Image description

দেশের মাদ্রাসাগুলোর নিয়ন্ত্রণ হাতে রাখতে মরিয়া ছিল আওয়ামী লীগ সরকার।  মাদ্রাসাগুলোর নিয়ন্ত্রণ রাখতে দাপট দেখিয়েছেন চতুর্দিক থেকে। আবার উল্টোদিকে মাদ্রাসা ও মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের উন্নয়নের গাল-গপ্পো ঝেড়েছেন। প্রায়শই শিক্ষার্থীদের উগ্র সন্ত্রাসবাদীর ট্যাগ দিতেন। নিজ বলয়ে মাদ্রাসাগুলোকে রেখে বাগিয়ে নিয়েছিলেন ‘কওমি জননী’ খেতাব। নানামুখী উন্নয়নের কথা বললেও মূলত মাদ্রাসাগুলোকে রেখেছিলেন চাপের মুখে। শিক্ষার মানে উন্নয়ন না করলেও নজর ছিল স্থাপনা নির্মাণে। বেতনের জন্য দীর্ঘ আন্দোলন করেও সুখবর পাননি স্বতন্ত্র ইবতেদায়ী শিক্ষকরা। মাদ্রাসাগুলোতে বন্ধ রাখা হয়েছিল জাতীয়করণ, এমপিওভুক্তি, মিড ডে মিল ও উপবৃত্তিও। 

মাদ্রাসা শিক্ষার মানে গুরুত্ব না থাকলেও আওয়ামী লীগ সরকার অবকাঠামোগত উন্নয়নে ছিল সজাগ। শেখ রাসেল ডিজিটাল ল্যাবসহ করা হয়েছে নতুন নতুন ভবন নির্মাণ। প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকা খরচ করে সারা দেশব্যাপী ১ হাজার ৮০০ মাদ্রাসা ভবন নির্মাণ করা হয়। মাদ্রাসার নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠানগুলোতে বসানো হয় নিজ বলয়ের লোকজন। সারা দেশে নির্মিত ৫৬৪টি মডেল মসজিদে লোকবল নিয়োগের ক্ষেত্রেও ছিল আওয়ামী মনা লোক। আওয়ামী লীগ সরকারের কথামতো চলায় পুরস্কারও পেয়েছেন অনেকেই। খবর চাউর হয়েছিল সরকারের সঙ্গে অলিখিত সমঝোতায় পৌঁছেছে হেফাজতে ইসলাম। অলিখিত ও অঘোষিত কিছু শর্তে একমত হয়েছে উভয়পক্ষ। এদিকে সমঝোতার অংশ হিসেবে হেফাজতের আমীর আল্লামা শাহ আহমদ শফী পরিচালিত হাটহাজারী মাদ্রাসা লিজ পাচ্ছে ৪০ কোটি টাকা মূল্যের তিন একর জমি। তবে বিশাল এই প্রাপ্তির বিনিময়ে হেফাজত নেতারা অঙ্গীকার করেছেন তারা আর বর্তমান সরকারের বিরোধিতা করে কোনো আন্দোলন করবেন না। পাশাপাশি হেফাজত নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে দেশব্যাপী দায়ের হওয়া মামলাগুলোর ব্যাপারে নমনীয় হবে সরকার। যদিও বিষয়টি বরাবরই অস্বীকার করে এসেছে হেফাজত। হেফাজতে ইসলামের সাংগঠনিক সম্পাদক মাওলানা আজিজুল হক বলেছিলেন, যে জমি পাওয়ার কথা বলা হচ্ছে তা অনেক আগে থেকেই হাটহাজারী মাদ্রাসার দখলে আছে। সরকারের সঙ্গে সমঝোতার কারণেই এই জমি মাদ্রাসা লিজ পাচ্ছে, তা সঠিক নয়।

