংলাদেশে অবস্থানরত নেতাকর্মীদের উসকে দিয়েছেন। এনসিপির গত ১৬ জুলাইয়ে গোপালগঞ্জে কর্মসূচিতে আক্রমণ করেছিল আওয়ামী লীগ। দলটি ঘোষণা দিয়ে আগেভাগেই প্রস্তুতি নিয়ে অতর্কিত হামলা চালায়।
জানা গেছে, শেখ হাসিনার ফুপাতো ভাই ও দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিমের উসকানিতে ওই হামলার ঘটনা ঘটে। তিনি ভারত থেকেই ওই হামলার উসকানি দেন। এছাড়াও যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়ও বিভিন্ন সময় কথিত আন্দোলনকে উসকে দিচ্ছেন।
হাসিনার পতনের পর প্রথমদিকে গা-ঢাকা দেওয়া সাধারণ কর্মীদের অনেকেই স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে শুরু করেছিলেন। কথিত আন্দোলনের কারণে এসব নেতা আবার চাপের মুখে পড়ছেন। এদের কেউ কেউ উসকানিতে পা দিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে আটক হচ্ছেন। কেউ শিকার হচ্ছেন জনরোষের আর কেউ কেউ আন্দোলন কর্মসূচিতে না গিয়েও অন্যদের কারণে হয়রানির মুখে পড়ছেন। অবশ্য শেখ হাসিনাসহ বিদেশে পলাতক নেতাদের উসকানিতে দলের অনেকেই যেমন মাঠে নেমেছেন আবার বহু কর্মী এসব কর্মসূচির প্রকাশ্যে বিরোধিতাও করেছেন। পলাতক নেতাদের ভিডিও বা অডিও বার্তা দিয়ে কর্মসূচি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আপলোড করা হলে তার কমেন্টসে দলের অনেকেই বিরূপ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। ‘আপনারা লুটের টাকা নিয়ে বউ-বাচ্চা নিয়ে বিদেশে আরামে বসে আমাদের মাঠে নামার হুকুম দিচ্ছেন। দলের প্রতি ভালোবাসা থাকলে দেশে এসে কর্মসূচি দিন। আপনারা মিছিলে নেতৃত্ব দেবেন, আমরা পেছনে থাকব।’ এ ধরনের অনেক প্রতিক্রিয়া কর্মসূচি ঘোষণা দিয়ে আপলোড করা ভিডিও ও অডিও বার্তার নিচে দেখা যাচ্ছে।
ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতা ও আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় উপকমিটির সদস্য বিমান রায় গত ২ সেপ্টেম্বর তার ফেসবুক পেজে লেখেন, ‘আলাউদ্দীন নাসিমের (আওয়ামী লীগের সাবেক কেন্দ্রীয় নেতা ও দ্বাদশ সংসদের এমপি) একটা পোস্ট দেখলাম। উনি লিখেছেনÑবাঙালি জেগে ওঠো। কার নেতৃতে জেগে উঠবে। দেশে এসে নেতৃত্ব দেন। ইন্ডিয়ায় বসে বুলি আওড়িয়ে লাভ নাই। দেশে না খেয়ে থাকা লোকগুলি জেগে উঠবে আর পটপরিবর্তন হলে আবার লুটেপুটে খাবেন। বাহ! কি চমৎকার। আপনাদের মতো নেতাদের কারণেই আজ দলের আর আপার এই অবস্থা।’ এ ধরনের আরো অনেক প্রতিক্রিয়া গত এক বছরে ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেখা গেছে।
ছাত্রলীগের সাবেক কেন্দ্রীয় নেতা ও আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় উপকমিটির এক সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে আমার দেশকে বলেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তিনি সক্রিয়। সুযোগ হলে আওয়ামী লীগের পক্ষে স্ট্যাটাস দেন। তবে বিদেশে পালিয়ে থেকে যারা কর্মসূচি দিচ্ছেন, তিনি তাদের সঙ্গে নেই। এসব কর্মসূচিতে তিনি অংশ নেবেন না।
