Image description
 

আওয়ামী লীগের দীর্ঘ শাসনামলে বিরোধী মতের লোকদের গুম করে র‌্যাবের টাস্কফোর্স ইন্টারোগেশন (টিএফআই) ও জয়েন্ট ইন্টারোগেশন সেন্টারে (জেআইসি) বন্দি রেখে নির্যাতনের অসংখ্য অভিযোগ রয়েছে।

এসব ঘটনায় মানবতাবিরোধী অপরাধের দুই মামলায় গত ৮ অক্টোবর আনুষ্ঠানিক অভিযোগ আমলে নিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। এ দুই মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে প্রধান করে ৩০ জনকে আসামি করা হয়েছে। আসামিদের মধ্যে সাবেক-বর্তমান মিলিয়ে প্রায় ২৫ জন সেনা কর্মকর্তার নাম রয়েছে। যাদের মধ্যে ১৫ জনকে হেফাজতে রাখার কথা জানিয়েছে সেনাবাহিনী।

মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের গ্রেফতারি পরোয়ানাভুক্ত ১৫ সেনা কর্মকর্তাকে সেনা হেফাজতে নেওয়ার ঘোষণার পরদিনই ঢাকা সেনানিবাসের একটি ভবনকে অস্থায়ী বা সাময়িকভাবে কারাগার হিসেবে ঘোষণা করেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এসব বিষয় নিয়ে চলছে নানা আলোচনা-সমালোচনা। উঠেছে বিভিন্ন প্রশ্ন।

সেনানিবাসের বিশেষ কারাগারে এসব সেনা কর্মকর্তাকে রাখার বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন। সেনা কর্মকর্তাদের বর্তমান অবস্থান “গ্রেফতার” নাকি “আটক” হবে তা নিয়ে দ্বিধা তৈরি হয়েছে।

হেফাজতে নেওয়া ১৫ সেনা কর্মকর্তার স্ট্যাটাস কী হবে তা জানতে চাইলে চিফ প্রসিকিউটর বলেন, ‘আমাদের কাছে যেহেতু আনুষ্ঠানিকভাবে কেউ বলেনি যে তাদের আটক রাখা হয়েছে, তাই মিডিয়াতে যা এসেছে, সেটিকে আমরা আমলে নিচ্ছি না। আমাদের যদি বলা হয় যে তাদের আটক রাখা হয়েছে, তাহলে অবশ্যই ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আদালতের কাছে আনতে হবে, এটাই বিধান। যেহেতু আমরা জানি না, সুতরাং এ বিষয়ে আমি কোনও মন্তব্য করতে চাই না।’

গত ১২ অক্টোবর সেনাবাহিনীর অ্যাডজুট্যান্ট জেনারেল মেজর জেনারেল মো. হাকিমুজ্জামান এক সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছিলেন, অভিযুক্ত কর্মরত সেনা কর্মকর্তাদের নিরাপদ একটি স্থানে রাখা হয়েছে। পরিবার থেকেও আলাদা করা হয়েছে। আইন অনুযায়ী তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আর অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের বিষয়ে পুলিশ আইনগত ব্যবস্থা নেবে।

তবে সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী ও গণফোরামের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি সুব্রত চৌধুরী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আটককৃতদের পুলিশের হাতে দিতে হবে বা আদালতের কাছে পাঠাতে হবে। অতীতেও দেখেছি, বিশেষ কিছু ক্ষেত্রে, যেমন- হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ, বেগম খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনাকে গেজেট করে সাব-জেল ঘোষণা করে রাখা হয়েছিল। নিরাপত্তার স্বার্থে এটা করা যেতে পারে। কিন্তু তারা (সেনাবাহিনী) এটা করতে পারেন না। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে হ্যান্ডওভার করতে হবে। বিচারকাজের ক্ষেত্রে তাদের হস্তান্তর করতে হবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমার কথা হলো ওইসব আর্মি অফিসারদের পুলিশের মাধ্যমে আদালতে হাজির করতে হবে। সেটি যেহেতু এখনও করেনি, সেহেতু এখানে আইনের ব্যত্যয় ঘটছে।’

এদিকে পতিত কর্তৃত্ববাদী শাসনামলে সংঘটিত গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও নির্যাতনের অভিযোগে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে অভিযুক্ত কর্মকর্তাদের সেনা হেফাজতে রাখার সিদ্ধান্ত সাংবিধানিক অঙ্গীকার ও আইনের সমান প্রয়োগের মানদণ্ডে প্রশ্নবিদ্ধ বলে মনে করছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। সংস্থাটি এ নিয়ে উদ্বেগও প্রকাশ করেছে।

মঙ্গলবার (১৪ অক্টোবর) এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ উদ্বেগ প্রকাশের পাশাপাশি “বৈষম্যমূলক” এই সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছে টিআইবি। মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত সেনা কর্মকর্তাদের ঠিক কোন বিবেচনায় ও যুক্তিতে অন্য অভিযুক্তদের থেকে পৃথক ব্যবস্থাপনায় রাখার সিদ্ধান্ত হয়েছে, সে বিষয়ে সরকারের ব্যাখ্যা জানতে চেয়েছে সংস্থাটি।

সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, “মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্তদের বিচার প্রক্রিয়ায় ব্যক্তির পেশাগত পরিচয় বা পদমর্যাদা বিবেচনায় নেওয়ার কোনও সুযোগ নেই। এভাবে কাউকে বিশেষ সুযোগ-সুবিধা প্রদান বা মূল্যায়ন, ন্যায়বিচারের পরিপন্থি।”

