১৭ নভেম্বর ছিল শেখ হাসিনার জন্য গুরুত্বপূর্ণ তারিখ। ১৯৬৮ সালের এই দিনে তিনি পরমাণু বিজ্ঞানী ড. ওয়াজেদ মিয়ার সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। ৫৮তম বিবাহ বার্ষিকীর দিনেই আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল তাকে মৃত্যুদ- দেন। শুধু তাই নয়, তিনি ১৯৮১ সালে ভারতের দিল্লিতে বসেই আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন। তিনি দিল্লি থেকে ওই বছর ১৭ মে বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন করেন। আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে শেখ হাসিনা ওই সময় লন্ডন সফরে গিয়ে বিবিসিকে দেয়া সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘রাজনীতির মাধ্যমে পিতা হত্যার প্রতিশোধ নেব’। কথা রেখেছেন শেখ হাসিনা। তিনি পিতা হত্যার প্রতিশোধ নিয়েছেন। পাতানো নির্বাচনে ক্ষমতায় গিয়ে জাতিকে উচিত শিক্ষা (!) দিয়েছেন। বাংলাদেশে শেখ হাসিনার আবির্ভাব অনেকটা বিরল ম্যাজিকের মতো ‘দিল্লি থেকে এলেন, দেখলেন, রাষ্ট্রের সম্পদ লুট করলেন, পিতা হত্যার প্রতিশোধ নিলেন, হাজারো মানুষকে খুন, গুম আর জাতিকে রক্তাক্ত করে আবার চলেও গেলেন’। এক সময়ের গৃহবধূ শেখ হাসিনার দিল্লিতে বসেই আওয়ামী লীগের রাজনীতি শুরু হয় এবং এখন ভারতে বসেই আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মৃত্যুদ-ের খবর পেলেন। ভারতের পৃষ্ঠপোষকতায় দীর্ঘ সাড়ে ১৫ বছর বাংলাদেশের মানুষের ওপর জুলুম-নির্যাতন, হত্যা-খুন-গুম এবং রাষ্ট্রীয়যন্ত্রকে ব্যবহার করে নিষ্ঠুর পৈশাচিকতার মাধ্যমে লাখো মানুষকে ভিকটিম করেছেন। রাজপথ রক্তাক্ত করে মানবাধিকার লংঘন এবং ১৪শ’ মানুষকে হত্যা করেও অপরাধবোধ ও অনুশোচনা না করে নিজেই এখন ভিকটিম হুড পলিটিক্সে নেমেছেন। হাজারো মানুষ হত্যা করে মৃত্যুদ-প্রাপ্ত হওয়ার পর উল্টো বিদেশিদের সহানুভূতি আদায়ে নির্যাতিতের ভান করে রাজনৈতিক চালাকি করছেন।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল শেখ হাসিনার বিচার করেছে। এ বিচারকার্য পরিচ্ছন্ন এবং স্বচ্ছভাবে করা হয়েছে। আদালতে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মোট পাঁচটি অভিযোগ আনা হয়েছে। সেগুলো হলোÑ উসকানিমূলক বক্তব্য প্রদান; প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করে আন্দোলনকারীদের নির্মূল করার নির্দেশ; রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবু সাঈদকে গুলি করে হত্যা; রাজধানীর চানখাঁরপুল এলাকায় আন্দোলনরত ছয়জনকে গুলি করে হত্যা এবং আশুলিয়ায় ছয়জনকে পুড়িয়ে হত্যা করা। ট্রাইব্যুনাল বিচারকার্যে ৫৪ জনের সাক্ষী নেয়া হয় এবং ট্রাইব্যুনালের ঘোষিত রায়ে বিভিন্ন তথ্য-প্রমাণের বিবরণ তুলে ধরা হয়। বিচারকার্য চলার সময় অভিযুক্তদের অডিও-ভিডিওসহ যেসব তথ্য-উপাত্ত ট্রাইব্যুনালে উপস্থাপন করা হয়েছে, সেগুলোর বর্ণনা দেওয়া হয়।
