ফেনীর মাস্টারপাড়ার পুকুর ঘাটলা দেশ জুড়ে পরিচিত। যে ঘাটলায় বসে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ফেনী নিয়ন্ত্রণ করতেন নিজাম উদ্দিন হাজারী। পুরো জেলার একক নিয়ন্ত্রণ ছিল নিজাম হাজারীর হাতে। ছিলেন জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। ফেনী-২ সদর আসনের সংসদ সদস্য। অবশ্য প্রতি উপজেলায় ছিল তার নিয়োগ করা ক্যাশিয়ার কাম ক্যাডার। এদের আবার নিয়মিত হাজিরা দিতে হতো আলোচিত এ ঘাটলায়। ফেনীতে সে সময় বলা হতো ঘাটলার শাসন। পুকুরের এ ঘাটলার পাশে সাততলা বাড়িটি নিজাম হাজারীর। এর একাংশ কার্যালয় হিসেবে ব্যবহার করতেন নিজাম হাজারী। গত বছর ৫ই আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের সঙ্গে সঙ্গে নিজাম হাজারীও পালিয়ে যান। অবসান ঘটে ঘাটলার শাসনের। এখন সেই ঘাটলায় সুনশান নীরবতা। কিন্তু ফেনী কি মুক্ত হয়েছে অপকর্ম থেকে? অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে সবই চলছে- তবে ধরন পাল্টেছে। টেন্ডারবাজি, লুটপাট, চাঁদাবাজি, ছিনতাই, চুরি, দখল আর হানাহানি বদলায়নি কোনো অংশে। রাজনৈতিক বিভাজন আর প্রশাসনের ছত্রছায়ায় সন্ত্রাসের জনপদ খ্যাত ফেনী বেরুতে পারছে না তার বদনাম থেকে।
ফেনীতে একসময় দাপট ছিল জেলা বিএনপি’র সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও ফেনী-২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য অধ্যাপক জয়নাল আবেদীন ওরফে ভিপি জয়নালের। ৫ই আগস্টের পর ফের তার উত্থান হবে- এমন শঙ্কা ছিল সর্বত্র। কিন্তু তিনি বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় থেকেই নীরব। ৫ই আগস্টের পর একলা চলো নীতিতে হাঁটছেন। দলীয় কর্মসূচিতে সবার মুরুব্বি হিসেবে যোগ দেন। কর্মসূচি শেষে নীরবেই বাসায় ফিরে যান। মূলত ২০০১ সালের নির্বাচনের পর থেকে তিনি অহিংস রাজনীতি করে যাচ্ছেন। বয়স আর রাজনৈতিক অবস্থানের কারণে কিছুটা ছন্নছাড়া একসময়ের প্রভাবশালী এ রাজনীতিবিদ। অথচ ফেনীতে এক সময় ছিল তার নিজস্ব বাহিনী। ছিল গডফাদার খ্যাতি। জয়নাল হাজারী আর ভিপি জয়নাল ছিলেন একে অপরের চির শত্রু। ফেনীর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে তাদের মধ্যে ছিল চির বৈরিতা। এখন জয়নাল হাজারী মারা গেছেন। ভিপি জয়নালও গুটিয়ে নিয়েছে নিজেকে। আর গত ষোল বছরের আতঙ্ক নিজামী হাজারী পলাতক।