অন্য অভিযুক্ত ব্যক্তিরা যদি যথানিয়মে বেসামরিক কর্তৃপক্ষের নিয়ন্ত্রণাধীন ব্যবস্থায় কারা হেফাজতে থাকতে পারেন, তাহলে অভিযুক্ত সেনা কর্মকর্তাদের জন্য আলাদাভাবে বিশেষায়িত সাব-জেলের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্নও তুলেছেন ইফতেখারুজ্জামান। তিনি বলেছেন, “সরকারের এই বৈষম্যমূলক আচরণ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচার প্রক্রিয়াকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে, যা ভুক্তভোগী ও তাদের পরিবারসহ জনমনে সরকারের উদ্দেশ্য নিয়ে বিভ্রান্তির ঝুঁকি সৃষ্টি করবে।” বিচার প্রক্রিয়ার নিরপেক্ষতা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার আহ্বানও জানিয়েছেন তিনি।

তবে বিষয়টি নিয়ে ভুল বোঝাবুঝি হচ্ছে বলে মনে করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার এম. সরোয়ার হোসেন। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমার মনে হয় বিষয়টি নিয়ে সবার মাঝে একটু ভুল বোঝাবুঝি হচ্ছে। অবশ্য সবার সব আইন বোঝারও কথা না। মূলত সেনা আইন অনুসারে সেনাবাহিনী চাইলে তাদের কোনও কর্মকর্তা-কর্মচারীকে কোথাও অ্যাটাচ (সংযুক্ত) করতে পারে। তাই বলে এটা কিন্তু গ্রেফতার না। এটা আইনগতভাবেই হয়। আর বাহিনীর এসব সদস্য মূলত বাংলাদেশে দ্যা আর্মি অ্যাক্ট ১৯৫২ এবং অল আদার সিভিল ল’ দ্বারা পরিচালিত হয়ে থাকেন। সুতরাং আর্মি আইনের অধীনেই তাদের আটক রাখা হয়েছে। এটা অবশ্যই প্রশংসনীয় উদ্যোগ। এর মানে হলো, আইন মান্য করার প্রথম বিধান (গ্রেফতারের পূর্বে)।’

সাবেক এই সেনাসদস্য ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী আরও বলেন, ‘চূড়ান্তভাবে অপরাধী না হলে কাউকে গিলটি (দোষী) বলা যাবে না, যতক্ষণ না অভিযুক্ত হবে। আমি মনে করি, তাদের আর্মি অ্যাক্টে বিচার হতে পারতো। কোর্ট মার্শাল করতে পারতো। এখানে অনেকেই সাজাপ্রাপ্ত হন। এখানে কোনও অতিরিক্ত সুবিধা দেয়া হয়েছে তা নয়।’

তিনি আরও বলেন, ‘আর্মি যে কাজটা করেছে তা নিয়ে সমালোচনা না করে প্রশংসা করা উচিত ছিল। এই বাহিনীকে নিয়ে এ দেশে যত নিন্দামন্দ করা হয় বা তাদের নিয়ে কথা বলা হয়, তা অন্য কোনও দেশে হয় না। কোনও ব্যক্তি অপরাধ করলে তাকে নিয়ে সমালোচনা করা উচিত, কিন্তু তা না করে পুরো বাহিনীকে নিয়ে সমালোচনা করাটা ঠিক না।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমি মনে করি ট্রাইব্যুনাল হলো যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য গঠিত। তারা যদিও তদন্ত করেছে, তদন্ত করে তা আর্মিদের কাছে পাঠানো উচিত ছিল। তারা তা না করে পাবলিকলি যা-তা বলে বেড়াচ্ছে। সংবিধানের ২৭ অনুচ্ছেদে আইনের দৃষ্টিতে সবাইকে সমতা দেওয়া হয়েছে। সুতরাং ট্রাইব্যুনালে সেনাদের বিচার সাংঘর্ষিক বলে মনে করছি। এগুলো নিয়েও প্রশ্ন উঠবে, অনেকেই বলবে এরাও আওয়ামী রেজিমের মতোই কাজ করছে।’

বাংলাদেশ সংবিধানের ২৭ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী বলেও উল্লেখ করেন তিনি।

মানবাধিকারকর্মী ও সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এ পর্যন্ত সংবাদমাধ্যম থেকে প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণ করে যা বুঝতে পেরেছি, ট্রাইব্যুনাল কয়েকজন সেনা কর্মকর্তার বিষয়ে গ্রেফতারি পরোয়ানা দিয়েছে কিন্তু সেনাবাহিনী সংবাদ সম্মেলন করে জানিয়েছে- তারা এখনও পরোয়ানা পায়নি, তবে তারা নাম আসা সেসব কর্মকর্তাকে হেফাজতে নিয়েছে। এরপর সরকার ক্যান্টনমেন্টের একটি বাড়িকে সাব-জেল হিসেবে ঘোষণা করেছে। এটা সরকার করতে পারে। আইনত করা যায়। শেখ হাসিনাকেও এভাবে সাব-জেল করে আটক রাখা হয়েছিল। যা জেনেছি, ট্রাইব্যুনালে নির্ধারিত তারিখে ওই সেনা সদস্যদের হাজিরের কথা রয়েছে। দেখতে হবে সেদিন তারা হাজির করেছে কিনা। তবে এখন পর্যন্ত সেনাবাহিনী এমন কিছু বলেনি, যা দ্বন্দ্ব তৈরি করছে।’