ঘটনার শিকার ও সাক্ষীরা অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে কী অভিযোগ তুলেছেন তার বর্ণনা দেওয়া হয়। জুলাই অভ্যুত্থানের সময় রাজধানী ঢাকার যাত্রাবাড়ী, রামপুরা, বাড্ডা, সাভার, আশুলিয়া, রংপুরসহ বিভিন্ন স্থানে যেভাবে প্রাণঘাতী গুলি ব্যবহার করে আন্দোলনকারীদের হত্যা করা হয়েছে, সেগুলোর ভিডিও ও তথ্য-প্রমাণের বিবরণ দেওয়া হয়। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় মানবাধিকার লংঘন নিয়ে জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রকাশিত রিপোর্টের বিভিন্ন অংশ উপস্থাপন করা হয়। শিক্ষার্থীদের আন্দোলন ঠেকাতে প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারের নির্দেশনা দেয়া নির্দেশনা সংক্রান্ত বিভিন্ন জনের সঙ্গে শেখ হাসিনার টেলিফোনে কথোপকথনগুলো শোনানো হয়। শেখ হাসিনার সঙ্গে সে সময়ের তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু, ঢাকার মেয়র ফজলে নূর তাপসের ফোনালাপ শোনানো হয়। এমনকি বিচার প্রক্রিয়া সরাসরি প্রচার করা হয় এবং রায় প্রকাশের সরেজমিন প্রতিবেদন দেশি-বিদেশি গণমাধ্যমে সরাসরি প্রচার হয়। তারপরও যে দেশ (ভারত) থেকে হাসিনা রাজনীতি শুরু করেছিলেন সেই দেশে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে উচাটন শুরু হয়েছে। রায় ঘোষণার পর বাংলাদেশের কোটি কোটি মানুষ খুশি। মিষ্টির বন্যা বয়ে যাচ্ছে। জুলাই অভ্যুত্থানে হাসিনার নির্দেশে শহীদ পরিবারগুলো ভারত থেকে হাসিনাকে দেশে এনে ফাঁসির দাবিতে মিছিল করছে। অথচ ভারতের কিছু রাজনীতিক, কিছু সংবাদপত্রকর্মী হাসিনার মৃত্যুদ- নিয়ে অহেতুক মানসিক অস্থিরতা, ব্যাকুলতা ও উৎকষ্ঠা প্রকাশ করছেন। ‘মায়ের চেয়ে মাসির দরদ বেশি’ প্রবাদের মতো হাসিনা ন্যায়বিচার পায়নি প্রচারণা চালাচ্ছেন কলকাতার দাদারা। অবশ্য তাদের এই অস্থিরতার কারণও রয়েছে।
শেখ হাসিনা ১৫ বছর রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থেকে ভারতের স্বার্থরক্ষা করেছেন। বাংলাদেশকে দেউলিয়াপনার পর্যায়ে নিয়ে গিয়েও নরেন্দ্র মোদি গংদের খুশি করেছেন। যার জন্যই প্রধানমন্ত্রী থাকার সময় শেখ হাসিনা দম্ভ করে বলেছিলেন, ‘ভারতকে যা দিয়েছি তার জন্য ভারত চিরদিন আমাকে মনে রাখবে’। অপ্রিয় হলেও সত্য কথাই বলেছিলেন দিল্লির নাচের পুতুল শেখ হাসিনা। যার কারণে ভারতের কিছু উচ্ছিষ্টভোগী এবং গণমাধ্যম চক্র আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায় নিয়ে ‘হাসিনা ন্যায়বিচার পায়নি’ গণমাধ্যমে প্রচারণা চালাচ্ছেন। শুধু তাই নয়, হাসিনার অনুপস্থিতিতে মামলা পরিচালনা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন। শেখ হাসিনার হাতে হাজারো মানুষের রক্তের দাগ। জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশন দীর্ঘদিন তদন্ত করে শেখ হাসিনার নির্দেশে ১৪শ’ লোক হত্যা করা হয়েছে এমন তথ্য তুলে ধরেছেন। মানবতাবিরোধী অপরাধে যুক্ত থাকায় শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জাপান, কানাডা, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এমনকি