বর্তমানে আত্মগোপনে থাকা বৃহত্তর ফরিদপুর অঞ্চলের এই নেতা বলেন, দল ক্ষমতায় থাকতে কোনো সুবিধা আমরা পাইনি। যারা সুবিধা নিয়েছেন, তারাই এখন বিদেশে বসে আন্দোলনের ডাক দিয়ে আমাদের ঝুঁকিতে ফেলছেন। দিন এলে তারাই আবার দেশে এসে সুবিধা নেবেন। নিজেদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অন্যের জন্য আর নয়।
আওয়ামী লীগের তৃণমূলের নেতাকর্মীরা জানান, শেখ হাসিনাসহ পালিয়ে থাকা অন্য নেতাদের উসকানিতে তারা প্রতিনিয়তই বিপদের মুখে পড়ছেন। তাদের নির্দেশে মিছিলের নামে মাঠে নামতে গিয়ে হাজার হাজার নেতাকর্মী বিপাকে পড়েছেন। সারা দেশে গ্রেপ্তার হয়েছেন অনেক নেতাকর্মী। সর্বশেষ শেখ হাসিনার গণহত্যার রায়কে কেন্দ্র করে বড় ধরনের চাপের মুখে পড়েছেন বাংলাদেশে বসবাসরত আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। শেখ হাসিনার মামলার রায় ঘোষণার তারিখকে কেন্দ্র করে গত ১৩ নভেম্বর ভিডিও বার্তায় লকডাউন ঘোষণা দিয়ে আন্দোলনের উসকানি দেওয়ায় দলের অনেক নেতাকর্মী ক্ষুব্ধ হন। দলের কথিত একটি অংশ ওই কর্মসূচি পালনের নামে কয়েকটি স্থানে ঝটিকা মিছিল, বাসে আগুন ও ককটেল বিস্ফোরণ করলেও আন্দোলনে সাড়া মেলেনি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ১৩ নভেম্বর কিছুটা উত্তেজনা তৈরি করতে পারলেও রায় ঘোষণার দিন অর্থাৎ ১৭ নভেম্বর আওয়ামী লীগের শাটডাউন কর্মসূচি পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে। তাদের ওই দিনের কর্মসূচিতে জনমনে কোনো প্রভাব পড়েনি। উল্টা কর্মসূচি ঘোষণার কারণে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাড়িটি আবারও জনতার আক্রোশের মুখে পড়ে। পরে অবশ্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর শক্ত অবস্থানে কোনো অঘটন ঘটেনি।
রাজধানীসহ দেশের বেশ কয়েকটি স্থানে আত্মগোপনে থাকা আওয়ামী লীগের কর্মীদের সঙ্গে আলাপ করলে তারা জানান, এসব ভিডিও বার্তার কর্মসূচি সফল তো হচ্ছেই না; বরং দিনদিন কর্মসূচিতে অংশগ্রহণের হার কমছে। আর এ কর্মসূচির কারণে নতুন করে বিপদে পড়ছেন নেতাকর্মীরা। গত কয়েক মাসে তারা কিছুটা স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে শুরু করলেও বর্তমানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে তল্লাশি করছে। তাদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে।
আওয়ামী লীগ গত ১৩ নভেম্বর ঘিরে রাজধানীসহ সারা দেশে বড় ধরনের আবেদন তৈরি করতে না পারলেও বৃহত্তর ফরিদপুর অঞ্চলে কিছুটা প্রভাব পড়ে। জানা গেছে, শেখ হাসিনার ভাগনে যুবলীগ নেতা মজিবুর রহমান চৌধুরী নিক্সন তার সন্ত্রাসী বাহিনীকে জড়ো করে ১৩ নভেম্বর ওই অঞ্চলে ত্রাস সৃষ্টির চেষ্টা করে। পরে রায় ঘোষণার দিন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কঠোর অবস্থান নিলে নিক্সন বাহিনী কোনো আবেদন তৈরি করতে পারেনি।
সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, ভুল নেতৃত্বের হঠকারী সিদ্ধান্তের কারণেই ধ্বংসস্তূপে থাকা আওয়ামী লীগ অতলে তলিয়ে যাচ্ছে। বিদেশে পলাতক শীর্ষ নেতাদের নির্দেশে এক শ্রেণির বিপথগামী নেতাকর্মী যেভাবে চোরাগোপ্তা হামলাসহ সন্ত্রাসের পথ বেছে নিয়েছে, তাতে দলের ভবিষ্যতে টিকে থাকার সম্ভাবনা ফিকে হয়ে আসছে। অতীতের সীমাহীন ভুলের জন্য জাতির কাছে ক্ষমা চাওয়া এবং সুস্থধারার রাজনীতিতে ফিরে আসার প্রত্যাশার পরিবর্তে যা করা হচ্ছে, তাতে এ দলের অবশিষ্ট ত্যাগী নেতাকর্মীরা আরো হতাশ ও ক্ষুব্ধ হবেন।
জানা গেছে, নিজেরা নিরাপদে থেকে আন্দোলনের ডাক দিয়ে বাংলাদেশে অবস্থানরত কর্মীদের ঝুঁকির মধ্যে ফেলার কারণে ত্যাগী ও দুর্দিনের নেতাকর্মীরা হতাশ ও ক্ষুব্ধ। তারা বলছেন, কোনো পরিকল্পনা ছাড়াই এসব আন্দোলনে শুধু ভোগান্তি আর ক্ষতির পাল্লা ভারী হবে। এর থেকে ভুলের জন্য ক্ষমা চেয়ে স্বাভাবিক রাজনীতিতে ফেরার উদ্যোগ নেওয়া হলে তা দলের জন্য বেশি ফলপ্রসূ হবে। তাদের মতে, দলের মধ্যে ও সাধারণ মানুষের কাছে এখনো যেসব নেতার ইমেজ ও গ্রহণযোগ্যতা ভালো অবস্থানে রয়েছে, তাদের কাজে লাগানো উচিত। তাদের প্রকাশ্যে এসে দলের পক্ষ থেকে অতীতের ভুলের জন্য ক্ষমা চেয়ে রাজনীতি করলে জনগণের কাছে আওয়ামী লীগের গ্রহণযোগ্যতা আস্তে আস্তে ফিরে আসবে। এসব কারণে দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীরাও শেখ হাসিনার প্রতি এখন চরম ক্ষুব্ধ। যারা মনে করেছিলেন, সত্যিই শেখ হাসিনা দেশে ফিরে আসতে পারবেন। আওয়ামী লীগ এভাবে ঝটিকা মিছিলের মধ্য দিয়ে দ্রুত রাজনীতিতে ফিরতে পারবে, তাদের সে আশা পুরোপুরি ভেস্তে গেছে। তাই শেখ হাসিনা এবং তার পরিবারের সদস্যদের সুবিধার জন্য কেউ আর রাজপথে নামবেন না। এছাড়া বিদেশে পলাতক থেকে দলের যেসব গডফাদার উসকানি দিচ্ছেন, তাদেরও তারা ফাইনালি লাল কার্ড দেখিয়ে দিয়েছেন।
দেশ থেকে পালিয়ে ড়িয়ে শেখ হাসিনা বর্তমানে ভারতের রাজধানী দিল্লিতে অবস্থান করছেন। তিনি সেখানে ইতোমধ্যে মোদি সরকারের ট্রাভেল ডকুমেন্টসও পেয়েছেন। তবে পালিয়ে যাওয়া অন্য নেতারা কীভাবে ভারতে অবস্থান করছেন, তা অস্পষ্ট। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী ও তার সরকারের আমলাসহ ভারতে পালিয়ে রয়েছেন এমন ৭৩৪ জনের একটি তালিকা গত সেপ্টেম্বরে আমার দেশ-এর হাতে আসে। তাদের বেশ কয়েকজনের কাছে বাংলাদেশি পাসপোর্ট রয়েছে বলেও জানা গেছে।
শেখ হাসিনা ছাড়াও ভারতে (কলকাতায়) শেখ পরিবারের যেসব সদস্য রয়েছেন, তারা হলেন—শেখ হাসিনার ফুপাতো ভাই শেখ ফজলুল করিম সেলিম, তার দুই ছেলে যুবলীগ নেতা শেখ ফজলে ফাহিম ও শেখ ফজলে নাইম; অপর ফুপাতো ভাই আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ ও তার এক সন্তান; শেখ হাসিনার চাচাতো ভাই শেখ হেলাল উদ্দিন ও তার ছেলে শেখ তন্ময়, শেখ হেলালের ভাই সাবেক এমপি শেখ সালাউদ্দিন জুয়েল, শেখ সেলিমের বোনের স্বামী যুবলীগের সাবেক চেয়ারম্যান ওমর ফারুক চৌধুরী, শেখ হাসিনার ভাগনে চিফ হুইপ নূর-ই আলম চৌধুরী লিটন ও মুজিবুর রহমান চৌধুরী নিক্সন। এছাড়াও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া, জাহাঙ্গীর কবির নানক, এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন, গণহত্যার রায়ে ফাঁসির আসামি সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালসহ দলের প্রভাবশালী নেতারা স্ত্রী-সন্তান ও কাজের লোক নিয়ে আয়েশে ভারতে অবস্থান করছেন।