এ অবস্থায় ফেনীবাসী হাফ ছেড়ে যেন বাঁচে। কিন্তু ক’দিন যেতে না যেতেই ফের আগের রূপে ফিরে যাচ্ছে ফেনী। তিন প্রভাবশালী নেতার শূন্যতা পূরণে এগিয়ে আসেন নতুনরা। তারাই এখন ফেনীর হর্তাকর্তা। সরজমিন দেখা গেছে ফেনীবাসীর মনে ফের আতঙ্ক দানা বাঁধছে। ফেনী এখন কারও একক নিয়ন্ত্রণে নেই। বিএনপিকে ঘিরে গড়ে উঠেছে অনেকগুলো গ্রুপ। যার নেতৃত্বে আছেন কেন্দ্রীয় ও জেলার অনেক নেতা। আর এসব গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে তৈরি হয়েছে উপজেলা ও পৌরসভা-ভিত্তিক সন্ত্রাসের মাস্টারমাইন্ড। এদের মনিটরিং করছেন শীর্ষ ক’জন নেতা। জেলা বিএনপি’র যুগ্ম আহ্বায়ক এয়াকুব নবীর সঙ্গে একসময় ছাত্রদল করা কয়েকজন রয়েছেন। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে তিনি ফেনীর সবচেয়ে বড় বাসটার্মিনাল মহিপাল গিলে খাচ্ছেন। টেন্ডারবাজিসহ বিভিন্ন খাত থেকেও একটা অংশ পাচ্ছেন তিনি। এসব এখন ফেনীর মানুষের মুখে মুখে। কিন্তু এ অভিযোগ অস্বীকার করে নবী দাবি করেন এ টার্মিনালের বৈধ ইজারাদার তিনি। নবীর মাথার উপর হাত বিছানো আছে বিএনপি’র কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির এক সদস্যের। জেলা বিএনপি’র যুগ্ম আহ্বায়ক গাজী হাবিব উল্যাহ মানিক নিয়ন্ত্রণ করেন আরেকটি গ্রুপ।
এদের মাধ্যমে তিনি মহিপাল টার্মিনাল ছাড়াও বিভিন্ন সরকারি উন্নয়ন কাজের টেন্ডারবাজির হিস্যা বুঝে নেন। তার সঙ্গে জেলা জামায়াতের সাবেক আমীর এ কে এম সামছুদ্দিনের ছেলে হামিম কাজ করছেন। এ হামিম শহরের কুমিল্লা বাসস্ট্যান্ড এলাকার আতঙ্ক। বাসস্ট্যান্ড এলাকার এক দোকানদার বলেন, হামিমকে সবাই চেনেন ‘ফিটিং ব্যবসায়ী’ হিসেবে। এর মানে তিনি কাউকে ট্যাপে ফেলা আবার গুরুকে দিয়ে সমাধান করাই হামিমের ব্যবসা। এ ব্যাপারে তিনি বলেন, নেতৃত্বে প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করে অনেকেই তার বিরুদ্ধে মিথ্যাচার করছে।
জেলা বিএনপি’র আরেক যুগ্ম আহ্বায়ক আনোয়ার হোসেন পাটোয়ারীর নেতৃত্বে রয়েছেন একাংশের নেতাকর্মী। এলাকার বেশ কয়েকজন জানান, তিনি ৫ই আগস্টের পর জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হাজী আলাউদ্দিন ও তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রক্ষায় ভূমিকা রেখে ফেনীতে এখন বিতর্কিত। এ ছাড়া টেন্ডার বাণিজ্য ও বিভিন্ন খাতের চাঁদাবাজির ভাগ পাচ্ছেন নিয়মিত। জেলা যুবদলের আহ্বায়ক খন্দকার নাছির উদ্দিনও জেলা শহরের কিছু এলাকা নিয়ন্ত্রণ করেন। তার অনুসারীরাও চাঁদাবাজি ও দখলের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। যদিও নাছির উদ্দিন এ ব্যাপারে বলেছেন, তিনি কোনো অবৈধ আয়ের খাত চিনেন না।