সউদী আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো প্রবেশ করতে দেয়নি। নিষ্ঠুর খুনি হাসিনাকে তারা আশ্রয় দেয়নি। অথচ ভারত হাসিনাকে আশ্রয় দিয়েছে. পাশাপাশি দেশটি বাংলাদেশের জনগণের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে অস্থিরতা সৃষ্টির চেষ্টা করছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল হাসিনার মৃত্যুদ- দিলেও বিচার প্রক্রিয়া এখনো শেষ হয়ে যায়নি। শেখ হাসিনা চাইলে দেশে এসে ৩০ দিনের মধ্যে উচ্চ আদালতে আপিল করতে পারেন। বাংলাদেশ সরকারও ২০১৩ সালের বন্দি বিনিময় চুক্তি অনুযায়ী হাসিনাকে ফেরত চেয়েছে। ভারত হাসিনাকে ফেরত দিচ্ছে না এবং হাসিনাসহ শতাধিক খুনি-অপরাধীকে আশ্রয় নিয়ে উল্টো বিচার নিয়ে প্রশ্ন তুলছে। ভারত কী অপরাধী খুনিদের অভয়ারণ্য হয়ে গেছে? এটাই হচ্ছে হিন্দুত্ববাদী ভারতের চানক্যনীতি।
প্রশ্ন হলো ঢাকার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বদলে নেদারল্যান্ডসের হেগে অবস্থিত জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে শেখ হাসিনার বিচার হলে সেটা কী আরো স্বচ্ছ হতো? অথবা জার্মানির নুরেমবার্গ আদালতে? ইতিহাস কি বলে? ২০০১ সালে হেগের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে যুগোসøাভিয়ার কসাইখ্যাত সেøাবোদান মিলোসেভিচের বিচার শুরু হয়েছিল। মিলোসেভিচকে যুদ্ধাপরাধ, গণহত্যা এবং মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের জন্য অভিযুক্ত করা হয়। কিন্তু আদালত তার বিরুদ্ধে এই অপরাধ বিষয়ে নির্দেশনা সংক্রান্ত কোনো নথি ৫ বছরেও খুঁজে পায়নি। যদিও বিচার চলাকালে ২০০৬ সালের ১১ মার্চ তার মৃত্যুতে বিচারটি শেষ হয়।
১৯৪৬ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি ফিলিপাইনে ফাঁসি দেয়া হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কুখ্যাত জাপানি জেনারেল তোমোইকি ইয়ামাশিয়াকে। তার বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট কোনো হত্যাকা-ের অভিযোগ ছিল না। অভিযোগ ছিল অধিনস্থ সৈনিকদের হাত থেকে হত্যাকা- ঠেকাতে পারেননি। যুদ্ধকালে গণহত্যা, ধর্ষণ, অমানবিক অপরোধবোধ প্রতিরোধ করতে ব্যর্থ হয়েছেন। তার আইনজীবীরা আদালতে বলেছিল সৈন্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করার সুযোগ না থাকায় এমন ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু সে বক্তব্য আমলে নেয়নি আদালত। অপরাধের নির্দেশনা না দেয়া এবং সরাসরি জড়িত না থাকার পরও তোমোইকি ইয়ামাশিয়াকে মৃত্যুদ- দেয়া হয়েছে। তাহলে হেগ বা নুরেমবার্গে হাসিনার বিচার কেমন হতো? বিরোধীদের শিক্ষা দিতে শেখ হাসিনা ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টারের (এনটিএমসি) ডাটাবেইজ করেন। সেই এনটিএসসি থেকে উদ্ধার করা শেখ হাসিনার কয়েকটি কল রেকর্ড তাকে বিপদে ফেলে দেয়। এনটিএসসির তথ্য থেকে দেখা যায় আন্দোলন ঠেকাতে হাসিনা সরাসরি গুলির নির্দেশ দেন। শেখ হাসিনার নিকটাত্মীয় সাবেক মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ভিসি প্রফেসর মাকসুদ কামাল ও সাবেক মন্ত্রী হাসানুল হক ইনুর সঙ্গে ফোনালাপের এসব রেকর্ড রাষ্ট্রীয় সংস্থা (এনটিএমসি) ডাটাবেইজে দেখা যায়, তিনি আন্দোলন ঠেকাতে মরণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারের নির্দেশনা দেন।
