প্রায় তিন যুগ পর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ (চাকসু) নির্বাচনের দিকেই সবার নজর। নির্বাচনহীনতার দীর্ঘদিনের অচলায়তন ভাঙার আশা দেখছেন শিক্ষার্থীরা। বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল প্রগতিশীল ছাত্রসংগঠনগুলোর অধিকাংশই চাই নির্বাচনের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের অধিকার প্রতিষ্ঠা হোক। তবে, এক্ষেত্রে ভিন্নমত চবি শাখা ছাত্রদলের। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এই নিয়ে ইতোমধ্যে তৎপরতা শুরু করেছেন।
বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা যায়, প্রতিষ্ঠার ৫৮ বছর পেরিয়ে গেলেও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদ নির্বাচন হয়েছে মাত্র ৬ বার। ১৯৬৬ সালে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর প্রথম দিকে, এবং ১৯৭০ থেকে ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত নিয়মিতভাবেই ৩ বার ছাত্র সংসদ নির্বাচন হয়। এরপর ১৯৮০ এবং ১৯৮১ সালে পরপর আবার দুইবার চাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সর্বশেষ অর্থাৎ ষষ্ঠ চাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল প্রায় তিন যুগ আগে ১৯৯০ সালে। নির্বাচনের প্রায় ১১ মাস পর ছাত্রনেতা ফারুকুজ্জামান হত্যার শিকার হলে তৎকালীন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন চাকসু বন্ধ করে দেয়। এরপর আর ছাত্রসংসদ নির্বাচন দেখেনি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে লেজুড়বৃত্তিক ছাত্র রাজনীতির কারণেই দীর্ঘ সময় ছাত্র সংসদ নির্বাচন সম্ভব হয়নি বলে মনে করেন অনেকে। তবে, জুলাই বিপ্লবে শেখ হাসিনার পতনের পর ছাত্র সংসদ নির্বাচন নিয়ে সরব ঢাবি, জাবি, রাবিসহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।
গত ৪ জানুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেটে চাকসু নিয়ে আলোচনা হয়েছে বলে জানা গেছে। দ্রুতই চাকসু নির্বাচনের নীতিমালা আসতে পারে। এছাড়া গত ২ জানুয়ারি শিক্ষার্থীদের সাথে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাম্প্রতিক বিষয় নিয়ে আলোচনায় এমনটিই জানিয়েছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (একাডেমিক) অধ্যাপক ড. শামীম উদ্দিন খান।
ইসলামী ছাত্রশিবিরের চবি শাখার সেক্রেটারি জেনারেল মোহাম্মদ আলী বলেন, ‘চাকসু হচ্ছে শিক্ষার্থীদের অধিকার বাস্তবায়নের একটি প্লাটফর্ম। ছাত্ররা তাদের নিজস্ব মতামতের ভিত্তিতে এখানকার প্রতিনিধি নির্বাচন করে এবং সে প্রতিনিধিরা ছাত্র-ছাত্রীদের সকল ধরনের দাবি-দাওয়া বাস্তবায়ন করার জন্য চেষ্টা করে।’
‘‘সুতরাং ছাত্র জনতার ৫ আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের পর এখন সময় এসেছে ছাত্রদের অধিকার নিয়ে কথা বলার, যা আগে কল্পনাও করা যেত না। বর্তমানে একটি স্বাভাবিক অবস্থা বিদ্যমান রয়েছে। আমরা মনে করি বর্তমান সময়টাই চাকসু নির্বাচনের উপযুক্ত সময়। আমরা চাই চাকসু গঠনতন্ত্রের প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষ করে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন দ্রুত সময়ের মধ্যে চাকসু নির্বাচনের আয়োজন করুক।”
তবে চাকসু নিয়ে ভিন্নমত চবি শাখা ছাত্রদলের। ছাত্রদলের চবি শাখা সাধারণ সম্পাদক আব্দুল্লাহ আল নোমান বলেন, আমরা অবশ্যই চাকসু নির্বাচন চাই। এটা শিক্ষার্থীদের প্রাণের দাবি। ছাত্রদল প্রত্যাশা করে অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে সুন্দর ক্যাম্পাস বিনির্মাণে বৈধ ছাত্র প্রতিনিধি চাকসুর মধ্য দিয়েই আসবে।
‘‘কিন্তু, চাকসু নিয়ে আমাদের আশঙ্কাও আছে। এ বিশ্ববিদ্যালয়ে হামলায় জড়িত ছাত্রলীগের দোসরদের বিচার হয়নি এখনও। একটি বিশেষ মহলের সেল্টারে আধিপত্য বিরাজ করে চলছে। ক্যাম্পাসে বিভিন্ন সময়ে ছাত্র-ছাত্রীদের ওপর নির্যাতন নিপীড়নকারী স্বৈরাচারের দোসরদের বিচার নিশ্চিত করে চাকসু নির্বাচন দিতে হবে। পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রশাসনেও দলীয় পরিচয়ের লোকজনের উপস্থিতি আমরা লক্ষ্য করছি।”
“এমতাবস্থায় চাকসু সুষ্ঠু নিরপেক্ষ করা সম্ভব না বলেই আমাদের মনে হচ্ছে। তার মধ্যে নতুন ২৪-২৫ সেশন আসছে। তাদেরও সুযোগ দেওয়া প্রয়োজন। স্বৈরাচারের দোসর কিংবা দলান্ধ শিক্ষক দিয়ে নির্বাচন আয়োজনের প্রস্তুতি নিলে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি হবে না বলেই দৃঢ় বিশ্বাস। তাই এসব সমস্যা রেখে চাকসু নির্বাচন হলে শিক্ষার্থীরা তা মেনে নেবে না”-যোগ করেন নোমান।
ছাত্র অধিকার পরিষদ চবি শাখার আহ্বায়ক তামজিদ উদ্দিন বলেন, ‘ছাত্রসংসদ না থাকার কারণে স্বৈরাচারীরা মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে। তাই আগামী ৬ মাসের মধ্যে চাকসু নির্বাচন দেওয়ার জোর দাবি জানাই।’
স্টুডেন্টস এলায়েন্স ফর ডেমোক্রেসির (স্যাড) কেন্দ্রীয় সদস্য সচিব আবির বিন জাবেদ বলেন, ‘অতিদ্রুত চাকসু ও হল সংসদ নির্বাচন দিয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে গণতান্ত্রিক পরিবেশ যেন নিশ্চিত করা হয়।’
সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধিত্বকারী সংগঠনগুলোর শিক্ষার্থীদের সাথে আলোচনা করেন উপ-উপাচার্য (একাডেমিক) অধ্যাপক ড. শামীম উদ্দিন খান। তিনি বলেন, ‘বর্তমান প্রশাসন চাকসু নির্বাচন নিয়ে ইতোমধ্যে কাজ করছে। লেজুড়বৃত্তিক ছাত্ররাজনীতি বন্ধ করে শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায়ের জন্য ছাত্রসংসদ নির্বাচনের গুরুত্ব রয়েছে। আগামী ৪ জানুয়ারি সিন্ডিকেট সভায় চাকসু নির্বাচনের অনুমোদন নিয়ে আবারো ছাত্রসংগঠনগুলোর সাথে আলোচনা করে চাকসু নির্বাচনের নীতিমালা প্রণয়ন করা হবে।’