করোনার পর মাদ্রাসা শিক্ষার ওপর ব্যাপক গুরুত্ব বৃদ্ধি পায়। সরকারের অসহযোগিতাপূর্ণ আচরণ ও নেতিবাচক প্রভাবের পরও বেড়েছে মাদ্রাসা শিক্ষার হার। বিশেষ করে প্রাথমিক পরবর্তী শেষ কয়েক বছরে শিক্ষার্থী বেড়েছে বেশি। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো’র (বিবিএস) এক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। মার্চে প্রকাশিত বিবিএস’র তথ্য অনুযায়ী, ৩ বছরের ব্যবধানে ধর্মীয় শিক্ষার হার বেড়েছে ২ দশমিক ৩১ শতাংশ। অন্যদিকে সাধারণ শিক্ষার প্রতি ২ দশমিক ২৫ শতাংশ মানুষের আগ্রহ কমেছে। ৩ লাখ ৮ হাজার ৩২টি পরিবারের ওপরে সমীক্ষা চালিয়ে ‘বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিক্‌?স-২০২৩’ শীর্ষক প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে।

প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২১ সালে সাধারণ শিক্ষার হার ছিল ৯৩ দশমিক ২৭ শতাংশ, ২০২৩ সালে তা কমে দাঁড়িয়েছে ৯১ দশমিক ০২ শতাংশে। ২০২১ সালে ধর্মীয় শিক্ষার হার ছিল ৪ দশমিক ৯৮ শতাংশ, ২০২৩ সালে তা বেড়ে হয়েছে ৭ দশমিক ২৯ শতাংশ।

পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ৪ বছরে মাদ্রাসায় প্রাথমিক পরবর্তী শ্রেণিগুলোতে শিক্ষার্থী বেড়েছে আড়াই লাখেরও বেশি। তবে এই তথ্যে উঠে আসেনি আলিয়া মাদ্রাসাগুলোর চিত্র। আবার চলতি বছর প্রকাশিত বাংলাদেশ শিক্ষাতথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইস) করা ‘বাংলাদেশ শিক্ষা পরিসংখ্যান-২০২৩’ এর প্রতিবেদন অনুযায়ী ৪ বছরের ব্যবধানে দেশের মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোতে ১০ লাখের বেশি শিক্ষার্থী কমেছে। তবে একই সময়ে কারিগরি, মাদ্রাসা ও ইংরেজি মাধ্যমে শিক্ষার্থী বেড়েছে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বর্তমানে মাদ্রাসাগুলোতে শিক্ষার্থী ২৭ লাখ ৫৮ হাজারের বেশি। এরমধ্যে ছাত্রী প্রায় ৫৪ শতাংশ।

দিনাজপুর সদরের প্রত্যন্ত এলাকার শিক্ষার্থীদের নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন শ্যামল কান্তি সিংহ রায়। গ্রাম বিকাশ কেন্দ্র প্রকল্পের প্রজেক্ট কো-অর্ডিনেটর শ্যামল বলেন, ঝরে পড়া শিক্ষার্থীদের অভিভাবকরা অধিকাংশই কৃষি শ্রমিক। এখন শ্রমিকদের সংখ্যা বাড়ছে সেইসঙ্গে কাজ কমে আসছে। আবার কৃষিতে টেকনোলজি আসার কারণেও কাজের হারটা কমছে। শিক্ষার্থীরা এখন নতুন করে যুক্ত হচ্ছে অন্য পেশায়। আর যারা শিক্ষায় থাকছে তারা স্বল্প ব্যয়ের কারণে মাদ্রাসায় যাচ্ছে। আবার অনেক মাদ্রাসায় কোনো খরচ তো লাগছেই না। উল্টো পোশাক, পরিপাটি থাকার জায়গা মিলছে। নিয়মিত ভালো খাবারের নিশ্চয়তা পাচ্ছে। 