১৯ জুলাই অজ্ঞাতনামা এক গোয়েন্দা কর্মকর্তার সঙ্গে ফোনালাপে শেখ হাসিনা বলেন, ‘র্যাব ও ডিজিএফআইকে বলা হয়েছে গুলি করে আন্দোলনকারীদের হত্যা করতে হবে। যেখানেই দেখা যাবে সেখানেই প্রাণঘাতী অস্ত্র দিয়ে গুলি করতে হবে। যেখানেই গ্যাদারিং (জমায়েত) দেখা যাবে, সেখানেই হেলিকপ্টার থেকে গুলি করতে হবে’। কথোপকথনের একপর্যায়ে ওই গোয়েন্দা কর্মকর্তা শেখ হাসিনাকে বলেন ‘আপনার নির্দেশনা লাগবে’। তখন শেখ হাসিনা বলেন ‘আমার নির্দেশনা দেওয়া আছে। যেখানে পাবে সোজা গুলি করবে। আমি এখন থেকে লেথাল উইপন (প্রাণঘাতী অস্ত্র) ব্যবহারের নির্দেশ দিয়ে দিয়েছি’। শেখ হাসিনাকে আরেক কল রেকর্ডে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস বলেন, ‘আন্দোলনকারীদের পাকড়াও করা যায় না’? জবাবে হাসিনা বলেন, ‘ওটা বলা আছে। ডিজিএফআই (প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তর) এবং সবাইকে বলা হয়েছে যেখানে যে কয়টাকে পাবা ধরে ফেল।’ আরেক ফোনালাপে শেখ হাসিনা হেলিকপ্টার ব্যবহার করে আকাশ থেকে গুলির নির্দেশনার কথা জানিয়ে বলেন, ‘যেখানে গ্যাদারিং দেখবে সেখানে ওই ওপর থেকে গুলি করবে। এখন ওপর থেকে করাচ্ছি। অলরেডি শুরু হয়ে গেছে। আমার নির্দেশনা দেওয়া আছে। একেবারে ওপেন নির্দেশনা দিয়ে দিয়েছি’। নেদারল্যান্ডসের হেগ আদালত এবং জার্মানির নুরেমবার্গ আদালতে এমন নির্ভেজাল প্রমাণ পেলে কী শেখ হাসিনাকে খালাস দিত?
লোককাহিনী ও হিন্দু পুরাণে এক ধরনের দানবীয় আত্মাকে ‘পিচাসিনী নারী’ বোঝানো হয়। একটি ভীতিপ্রদ এবং অশুভ সত্তা হিসেবে বিবেচিত হয় এই পিশাচিনী। শেখ হাসিনা তেমনি একজন পিশাচিনী নারী। এত বিপুল সংখ্যা মানুষ হত্যা, ঢাকার রাজপথ রক্তে রঞ্জিত করাসহ হাজারো পৈশাচিকতা এবং মানবাধিকার লংঘনের পরও সামান্য অনুশোচনাবোধ নেই। জুলুম-নির্যাতন করে গোটা দেশের মানুষকে ভিকটিম বানিয়েছিলেন। ভুক্তভোগী মানুষ বিপর্যস্ত। এখন ভুল স্বীকারের বদলে উল্টো হাসিনা নিজেই সকলকে বোকা বানিয়ে ‘ভিকটিম হুড় পলিটিক্স’ কার্ড খেলছেন। এখনো দিল্লিতে থেকে তিনি হুমকি- ধমকি দিচ্ছেন এবং পিসাচিনীর মতোই খুন-গুম করার হুমকি দিয়েই যাচ্ছেন। হাসিনা এমন নিষ্ঠুর পাষাণী যে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর তিনি পিতা-মাতার লাশ দেখার প্রয়োজনবোধ করেননি। স্বামীকে কাছে থাকতে দেননি। খুন-রক্ত দেখলে বেশি করে খাবার খেতেন। ভারতের দিল্লিতে থাকা অবস্থায় ১৯৮১ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগের ১২তম সম্মেলনে নেতাদের বিরোধ ঠেকাতে