
গফরগাঁও- এখানকার চিত্রটা দেশের অন্য উপজেলার মতো নয়। নানা কারণে আলোচিত ওই উপজেলা দেড় বছর আগেও ছিল একটি পরিবারের নিয়ন্ত্রণে। গোলন্দাজ পরিবারের কথাই ছিল এখানে শেষ কথা। ওই পরিবারের (বাবা-ছেলে) শাসন ছিল কম-বেশি দুই যুগের। তাদের নিয়ন্ত্রণ এতটাই পোক্ত ছিল যে, তাদের বাইরে যাওয়া আওয়ামী লীগের নেতারা ছিলেন অসহায়, প্রায় ঘরবাড়ি ছাড়া। ফাহমি গোলন্দাজ বাবেলের সঙ্গে বিরোধ আছে, এমন কোনো আওয়ামী লীগের নেতা গফরগাঁওয়ে সভা-সমাবেশ দূরে থাক, দাঁড়াতেই পারেননি গত ক’বছর। তাদের বাড়ি-ঘরে হামলা, লুটপাট, জমিজমা দখল ছিল নিত্যদিনের ঘটনা। বলতে গেলে আওয়ামী জমানায় গফরগাঁওয়ে এক পরিবারের ত্রাসের রাজত্ব ছিল। বাবেল যুগে গফরগাঁওয়ে বিএনপি’র রাজনীতি ছিল প্রায় নিষিদ্ধ। দলটির নেতাকর্মী বাড়িতে গেলেই হামলার শিকার হতেন। ঘোষণা দিয়ে গফরগাঁওয়ে বিএনপি’র কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচি করার সাহস পেতেন না তারা। ঝটিকা কেউ কোনো কর্মসূচি পালন করতে গেলেই ফাহমি বাহিনী ঘিরে ধরতো।
৫ই আগস্টের পর সাম্রাজ্য রেখে ‘রাজা’ ফাহমি পালিয়েছেন। তার ঘর-বাড়িতে ক্ষোভের আগুন পড়েছে দফায় দফায়। তার বাহিনীর সদস্যরা কেউই এখন আর এলাকায় নেই। তবুও ভালো নেই গফরগাঁও। নতুন উৎপাতের নাম ‘সাবেক নেতা’। তারা নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্ব-সংঘাতে ব্যস্ত। বিভক্তি-ভিন্নমত হলেই উপ-গ্রুপগুলোর মধ্যে ধাওয়া- পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটছে। আওয়ামী লীগ পতনের পর এখানে বিএনপি’র তিনটি ইউনিটের নেতাকর্মী ৬ ভাগে বিভক্ত। প্রতিটি উপ-গ্রুপের চোখ হাটবাজার, বালুঘাট, ফুটপাথ, সরকারি অফিস- আদালতে। এ সবের নিয়ন্ত্রণে রীতিমতো মরিয়া তারা। দখলবাজি চাঁদাবাজি, হামলা-ভাঙচুরের অভিযোগ অন্তহীন। স্ট্যান্ড দখল নিয়ে বিএনপি’র দু’গ্রুপের মুখোমুখি সংঘর্ষ সেদিনের ঘটনা। হামলায় যুবদলের দুই কর্মী নিহত হন। গফরগাঁও বিএনপি’র খুনোখুনির লোমহর্ষক চিত্র মুহূর্তেই ছড়িয়েছে নেট দুনিয়ায়। এতে বিব্রত দলটির হাইকমান্ড। এর জেরে তিনটি আহ্বায়ক কমিটি বিলুপ্ত করা হয় তৎক্ষণাৎ। তবুও বিরোধ থামেনি। বিএনপি’র ছয় নেতার পক্ষে পৃথক পৃথক শোডাউন হচ্ছে এখনো। নেতাদের দ্বন্দ্ব-সংঘাতে বিরক্ত দলটির কর্মী-সমর্থকরা। ভোটাররা শঙ্কিত। তাদের অনেকেই ভোটকেন্দ্রে না যাওয়ার কথা বলছেন। এতে ৫ই আগস্টের পর আওয়ামী লীগের দুর্গখ্যাত গফরগাঁও তথা ময়মনসিংহ-১০ আসনে বিএনপিকে নিয়ে যেটুকু সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিলো তা মিইয়ে যাচ্ছে। স্থানীয়দের ভাষ্যমতে, ওই আসনে ভোটের মাঠে চুপিসারে এগুচ্ছে জামায়াত! দলটির শতশত নেতাকর্মী দলবেঁধে প্রতিদিন ছুটছেন ইউনিয়ন, ওয়ার্ড তথা গ্রামে গ্রামে। দলটির মহিলা শাখার কর্মীরাও যাচ্ছেন ভোটারদের দ্বারে দ্বারে। কোনো জায়গায় জামায়াতের পক্ষে ভোট চাইতে তাদের কর্মীরা ৩ থেকে ৪ বারও গেছেন বলেও রিপোর্ট মিলেছে।