এদিকে, শেখ হাসিনার ভাগনে শেখ ফজলে শামস পরশ কানাডায় রয়েছেন বলে জানা গেছে। তার অপর ভাগনে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র ৫ আগস্টের আগেই ‘সরকারি’ সফরের নামে সিঙ্গাপুর চলে যান। এরপর তিনি আর ফেরেননি। তিনি সিঙ্গাপুর থেকে দুবাই হয়ে কানাডায় অবস্থান করছেন বলে জানা গেছে। এছাড়া শেখ হাসিনার বোন শেখ রেহানা তার সন্তানদের নিয়ে লন্ডনে বসবাস করছেন। শেখ হাসিনার মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুল বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আঞ্চলিক মহাপরিচালকের পদ থেকে বাধ্যতামূলক ছুটিতে গিয়ে বর্তমানে ভারতে অবস্থান করছেন।
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পলিটিক্যাল স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক ড. সাহাবুল হক এক প্রতিক্রিয়ায় আমার দেশকে বলেন, বিদেশে অবস্থানরত আওয়ামী লীগ নেতাদের ডাকে খুব একটা সাড়া পড়ছে না। আমার মনে হচ্ছে, আওয়ামী লীগের নেতারা অপেক্ষাকৃত নিরাপদ ও আরামদায়ক পরিবেশে বসে সামাজিকমাধ্যমে উত্তেজনাকর ও আগ্রাসী বক্তব্য ও কর্মসূচির ডাক দিয়ে দলটির মাঠপর্যায়ের নেতাকর্মীদের অপ্রয়োজনীয় সংঘাতে জড়িয়ে ফেলছেন। অনলাইন নির্দেশনা বাস্তব পরিস্থিতির সঙ্গে অমিল হওয়ায় তা যেমন সফল হচ্ছে না, তেমনি তৃণমূলকে প্রায়ই সহিংস পরিবেশ মোকাবিলা করতে হচ্ছে। এতে তারা পুলিশের কঠোরতা, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের চাপ ও প্রশাসনিক হয়রানির সম্মুখীন হচ্ছেন। এসব চাপে তৃণমূল পর্যায়ের মনোবল দ্রুত ভেঙে পড়ছে এবং নেতাকর্মীদের মধ্যে হতাশা ও অনিশ্চয়তা বাড়ছে। দূরবর্তী নেতৃত্বের মাঠের বাস্তবতা সম্পর্কে সীমিত ধারণা, রাজনৈতিক দায়িত্বহীনতা ও পরিস্থিতি মূল্যায়নের ঘাটতি সংগঠনের স্থিতিশীলতার জন্য গুরুতর ঝুঁকি তৈরি করছে। এর ফলে কেন্দ্রীয় ও তৃণমূল নেতৃত্বের মধ্যে আস্থার ব্যবধান বাড়ছে, যা ভবিষ্যতে রাজনৈতিক সংগঠন পরিচালনায় আরো সংকট তৈরি করতে পারে।
বিশিষ্ট রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক মাহবুব উল্লাহ আমার দেশকে বলেন, আওয়ামী লীগ বিদেশে বসে বাংলাদেশবিরোধী আস্ফালন করছে। গুপ্তহত্যা ও গেরিলাযুদ্ধের ঘোষণা দিচ্ছে। তাদের মধ্যে কোনো অনুশোচনা আমরা দেখছি না। তাদের এ আস্ফালনে সাড়া দিয়ে দেশে কেউ যদি নাশকতা সৃষ্টির চেষ্টা করে, তাহলে তাদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মুখোমুখি হতে হবে। কারণ, কেউ সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করলে তার বিরুদ্ধে পুলিশকে তো অ্যাকশনে যেতেই হবে আর কেউ যদি স্বাভাবিক শান্তিপূর্ণ জীবনযাপন করতে চায়, আমার মনে হয় না প্রশাসন তার ক্ষেত্রে কোনো হিংসাত্মক পদক্ষেপ নেবে।