Image description

বিগত দুই দশকের মধ্যে এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফলাফলে ধস নেমেছে এবার। ২০০৫ সালে পাবলিক এই পরীক্ষায় পাসের হার ছিল ৫৯.১৬ শতাংশ। এরপর থেকে প্রায় প্রতিবছরই পাসের হার বেড়েছে কিংবা সামান্য কমবেশি হয়েছে। এবার ১১টি শিক্ষাবোর্ডে পাসের হার ৫৮.৮৩ শতাংশ। এর চেয়ে কম পাসের হার ছিল ২১ বছর আগে ২০০৪ সালে, সেই বছর পাস করেছিলেন ৪৭.৭৪ শতাংশ পরীক্ষার্থী। এবার শুধু পাসের হার নয়, জিপিএ ফাইভসহ ফলের সব সূচকেই ধস নেমেছে। আজ বৃহস্পতিবার (১৬ অক্টোবর) প্রকাশিত ২০২৫ সালের এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা ফলাফল বিশ্লেষণ করে এমন তথ্য পাওয়া গেছে।

এই ফল ধসের নেপথ্যে রয়েছে একাধিক কারণ। তবে পরীক্ষায় সৃজনশীল প্রশ্নগুলো পুনরাবৃত্তি না করার পাশাপাশি প্রশ্নের ধরণ নির্ধারিত কাঠামো অনুসরণ করা হয়েছে। যার ফলে বেশিরভাগ শিক্ষার্থী পূর্ণাঙ্গ বা বিশ্লেষণধর্মী উত্তর দিতে পারেনি। এছাড়াও, খাতা মূল্যায়নে কড়াকড়ি ও গ্রেস নম্বর দেওয়ার সুযোগ না রাখাও ছিল আরেকটি কারণ। তাছাড়া তিনটি শিক্ষাবোর্ডে রেকর্ড পরিমাণে ফল ধস ও ২০২০ সালে করোনার পর পূর্ণ বিষয়, সিলেবাস ও নম্বরের ওপর পরীক্ষা নেওয়ায় ফলে সার্বিকভাবে ধস নেমেছে। এ কারণে পাসের হার এবং জিপিএ-৫ প্রাপ্তিতে ধস নেমেছে।

শিক্ষা সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছে, আগের সময়ে খাতা মূল্যায়নের নমনীয় নির্দেশনা তুলে দেওয়ায় ফলে এমন ধস হয়েছে। ফলে দেশের শিক্ষার মান যে তলানিতে সেটা ফুটে উঠেছে। তবে কেন এমন হয়েছে, সেটি নিয়ে গবেষণা ও বিচার-বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন। তাদের মতে, ৫ লাখের বেশি শিক্ষার্থী ফেল করা কাঙ্ক্ষিত নয়, যা জাতির জন্য শুভকর নয়।

এবারের ফলাফল বিশ্লেষণে দেখা যায়, ফলে রেকর্ড পরিমাণে ধস নেমেছে সিলেট শিক্ষা বোর্ড। এ বোর্ডে পাসের হার ৫১.৮৬ শতাংশ, যা গতবারের চেয়ে প্রায় ২৪ শতাংশ কম। গতবার পাসের হার ছিল ৮৫.৩৯ শতাংশ। অন্যদিকে, এবারের ফলাফলে সবচেয়ে কম পাসের হার দেখা গেছে কুমিল্লা বোর্ডে। সেখানে পাস করেছে ৪৮.৮৬ শতাংশ শিক্ষার্থী। গতবার এ বোর্ডে পাসের হার ছিল ৭১.১৫ শতাংশ। তবে সব বোর্ডের ফল ধসের রেকর্ড ছাড়িয়েছে কারিগরি শিক্ষাবোর্ডে। এ বোর্ডে এবার পাসের হার কমেছে ২৬ শতাংশের বেশি। সেখানে পাস করেছে ৬২.৬৭ শতাংশ শিক্ষার্থী। গতবার এ বোর্ডে পাসের হার ছিল ৮৮.০৯ শতাংশ।