এদিকে, ৫ই আগস্টের পর দাগনভূঞা উপজেলায় মিনি গডফাদার হিসেবে পরিচিতি পেয়েছেন জেলা ছাত্রদলের বহিষ্কৃত নেতা জামশেদুর রহমান ফটিক। তার বিরুদ্ধে দখল, চাঁদাবাজি, হামলা-নির্যাতন সহ রয়েছে অনেক অভিযোগ। তার নিয়ন্ত্রণে রয়েছে কিশোর গ্যাং। আওয়ামী লীগ আমলের কিশোর গ্যাং এখন ফটিকের আশ্রয়ে। এসব অভিযোগে ছাত্রদল থেকে বহিষ্কার করা হয় তাকে। দাগনভূঞা পৌর শহরের আলীপুর, চৌধুরীহাট ও বসুরহাট সড়ক ঘিরেই মূলত তার রাজত্ব। এরমধ্যে শহরের সব সড়কের ফুটপাথ নিয়েছেন নিয়ন্ত্রণে। সবশেষ দক্ষিণ আলীপুর রোডে মাহফুজ নামে একজনের দালানঘর দখল করেছেন ফটিক। সরওয়ার নামে আরেকজনের ফ্ল্যাটে তালা দিয়ে এক লাখ টাকা আদায় করেছেন। মনির নামে আরেক ভবন মালিককেও টাকা দিতে হয়েছে ফটিক বাহিনীকে। আজাদ নামে আরেক প্রবাসীর দু’টি বহুতল ভবন রয়েছে নামাবাজারে। তার কাছে ফটিক মোটা অঙ্কের টাকা চাঁদা দাবি করায় ফেসবুক অ্যাকাউন্টে ভবন বিক্রির ঘোষণা দিয়েছেন আজাদ। ফটিকের থাবা থেকে বাদ পড়েনি নিজ দলের নেতাকর্মীরাও।
সোনাগাজীর মিনি গডফাদার হিসেবে জেলাব্যাপী খুব আলোচিত উপজেলা যুবদলের সভাপতি খুরশিদ আলম। তার বড় ভাই সৈয়দ আলম উপজেলা বিএনপি’র সদস্য সচিব। ৫ই আগস্টের পর আওয়ামী লীগ নেতাদের নিয়ন্ত্রণে থাকা সব অবৈধ আয়ের খাত এখন খুরশিদের নিয়ন্ত্রণে। স্থানীয়রা অভিযোগ করেন কিছুদিন আগেও সোনাগাজী থানা ছিল খুরশিদের শাসন কেন্দ্র। লোকজনকে ধরে এনে থানায় আটকে রেখে চাঁদা আদায় করতো। দখল বাণিজ্যেও খুরশিদের পেছনে ছিল পুরো জেলার মিনি গডফাদাররা। জেলার একমাত্র উপকূলীয় এ উপজেলায় আছে কয়েক হাজার মৎস্য খামার। এসব খামার একসময় নিয়ন্ত্রণ করতেন নিজাম উদ্দিন হাজারী, ফেনী সদর উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান সুশেন চন্দ্র শীল, সোনাগাজী পৌর মেয়র রফিকুল ইসলাম খোকন।
ফেনী-১ আসন (পরশুরাম- ফুলগাজী) ও ফুলগাজী উপজেলা নিয়ন্ত্রণ করছেন ঢাকা দক্ষিণ বিএনপি’র শীর্ষ এক নেতা। তার ছত্রছায়ায় পরশুরামের নিয়ন্ত্রক এখন সাবেক পৌর মেয়র ও বিএনপি নেতা আবু তালেব। তিনি বালুমহাল নিয়ন্ত্রণসহ চাঁদা, দখল বাণিজ্যের অধিপতি। তার একক রাজ্যে হানা দিয়ে আরেক গ্রুপ তৈরি করেন উপজেলা বিএনপি’র যুগ্ম আহ্বায়ক আবদুল আলিম মাকসুদ। মূলত এ দু’জনই ৫ই আগস্টের পর উপজেলার দখল, চাঁদাবাজি, টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ করছেন। সাধারণ মানুষ তাদের বাহিনীর কাছে জিম্মি। এ উপজেলায় জামায়াত নেতা কাউছারও জায়গা বুঝে কোপ দিচ্ছেন আর ভাগ বসাচ্ছেন অবৈধ আয়ের খাতগুলোতে। এমন অভিযোগ দীর্ঘদিনের।
ছাগলনাইয়া উপজেলা বিএনপি’র সদস্য সচিব ও সাবেক পৌর মেয়র মোহাম্মদ আলমগীর ৫ই আগস্টের পর অবৈধ সব আয়ের খাতে হাত বসিয়েছেন। তার আয়ে ভাগ বসিয়েছেন উপজেলা বিএনপি’র সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক কফিল উদ্দিন সরকার। উপজেলা যুবদলের আহ্বায়ক কাজী জসিম উদ্দিনও এসব কাজে ভাগ বসিয়েছেন।