হাসিনাকে দলীয় সভাপতি করা হয়। ওই বছরের ১৭ মে তিনি দেশে ফেরেন। যার অনুকম্পায় দেশে ফিরে আসেন সেই জিয়াউর রহমানকে ১৩ দিনের মাথায় প্রাণ হারাতে হয়। আওয়ামী লীগের (বর্তমানে কার্যক্রম নিষিদ্ধ) সভাপতি হওয়ার সময় হাসিনা ভারতে ছিলেন। মানবতাবিরোধী অপরাধে ১৭ নভেম্বর মৃত্যুদ-ের রায়ের সময়ও তিনি ভারতে পলাতক। হাসিনা দীর্ঘ ৪৫ বছর ধরে বাংলাদেশে রাজনীতি করলেও তিনি সুবিধাবাদী চরিত্র হিসেবে চিহ্নিত। এরশাদের ‘নির্বাচনে অংশ নিলে জাতীয় বেঈমান হবে’ ঘোষণা দিয়ে তিনিই ১৯৮৬ সালে তৃতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলেন। গণআন্দোলনে এরশাদের পতনের পর ১৯৯১ সালে দেশে প্রথম অস্থায়ী সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত পঞ্চম সংসদ নির্বাচনে বিএনপি ক্ষমতায় গেলে হাসিনা সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা হিসেবে ঘোষণা দেন ‘একদিনের জন্য শান্তিতে থাকতে দেবো না’। জাতির কাছে ক্ষমা চেয়ে ১৯৯৬ সালের সপ্তম সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে প্রথমবার প্রধানমন্ত্রী হন। ২০০১ সালের অষ্টম সংসদ নির্বাচনে দলটির ভরাডুবি হয়। ২০০৬ সালের অক্টোবরে লগি-বৈঠা দিয়ে ঢাকার রাজপথ রক্তাক্ত করেন। ভারতের নীলনকশায় ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর বন্দি হলেও ভারতের সঙ্গে গোপন চুক্তির মাধ্যমে ২০০৯ সালের নবম সংসদ নির্বাচনে দ্বিতীয়বার প্রধানমন্ত্রী হন শেখ হাসিনা। ওই সরকার সংবিধান সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের প্রচলন শুরু করে। গোটা প্রশাসনযন্ত্রকে মাফিয়াতন্ত্রে পরিণত করেন। অতঃপর ২০১৪ সালে ‘প্রার্থী ও ভোটারবিহীন’, ২০১৮ সালে ‘নীশিরাতে’ এবং ২০২৪ সালে ‘আমি আর ডামি’ প্রার্থীর নির্বাচনের নামে পাতানো খেলার প্রতারণা করেন। ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করতে একদিকে গুম-খুন এবং ভয়ঙ্কর নিষ্ঠুরতা করেন; অন্যদিকে রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে ভারতের স্বার্থ রক্ষা করেন। গত বছর জুলাইয়ে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ওপর আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের (বর্তমানে নিষিদ্ধ) নেতা-কর্মীদের ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বর্বর হামলা চালায়। ৩৬ দিনের আন্দোলনে ১৪শ’ মানুষ হত্যা ও প্রায় ৩০ হাজার মানুষ আহত হয়। গণঅভ্যুত্থানের মুখে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ক্ষমতাচ্যুত হয়ে পালিয়ে ভারতে যান।