শিক্ষার্থীদের গ্রুপ ভিত্তিক পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, এবারের এইচএসসির ৯টি বোর্ডে বিজ্ঞান বিভাগে পাসের হার সবচেয়ে বেশি। যা ৭৮.৭২ শতাংশ, যা গতবার ছিল ৯১.৩৩ শতাংশ। এবার ব্যবসায় শিক্ষায় পাসের হার ৫৫.৫৮ শতাংশ, আর মানবিকে সবচেয়ে কম ৪৮.২৩ শতাংশ।

সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, ফল ধসের এমন হওয়ার পেছনে মূল কারণ হলো করোনার পর প্রথমবারের মতো পূর্ণ সিলেবাসে ফেরা ও মূল্যায়নে কঠোরতা। করোনাকাল ও পরবর্তী বছরগুলোতে সংক্ষিপ্ত সিলেবাস ও নমনীয় মূল্যায়নের কারণে শিক্ষার্থীরা তুলনামূলক সহজভাবে ভালো ফল পেয়েছিল। কিন্তু এবার দীর্ঘ সময় পর সম্পূর্ণ সিলেবাসে পরীক্ষা ও কঠোর মানদণ্ডে মূল্যায়ন হওয়ায় অনেকেই প্রস্তুতিতে ঘাটতি কাটিয়ে উঠতে পারেনি। আবার বিগত কয়েক বছর ধরে করোনাজনিত সংকট ও সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে পরীক্ষার ফলে পাসের হার অস্বাভাবিকভাবে বেড়েও গিয়েছিল।

 

অতীতে এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষায় প্রতি বছর পাসের হার ও জিপিএ ৫ বাড়ার প্রবণতা নিয়ে শিক্ষাবিদেরা নানা সময়ে উদ্বেগ জানিয়েছিলেন। অনেক সময় অভিযোগ উঠেছিল, শিক্ষকদের নির্দেশ দেওয়া হতো নম্বর বাড়িয়ে দিতে। সেসব অভিযোগ সত্ত্বেও সরকার ব্যবস্থা নেয়নি; কিন্তু এবারের এসএসসির পর এইচএসসিতে ফলাফল সেই ধারার বাইরে, যেখানে ফলাফলের সব কিছুই হয়েছে কঠোর মূল্যায়নের ভিত্তিতে।

মোহাম্মদ গোলাম মোস্তফা নামে এইচএসসির খাতা মূল্যায়নকারী এক শিক্ষক দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ২০১৪ সালের এইচএসসি পরীক্ষায় সৃজনশীল পদ্ধতিতে পুরোদমে শুরু হয়। এরপর থেকে এবারই স্ট্যান্ডার্ড প্রশ্ন করা হয়েছে। অর্থাৎ, সৃজনশীল পদ্ধতি যেভাবে প্রশ্ন প্রণয়ন করা দরকার সেটির স্ট্যান্ডার্ড এবার বজায় রাখা হয়েছে।

তিনি বলেন, এবার খাতা মূল্যায়নে কড়াকড়ি ও গ্রেস নম্বর দেওয়ার সুযোগ ছিল না। বিগত সময়ে আমরা দেখেছি, এই ফলটায় জাতীয় রাজনীতির প্রভাব ছিল। এতে করে কিছু লিখলেই নাম্বার দেওয়া হতো। কিন্তু সেটি এবার দেওয়া হয়নি। ধরুন উত্তরপত্রে একটি প্রশ্নের উত্তর লিখছে কিছুটা ধারণা করে। যা যথাযথ হয়নি। আগে সেটায় কিছু নম্বর হলেও দেওয়ার আদেশ থাকতো। তবে এবার ধারণা করে উত্তর লেখায় নম্বর দেওয়া হয়নি। এছাড়া ৬৭ কিংবা ৬৯ নম্বর পেলে গ্রেস দিয়ে ৭০ করে দেওয়া সেটি এবার করা হয়নি।

