Image description
তারেক রহমানের উপস্থিতিতে দেশেই হবে প্রার্থী চূড়ান্ত

শীঘ্রই তারেক রহমান দেশে আসছেন। ভোটের সময় জনগণের পাশে থাকবেন। সম্প্রতি এমন বার্তা দেওয়া হয়েছে। নির্বাচনের বাকি চার মাসেরও কম সময়। তফসিল ঘোষণা করা হতে পারে ডিসেম্বরে। তবে বিএনপি নেতা তারেক রহমানের দেশে আসার বিষয়ে কোনো চূড়ান্ত দিনক্ষণ জানাতে পারেনি দলটি। ফ্যাসিস্ট হাসিনা দেশ থেকে পালিয়ে যাওয়ার পর বাংলাদেশের বড় দল বিএনপির শীর্ষ দুই নেতা খালেদা জিয়া এবং তারেক রহমান দুজনই সরাসরি জনসম্মুখের রাজনীতি থেকে দূরে রয়েছেন।

এমন প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী একাই রাজনীতির মাঠ গরম রেখেছে। দেশের তিনশ’ আসনে একক প্রার্থী ঘোষণা করে জনসংযোগ, দলীয় কর্মসূচি দিয়ে ভোটের মাঠে দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন। দলের প্রার্থীর পক্ষে ভোট চেয়ে ভোটারদের দুয়ারে দুয়ারে যাচ্ছেন। দীর্ঘ সময় ধরে দলটির ছাত্রসংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবির, ছাত্রী সংস্থা, মহিলা জামায়াতসহ পেশাজীবীদের অনেকেই প্রকাশ্যে কর্মসূচি পালন করতে পারেনি। পাঁচ আগস্টের পর থেকে দলটির সবাই রাজনীতিতে বড় আধিপত্য বিস্তার করে যাচ্ছেন বলে রাজনৈতিক বিশেজ্ঞরা মনে করছেন।

রাজনীতিতে চোখ রাখা সংশ্লিষ্টরা বলছেন, তারেক রহমান এবং খালেদা জিয়ার মাঠ শুন্যতায় একাই ভোটের মাঠে খেলে যাচ্ছে দলটি। আর বিএনপি এখনো প্রার্থী চূড়ান্ত করতে না পারায়, জামায়াতের সক্রিয়তা শুধু চেয়ে চেয়ে দেখতে হচ্ছে দলটির নেতাকর্মীদের। সম্প্রতি ডাকসু -জাকসুসহ ছাত্রসংগঠনগুলোর নির্বাচনেও বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীর ভরাডুবি হয়েছে। আর ভূমিধস বিজয় লাভ করে শিবির সমর্থিত প্যানেল। ভোটের মাঠে জামায়াতের খেলায় এবং জয়ের স্রোতধারায় দলীয় নেতাকর্মীদের মাঝেও চিন্তার রেখা দেখা দিয়েছে। তারেক রহমানের দেশে আসা কিংবা খালেদা জিয়ার ভোটের মাঠে প্রচার ব্যাতীত দলীয় নেতাকর্মীরা প্রাণশক্তি পাবে না বলেও বিএনপি নেতাকর্মীরা মনে করছেন। তবে তারেক রহমান দেশে ফিরলে জামায়াত ঢেউ ভেঙে যাবে বলেও ধারণা করা হচ্ছে।

ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে ভোটের রোডম্যাপ দিয়েছে ড. ইউনূস সরকার। এখন থেকেই পাড়া-মহল্লা, হাট-বাজার, চায়ের দোকান রাজনৈতিক পাড়ায় শুরু হয়েছে ভোটযুদ্ধ নিয়ে নানা সমীকরণ। চলছে আলোচনা, তর্ক-বিতর্ক। তবে বিএনপির নেতাকর্মীদের কপালে  রয়েছে এখনো কিছুটা চিন্তার ভাঁজ। দীর্ঘ প্রায় ১৭ বছর ক্ষমতার বাইরে থাকায় নতুন নেতৃত্বে জট লেগেছে। প্রার্থী বাছাইয়ে অনেক সতর্কতার সঙ্গে হিসাব কষতে হচ্ছে। চব্বিশ পরবর্তী যেমন তারুণ্যকে অগ্রাধিকার দিতে হচ্ছে আবার সিনিয়র রাজনীতিবিদেরও অসন্তোষ রাখতে চাচ্ছে না দলটি।