কুড়িগ্রাম জেলায় নাগেশ্বরী উপজেলায় দরিদ্র শিক্ষার্থীদের নিয়ে কাজ করেন আহসান হাবিব। তিনি বলেন, এমন শিক্ষার্থী আছে যাদের একটা খাতা কেনার মানে বিশাল ব্যাপার। একটা খাতার জন্য অভিভাবকদের কাছে আবদার করতে হয়। অনেক শিক্ষার্থী আছে যারা প্রাথমিকের পরই মানে কর্মক্ষম হওয়ার পরই কাজে যোগ দেয়। কারণ দিনব্যাপী কাজ করলে তার সে ১০০ থেকে ৩০০ টাকা পর্যন্ত পায়। তিনি বলেন, অনেক পরিবার আছে যাদের নিজের আয়ে সংসার চলে কিন্তু ছেলে-মেয়েকে লেখাপড়া করানোর ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও খরচ করতে পারেন না। এসব শিক্ষার্থীরা মাদ্রাসায় যাচ্ছে সেখানে তাদের কোনো খরচ করতে হচ্ছে না। বিশেষ করে খাবারের চিন্তা করতে হচ্ছে না।

গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, করোনাকালীন সময়ে আমরা দেখেছি প্রতিবেদনে ৪টি শঙ্কা প্রকাশ করেছিলাম। আমরা বলেছিলাম শিক্ষার্থীরা ঝরে পড়বে, বাল্যবিবাহ বাড়বে, শিশুশ্রম ও অপুষ্টি বাড়বে। এই ৪টি আশঙ্কাই সত্যি প্রমাণিত হয়েছে। মাদ্রাসাগুলো অধিকাংশই লিল্লাহ বোডিং। শিক্ষার্থীরা প্রায় বিনামূল্যে পড়তে পাচ্ছে। যার কারণে অভিভাবকদের অর্থনৈতিকভাবে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছেন। আর বাবা-মায়েরা ইংরেজি মাধ্যমে পড়িয়ে আত্মতৃপ্তিতে ভুগছেন। যেটা অধিকাংশই ঠিক না। বর্তমানে শিক্ষায় রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ খুবই কম। যেখানে পারিবারিক বিনিয়োগ ৭১ শতাংশ অভিভাবকদের বহন করতে হয়। এই কারণেই মাদ্রাসায় শিক্ষার্থীরা যাচ্ছে। দেশের মাদ্রাসা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণ ও সিলেবাস প্রণয়নকারী প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড (বেফাক) থেকে শেখ হাসিনার সহযোগীদের অপসারণের দাবিতে বিক্ষোভ সমাবেশ করেছেন মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা।

গত ৩রা জানুয়ারি জুমার নামাজ শেষে বায়তুল মোকাররম মসজিদের উত্তর গেটে ‘সচেতন কওমি ছাত্র সমাজ’র ব্যানারে এই বিক্ষোভ সমাবেশের আয়োজন করা হয়। এ সময় বক্তারা বলেন, কওমি মাদ্রাসার ইতিহাস শাপলা চত্বরের রক্তাক্তের ইতিহাস। আমাদের ইতিহাস বায়তুল মোকাররমের এই উত্তর গেটে মোদির বিরুদ্ধে আন্দোলন করায় আওয়ামী লীগের নিষিদ্ধ সংগঠন ছাত্রলীগের হেলমেট বাহিনীর হামলার ইতিহাস। তাই এই কওমি অঙ্গনের গুরুত্বপূর্ণ ও মাদ্রাসা শিক্ষার বোর্ড বেকাফকে স্বৈরাচার শেখ হাসিনার দোসরদের হাত থেকে মুক্ত করতে হবে। 
তারা আরও বলেন, বেফাকে এখনো ৫ই আগস্ট পালিয়ে যাওয়া স্বৈরাচার শেখ হাসিনার দোসররা রয়ে গেছে। আমরা কওমি মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা বারবার আন্দোলন ও প্রতিবাদ জানিয়ে এলেও এখনো এই দোসরদের অপসারণ করা হয়নি। ফ্যাসিবাদের দোসর মৌলভি উবায়দুর রহমান খান নদভী ও আনাস মাদানীকে এখনো অপসারণ করা হয়নি। আমরা বেফাকের কাছে সব ধরনের তথ্য-প্রমাণ দেয়ার পরও তাদের অপসারণ করা হচ্ছে না। দ্রুত সময়ে তাদের অপসারণ না করা হলে কঠোর আন্দোলনে যেতে বাধ্য হবো।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক মুহাম্মদ জহিরুল ইসলাম বলেন, প্রথম কথা হলো একেবারে প্রাথমিক শিক্ষার স্তরে একটিও ইবতেদায়ী মাদ্রাসা সরকারি নয়। অর্থাৎ মাদ্রাসা শিক্ষার প্রাথমিক স্তরকে বিগত সরকার অবহেলা করেছে।  এ ছাড়া কওমি এবং আলিয়া দ্বন্দ্ব তো আগে থেকেই ছিল সেটাকে আরও অনেক বেশি গভীর করেছে বিগত সরকার। তারা ডিভাইড অ্যান্ড রুল পলিসি নিয়েছে। তারা চেয়েছে আলিয়া মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা যাতে কওমি মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের কাছে আসতে না পারে তাদের মধ্যে ঐক্য গড়ে উঠতে না পারে। কারণ এই ঐক্য হাসিনা সরকারের জন্য সমস্যা হতে পারতো। কওমি মাদ্রাসাগুলোকে নিষ্পেষণের মধ্যে রাখা হয়েছে তাদের দুনিয়াবী কাজ কর্মের জন্য অনুপযোগী করে রাখা হয়েছে। 