ঢাকা সিটি কলেজের অধ্যক্ষ (ভারপ্রাপ্ত) অধ্যাপক কাজী নিয়ামুল হক দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, শিক্ষার্থীরা পড়াশোনায় অমনোযোগী। ফলে তার প্রভাব পড়েছে। তাছাড়া ফল মূল্যায়নে কঠোরতা ছিল, যার কারণে ফলে সার্বিকভাবে ধস নেমেছে।

যাত্রাবাড়ির দনিয়া কলেজ থেকে ব্যবসায় শিক্ষায় এবার এইচএসসি পাস করা নাদিয়া আক্তার দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, এবার প্রশ্নের কাঠামো খুব কঠিন হয়েছে। যার ফলে প্রশ্নে রিপিট না হওয়ার পাশাপাশি নতুনত্বও এসেছে। সেজন্য অনেকেই প্রশ্নের উত্তর দিতে হিমশিমের মধ্যে পড়েছে।

তিনি আরও বলেন, এবার গ্রেস নম্বর দেওয়ার সুযোগ রাখা হয়নি। আমি একটি বিষয়ে ৭৯ নম্বর পেয়েছি। মাত্র এক নম্বরের জন্য বিষয়টিতে জিপিএ-৫ মিস করেছি। এর আগে গ্রেস নম্বর দেওয়ার সুযোগ ছিল। তখন আমি ঠিকই জিপিএ-৫ পেতাম।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ড. সিদ্দিকুর রহমান বলেন, আগের সময়ে সম্ভবত খাতা মূল্যায়নের ক্ষেত্রে কিছুটা নমনীয় নির্দেশনা ছিল, যার ফলে ভালো ফলাফল দেখা গিয়েছিল। তেমন নির্দেশনা থাকলে তা জাতির জন্য ক্ষতিকর ছিল। আগে অনেকেই ৩০ বা ৩১ নম্বর পেলে বিশেষ বিবেচনায় পাশ করিয়ে দেওয়ার রীতি ছিল, ফলে পাশের হার বেশি হতো। এখন যে ফলাফল এসেছে, সেটাই বাস্তব ফল। তবে পাশের হারে এত বড় পার্থক্যের কারণ নিয়ে গবেষণা করা জরুরি।

আন্তঃশিক্ষা বোর্ড সমন্বয় কমিটির চেয়ারম্যান অধ্যাপক খন্দোকার এহসানুল কবির বলেন, বেশি নম্বর দিয়ে পাসের হার বাড়ানোর কোনো নির্দেশনা সরকার, মন্ত্রণালয় বা বোর্ড থেকে উত্তরপত্র মূল্যায়নকারীদের দেওয়া হয়নি। উত্তরপত্র মূল্যায়নের যে নিয়ম আছে, আমরা পরীক্ষকদের সেগুলো স্মরণ করিয়ে দিয়েছি যে, আপনারা জানেন কীভাবে খাতা দেখতে হয়। দীর্ঘ বছরের অভিজ্ঞতা আছে, সেই অভিজ্ঞতায় যদি কোনো বদঅভ্যাস থাকে যে, সামান্য লিখলে ভুল হলেও ১-২ নম্বর দেওয়া, সেগুলো দেওয়ার দরকার নেই।

তিনি আরও বলেন, এতে তারাও আমাদের সাথে একমত হয়েছেন। তারাও বেশ খুশি। তারা বলেছেন, তারা একটা ভালো খাতা মূল্যায়নের সুযোগ পেয়েছেন।

শিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. চৌধুরী রফিকুল আবরার বলেন, আমি সকল শিক্ষা বোর্ডকে নির্দেশ দিয়েছি— যেন ভবিষ্যৎ পরীক্ষায়, বিশেষ করে এইচএসসি মূল্যায়নে, সীমান্তরেখায় থাকা শিক্ষার্থীদের প্রতি সর্বোচ্চ ন্যায্যতা বজায় রাখা হয়, কিন্তু একই সঙ্গে যেন ফলাফলের বাস্তবতা বিকৃত না হয়। আমরা ‘অতিরিক্ত নম্বর দিয়ে সন্তুষ্টি’ নয়, বরং ‘ন্যায্য নম্বর দিয়ে সততা’কে বেছে নিয়েছি। এই সিদ্ধান্ত সহজ নয়, কিন্তু প্রয়োজনীয়। কারণ আজ যদি আমরা সাহস করে বাস্তবতা স্বীকার না করি তাহলে মেধাবীদের প্রতি এবং আগামী প্রজন্মের প্রতি আমরা অন্যায় করব।

দেশের শিক্ষার্থীর স্বার্থ রক্ষাকারী অভিভাবকদের সংগঠন অভিভাবক ঐক্য ফোরাম এর সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. জিয়াউল কবির দুলু বলেন, ফুলিয়ে ফাপিয়ে বেশি নম্বর এ বছর দেয়া হয়নি, গ্রেস মার্ক দেয়া হয়নি এবং রাজনৈতিক বিবেচনায় ও তদবিরে অযোগ্য ব্যক্তিদেরকে শিক্ষা প্রশাসনে পদায়ন করায় বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ না নিতে পারাই পরীক্ষায় ফলাফলে ধস নেমেছে।

তিনি বলেন, ২০ বছরের ইতিহাসে এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় এটা খুবই খারাপ ফল। শিক্ষার মান তলানিতে। বেসরকারি স্কুল-কলেজে শিক্ষকরা ঠিক মতো ক্লাস নেন না ।সরকারি কলেজেও চলছে স্বেচ্ছাচারিতা। কোথাও সেভাবে পড়াশোনা হয় না। বেশির ভাগ শিক্ষার্থী কোচিং নির্ভর, কোচিংয়েও পড়াশোনা হয় না।শহরের চেয়ে গ্রামের স্কুল কলেজের ফলাফল বেশি খারাপ। ৫ লাখের বেশি শিক্ষার্থী ফেল করা কাঙ্ক্ষিত নয়। কাঙ্ক্ষিত ফলাফল কেন হচ্ছে না তা খুঁজে বের করে ইতিবাচক চিন্তা করা প্রয়োজন।

বিগত ২০ বছরের ফলাফলের পরিসংখ্যান
২০০৪ সালে ৪৭.৭৪ শতাংশ, ২০০৫ সালে ৫৯.৭৪ শতাংশ, ২০০৬ সালে ৬৩.৯২ শতাংশ, ২০০৭ সালে ৬৪.২৭ শতাংশ, ২০০৮ সালে ৭৬.১৯ শতাংশ, ২০০৯ সালে ৭২.৭৮ শতাংশ, ২০১০ সালে ৭৪.২৮ শতাংশ, ২০১১ সালে ৭৫.০৮ শতাংশ, ২০১২ সালে ৭৮.৬৭ শতাংশ, ২০১৩ সালে ৭৪.৩০ শতাংশ, ২০১৪ সালে ৭৮.৩২ শতাংশ, ২০১৫ সালে ৬৯.৬০ শতাংশ, ২০১৬ সালে ৭২.৪৭ শতাংশ, ২০১৭ সালে ৬৮.৯০ শতাংশ, ২০১৮ সালে ৬৬.৬৪ শতাংশ, ২০১৯ সালে ৭৩.৯৩ শতাংশ, ২০২০ সালে ৯৯ .৯০ শতাংশ, ২০২১ সালে ৯৫.২৬ শতাংশ, ২০২২ সালে ৮৫.৯৫ শতাংশ, ২০২৩ সালে ৭৮.৬৪ শতাংশ এবং ২০২৪ সালে ৭৭.৭৮ শতাংশ শিক্ষার্থী এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় পাস করেছেন।