বিগত ১৭ বছরে বিএনপির দলীয় নেতাকর্মী ছাড়াও, ছাত্রদল, যুবদলের বড় একটা এবার ভোটের মাঠে লড়তে চাচ্ছেন। প্রতিটি আসনে প্রায় ৫ থেকে ১০ জনের অধিক প্রার্থী রয়েছে। এমন কিছু আসন রয়েছে তরুণদের অগ্রাধিকার দিলে জ্যেষ্ঠ রাজনীতিবিদরা বিদ্রোহ করে স্বতন্ত্র নির্বাচন করতে পারেন। আবার যারা মাঠে ছিলেন তারা বিবেচিত না হয়ে যদি ব্যবসায়ী বা ভিন্ন কোনো ইঙ্গিতে কাউকে প্রার্থী করা হয় সে ক্ষেত্রেও দলের ত্যাগী নেতারা কেউ কাউকে ছাড় দেবে না। এমন বহুমুখী চাপের মধ্যে সময় পার করছে দলটি। এ ক্ষেত্রে সুবিধাজনক সময়ে রয়েছে জামায়াত। ভোটের প্রায় এক বছর পূর্বেই প্রতিটি আসনে চুড়ান্ত প্রার্থী ঠিক করে রেখেছে তারা। ভোটের আগেই কোমর বেঁধেই ভোটারদের বাড়ি বাড়ি পৌঁছে গিয়েছে।

বুধবার সরেজমিন দেখা গেছে, বিএনপি পাড়াতেও এখন ভোটযুদ্ধ নিয়ে তুমুল আলোচনা চলছে। দুপুর ১২টায় নয়াপ্টন বিএনপির দলীয় অফিসের সামনে চায়ের দোকানে দুই ডজন ছাত্রনেতার আলোচনা চলছে। কোন আসনে কোন বিভাগে কারা সম্ভাব্য প্রার্থী হবেন তা নিয়ে গভীর আলোচনা চলছে। এক একটা আসনে অগণিত প্রার্থী রয়েছে বলেও তাদের আলাপে উঠে আসে। কোথাও বিএনপির জ্যেষ্ঠ নেতা আবার ১৭ বছরের শূন্যতায় উঠে এসেছে অনেক তরুণ নেতা। প্রার্থী চূড়ান্তে তারেক রহমানকে অনেক বিপাকে পড়তে হবে বলেও দলটির নেতা-কর্মীরা মনে করছেন। অতীতে বিএনপিকে আওয়ামী লীগের সঙ্গে বিএনপিকে যতটা লড়াই করতে হয়েছে এবার তার চেয়ে আরও বেশি বিএনপিকে জামায়াতের সঙ্গে  লড়াই করতে হবে।

সাবেক তিন ছাত্রনেতা জনকণ্ঠকে বলেন, আগে আমাদের আওয়ামী লীগের ভয়ে ধানখেতে, আড়ালে থেকে লড়াই করতে হতো। তারা আমাদের সরাসরি গুলি করে, গুম করে হত্যা করত। সেখানেও আমরা ভেঙে পড়িনি। কিন্তু এবার জামায়াতের বিষয়টি আমাদের আরও বেশি ভাবিয়ে তুলছে। তারা আমাদের সরাসরি গুলি হত্যা না করলেও চোখের সামনে রেখে পিআর ভোটের মাঠের নানা কৌশলে যখন বিজয় ছিনিয়ে নেবে সেটা আমাদের আওয়ামী আচরণের চেয়েও বেশি কষ্টের হবে। 
তবে বিএনপির নির্ভরযোগ্য সূত্রগুলো বলছে, তারেক রহমান দেশে এলে অনেক দৃশ্যপটই বদলে যাবে। চলতি মাসের শেষের দিকে তারেক রহমান ওমরায় যেতে পারেন। ওমরা পালন করে নভেম্বরে তিনি দেশে ফিরতে পারেন। দলের কারা চূড়ান্ত টিকিট পাবেন তা বাংলাদেশ থেকেই ঘোষণা হবে। এবার আর অতীতের মতো ল-ন থেকে প্রার্থী ঘোষণা করা হবে না। দেশে ফেরার পর থেকেই নির্বাচন পর্যন্ত দলের চূড়ান্ত প্রার্থীকে নিয়ে বিভাগীয় সফর করবেন তিনি। সারাদেশে ধানের শীষের পক্ষে ঢেউ তুলবেন। কিছু গুরুত্বপূর্ণ জেলায় ভোটের প্রচারে খালেদা জিয়াও নামতে পারেন। এজন্য মা ছেলের জন্য বুলেট প্রুফ গাড়িসহ সব ধরনের প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে বলে দলটির প্রচার বিভাগ জানিয়েছে। 

বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ের নেতাকর্মীরা বলছেন, ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকেন্দ্রিক সব ধরনের প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। আসনভিত্তিক প্রার্থী যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়া এগিয়ে রাখা হয়েছে। যুগপৎ আন্দোলনে থাকা মিত্রদের নিয়েই নির্বাচনের ভাবনা রয়েছে। গ্রহণযোগ্য নির্বাচনে আসন ছাড়েরও চিন্তা রয়েছে। তবে নির্বাচন সামনে রেখে বিএনপির কাছে শতাধিক আসন চাচ্ছে মিত্র রাজনৈতিক দল ও জোটগুলো। এরই মধ্যে বেশ কয়েকটি দল ও জোট বিএনপির কাছে সম্ভাব্য প্রার্থীর তালিকা জমা দিয়েছে।লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি-এলডিপির কেন্দ্রীয় এক নেতা জানান, তারা আগামী নির্বাচনে বিএনপির কাছে ১৫টির মতো আসন চাইবে। গণফোরামের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি সুব্রত চৌধুরী তার দলের পক্ষে ঢাকা-৬সহ ১৫টি আসন চাইবেন। বিএনপির কাছে অর্ধশতাধিক আসন চাইবে গণতন্ত্র মঞ্চ। এদিকে অন্তত ২০ আসন চেয়েছে ১২ দলীয় জোট। জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট চেয়েছে ৯টি। এই সবগুলোর আবদারই তারেক রহমান এখন পর্যন্ত ঝুলিয়ে রেখেছেন তিনি এলে তবেই এগুলোর সমাধান হবে। লন্ডন থেকে কাউকে সিগন্যাল দেওয়া হবে না। জন সমর্থনের ভিত্তিতেই দল জোটের প্রার্থী ঘোষণা করা হবে।

এদিকে নির্বাচন কমিশন থেকে দলের নিবন্ধন পাওয়ার পর ৩০০ আসনে প্রার্থী নিয়ে প্রতিটি আসনে সভা-সমাবেশ ও গণসংযোগ করে যাচ্ছে বিএনপি। এ নিয়ে বিএনপির মাঠ পর্যায়ের অনেকেই দুশ্চিন্তায় রয়েছে। তবে এ নিয়ে চিন্তিত নয় বিএনপির হাইকমান্ড। দলটির শীর্ষ নেতারা বলছেন, তারেক রহমান দেশে এলে এবং খালেদা জিয়া ভোটের প্রচারে নামলে সব শঙ্কা কেটে যাবে। তবে জামায়াতের সূত্রগুলো বলছে, তারা শুধু ৩শ’ আসনে জাতীয় নির্বাচনের জন্য প্রার্থী নয়, স্থানীয় নির্বাচনের জন্য উপজেলা, ইউনিয়ন পরিষদের জন্যও প্রার্থী ঠিক করে সব কিছু এগিয়ে রেখেছেন। এ নিয়ে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল ড. এ এইচ এম হামিদুর রহমান আযাদ বলেন, আগামী ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে জামায়াতে ইসলামী ইতোমধ্যে আসন ভিত্তিক প্রার্থী ঘোষণা করেছে। প্রার্থীরা প্রচারে ব্যস্ত সময় পার করছেন।

বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব অ্যাডভোকেট রুহুল কবির রিজভী বলেন, বিএনপি গণমানুষের দল, বিএনপি সব সময় নির্বাচনমুখী দল এবং জনগণের ভোটে ক্ষমতায় আসতে চায়। এজন্য দলের নেতাকর্মীরা সাধারণ মানুষের কাছে ছুটে যাচ্ছেন। তাদের মন জয় করার জন্য কাজ করছেন। দলের নামে যারা অপকর্ম করছে দল ইতোমধ্যে কঠোর অবস্থান নিয়েছে।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেছেন, খুব শীঘ্রই প্রতিটি আসনে একক প্রার্থীকে আমরা গ্রিন সিগন্যাল দেব। তবে সেটা এখনো চূড়ান্ত নয়। তফসিল ঘোষণার পর পার্লামেন্টারি বোর্ডের মাধ্যমে আমরা চূড়ান্ত মনোনয়ন দেব। প্রতিটি আসনে আমাদের একাধিক যোগ্য প্রার্থী আছেন। অনেক আসনে আমাদের পাঁচজন, সাতজন এবং দশজন করে যোগ্য প্রার্থী আছেন। সুতরাং একটা নিয়মতান্ত্রিক রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে প্রার্থী বাছাইয়ের বিষয়টা আমাদের দেখতে হচ্ছে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. মাহবুব উল্লাহ বলেন, স্বাভাবিকভাবেই আগামী নির্বাচনে প্রতিযোগিতা খুবই তীব্র হবে। যে যত ভালো পরিকল্পনা নিয়ে মাঠে নামতে পারবে, জনগণের আস্থা অর্জন করতে পারবে, সে তত ভালো করবে। প্রত্যেক দলই সে প্রচেষ্টা চালাবে। সব দলের নেতাকর্মী যখন নির্বাচনী মাঠে নামবে তখনই নির্বাচনটা উৎসবমুখর হয়ে উঠবে। কিছু দলের প্রার্থী মাঠে আছে শোনা যাচ্ছে, অন্যরাও নামবে।সবচেয়ে বড় কথা নির্বাচন নিয়ে যতই প্রতিযোগিতা থাকুক, দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব এবং অস্তিত্বের প্রশ্নে যেন কোনো রকম অনৈক্য দেখা না দেয়, সেটা সবাইকে বজায় রাখতে হবে।সবাইকে নিয়েই দেশটা ভালো থাকুক। প্রতিযেগিতা থাকুক ভোটের মাঠে কিন্তু প্রতিহিংসা নয়।