তিনি আরও বলেন, আর দীর্ঘকাল ধরে চলা জেনারেল শিক্ষিত এবং মাদ্রাসা শিক্ষিতদের মধ্যে একটা যে দ্বন্দ্ব সেটা তো ছিলই। অনেক সময় দেখা গেছে ইসলামিক স্টাডিজের শিক্ষকের জন্য কলেজগুলো আবেদন করেছে, কিন্তু সরকার অনুমোদন দিচ্ছে না। এটিকে ঐচ্ছিক বিষয় হিসেবে রাখা হয়েছে এবং এমনভাবে রাখা হয়েছে যাতে কোনো শিক্ষার্থী এটি পড়তে আগ্রহ প্রকাশ না করে।

এদিকে গণ-অভ্যুত্থানের পর নতুন করে মাদ্রাসার স্বীকৃতি দিতে কাজ করছে সরকার। বেসরকারি উদ্যোগে গড়ে ওঠা মাদ্রাসাগুলোকে স্বীকৃতি দিতে কাজ করা হচ্ছে। গত ১৮, ২২শে ডিসেম্বর ও ৫ই জানুয়ারি যথাক্রমে ৯, ৫ ও ৮টি মাদ্রাসার তথ্য চেয়েছে ব্যানবেইস। পরিচালক (উপ-সচিব) মোহাম্মদ মশিউর রহমান স্বাক্ষরিত এসব চিঠিতে মাদ্রাসার কাছে তথ্য চাওয়া হয়। এ ছাড়াও স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদ্রাসার শিক্ষকদো বেতন কাঠামোর আওতায় আনারও উদ্যোগ নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের সচিব ড. খ ম কবিরুল ইসলাম বলেন, স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদ্রাসাগুলো এমপিওভুক্তির উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। ইবতেদায়ি মাদ্রাসা নিয়ে দুটি উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। মাদ্রাসা জাতীয়করণ অন্তত প্রথম ধাপ হিসেবে এমপিওভুক্ত করা। ইতিমধ্যে আমার অফিসারকে এ নিয়ে নির্দেশনা দিয়েছি। তারা এ নিয়ে কার্যক্রম শুরু করবেন। দ্বিতীয়ত, এসব মাদ্রাসায় বিল্ডিং কনস্ট্রাকশনের জন্য আলাদা প্রজেক্ট করার নির্দেশনা দিয়েছি, তারা একটি ডিপিপি তৈরির প্রক্রিয়া শিগগিরই শুরু করবেন। এ সময় তিনি ইবতেদায়ি মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের জন্য উপবৃত্তি চালুর উদ্যোগ ও মিড ডে মিল চালুর প্রজেক্ট নেয়া হচ্ছে বলে জানান।