শেখ হাসিনা অন্যের জন্য গর্ত খুঁড়ে সে গর্তে নিজেই পড়ে গেছেন। বাংলাদেশকে সন্ত্রাসী ও মাফিয়াদের অভয়ারণ্যে পরিণত করার নেপথ্যের কারিগর শেখ হাসিনা কার্যত ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করতে এবং বিরোধী দলকে দমনে অপকা- করে ফাঁদে পড়েন। তিনি বিরোধী দলের নেতাদের নজরদারি করতে ইসরাইল থেকে নজরদারির আড়িপাতা যন্ত্রপাতি কিনেছিলেন। তার বিরুদ্ধে সেই যন্ত্রই ব্যবহৃত হয়েছে। তিনি বিরোধী দলের নেতাদের বিরুদ্ধে তথ্যপ্রমাণ সংগ্রহে ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টারের (এনটিএমসি) ডাটাবেইজ করেছিলেন। সেখান থেকেই তার ফোনালাপ, হত্যার নির্দেশনা সংক্রান্ত প্রমাণাদি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল সংগ্রহ করেছে। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেননি এবং মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান বাহিনীর সহায়তা নিয়েছেন শেখ হাসিনা। এমনকি মুক্তিযুদ্ধ চলার সময় কারাগারে থাকার কারণে তিনশ’ এমপির মধ্যে শেখ মুজিবুর রহমান ও ড. কামাল হোসেনের পরিবারকে পাকিস্তান সরকার মাসিক ১৫শ’ টাকা ভাতা দিয়েছে। মু্িক্তযুদ্ধের সময় পাকিস্তান সরকার থেকে ভাতা খাওয়া শেখ হাসিনা আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল প্রতিষ্ঠা করেন জামায়াতের নেতাদের বিচার করার জন্য। এখন নিজেই সেই ট্রাইব্যুনালে মৃত্যুদ-ে দ-িত হয়েছেন। মৃত্যুদ- মাথায় ঝুলে থাকায় হাসিনা আর ভারতের বাইরে যেতে পারবেন না। ভারত থেকে বের হলেই ইন্টারপোল তাকে গ্রেফতার করে বাংলাদেশে পাঠাবে। মানবতাবিরোধী অপরাধী হওয়ায় আগে কোনো দেশ আশ্রয় দেয়নি; এখন গ্রেফতারের ভয়ে ভারত থেকে বের হতে পারবেন না। অতএব হাসিনার রাজনীতি ভারতেই শুরু ভারতেই সমাপ্তি। এমন অভিশপ্ত জীবন কারো যেন না হয়। হাসিনার জীবন, রাজনীতি এবং অপকা-ের মৃত্যুদ- দেশের অন্য রাজনীতিকদের বার্তা বটে।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল শেখ হাসিনার মৃত্যুদ- রায় দেয়ার পর থেকে ভারতের গণমাধ্যমগুলো বাংলাদেশবিরোধী প্রচারণায় নেমেছে। হাসিনা ১৪শ’ মানুষ হত্যা করেছে সেটা তাদের কাছে কোনো ঘটনা নয়। ঘটনা হাসিনার অনুপস্থিতিতে বিচার এত দ্রুত হলো কেন? আবার আদালতের রায় ঘোষণার পর ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় একটি বিবৃতি দিয়েছে। বলা হয়, ‘সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিষয়ে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক ঘোষিত রায় আমাদের নজরে এসেছে। ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী হিসেবে বাংলাদেশের জনগণের সর্বোত্তম স্বার্থ শান্তি, গণতন্ত্র, অন্তর্ভুক্তি ও স্থিতিশীলতা অক্ষুণœ রাখতে ভারত প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এ লক্ষ্য অর্জনে আমরা সব অংশীজনের সঙ্গে সবসময় গঠনমূলকভাবে সম্পৃক্ত থাকব। প্রশ্ন হচ্ছে, সম্পর্ক রাখা দুই দেশের জন্য অপরিহার্য। কিন্তু বাংলাদেশ দ-প্রাপ্ত অপরাধী হাসিনাকে ফেরত চাইলেও দিল্লি দিচ্ছে না কেন?
ভারতের গণমাধ্যমের খবর দেখলে মনে হয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল হাসিনার মৃত্যুদ- দিয়ে অপরাধ করে ফেলেছে। বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে হাসিনার মৃত্যুদ-ের রায় নিয়ে ভারতের গণমাধ্যমের এতো আস্ফালন কেন?