বিএনপি’র কোন গ্রুপে কারা আছেন: গফরগাঁও-পাগলা থানা নিয়ে ময়মনসিংহ-১০ আসন। ভোটের মাঠে আওয়ামী লীগ নেই। জামায়াতের অবস্থানও শক্ত নয়। এখানে বিএনপি’র ৬ ব্যক্তি মনোনয়ন চাইছেন। এরমধ্যে বিএনপি’র সাবেক সংসদ ফজলুর রহমান সুলতানের ছেলে মুশফিকুর রহমান রয়েছেন। তবে উপজেলা বিএনপি’র নেতাকর্মীদের ১০ শতাংশও তার সঙ্গে নেই। সেই হিসাবে এগিয়ে আছেন তার আপন চাচা জেলা বিএনপি’র সদস্য এবি সিদ্দিকুর রহমান। উপজেলা বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের অধিকাংশ নেতাই তার সঙ্গে রয়েছেন। ভোটের মাঠে এগিয়ে আছেন আরেক প্রার্থী পাগলা থানা বিএনপি’র সাবেক আহ্বায়ক ডা. মোফাখ্খারুল ইসলাম রানা। তিনি ঢাকা পিজি হাসপাতালের চিকিৎসক হওয়ায় দুই থানার হাজার হাজার মানুষকে বিনামূল্যে চিকিৎসা দিয়েছেন। এলাকায় বেশ জনপ্রিয়তা রয়েছে। দুই থানা বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের উল্লেখযোগ্যসংখ্যক নেতাকর্মী তার সঙ্গে রয়েছেন। গফরগাঁও উপজেলা বিএনপি’র সাবেক আহ্বায়ক ও জেলা বিএনপি’র সদস্য এবি সিদ্দিকুর রহমানের সঙ্গে যারা আছেন তাদের মধ্যে রয়েছে- গফরগাঁও থানা বিএনপি’র সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক এমআর খায়রুল, জালাল উদ্দীন জালাল, ফখরুল ইসলাম ও শাহ আব্দুল্লাহ আল মামুন।
গফরগাঁও পৌর বিএনপি’র সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক আল আমিন জনি ও জাহিদ হাসান স্বপন। কেন্দ্রীয় কৃষক দলের সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক ময়মনসিংহ বিভাগ সাদেকুর রহমান। পাগলা থানা বিএনপি’র সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক মাহবুবুল আলম ও গফরগাঁও থানা ছাত্রদলের সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক মাহবুবুল আলম হিমেল। গফরগাঁও সরকারি কলেজ শাখা ছাত্রদলের সহ-সভাপতি নেওয়ার শরিফ। গফরগাঁও উপজেলা যুবদল যুগ্ম আহ্বায়ক গোলাম মোস্তফা। স্বেচ্ছোসেবক দলের যুগ্ম আহ্বায়ক নাছির উদ্দিন। গফরগাঁও উপজেলা কৃষক দলের সাবেক সদস্য সচিব আমিনুল ইসলাম চঞ্চল, উপজেলা তাঁতি দলের সভাপতি রমজান মোল্লা ও সাধারণ সম্পাদক মুক্তা, শ্রমিক দলের সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক শফিকুল ইসলাম শফিক। পৌর কৃষক দলের আহ্বায়ক নাসির উদ্দিন ও মহিলা দলের সদস্য সচিব শারমিন আক্তার। (২৩ রাজনৈতিক মামলা)। এই আসনে সাবেক এমপি ফজলুর রহমান সুলতানের ছেলে ও উপজেলা বিএনপি’র সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক মুশফিকুর রহমান আলোচনায় আছেন। তবে এবি সিদ্দিক মনোনয়ন চাওয়ায় অনেকে এটাকে চাচা-ভাতিজার লড়াই হিসেবে দেখছেন। একই পরিবারের দু’জন মনোনয়ন চাওয়ায় ভোটারদের মধ্যে একটা দ্বিধাদ্বন্দ্ব দেখা গেছে। কিন্তু চাচার সঙ্গে দুই থানা বিএনপি’র অধিকাংশ নেতাকর্মী থাকলেও ভাতিজা মুশফিকের সঙ্গে আলোচিত কাউকেই পাওয়া যায়নি। তার সঙ্গে যারা রয়েছে তাদের মধ্যে- পাগলা থানা বিএনপি’র যুগ্ম আহ্বায়ক আনসারুল ইসলাম। গফরগাঁও পৌর ছাত্রদলের যুগ্ম আহ্বায়ক নাইমুল ইসলাম নাইম ও সুজন আব্বাসী, পৌর স্বেচ্ছাসেবক দলের যুগ্ম আহ্বায়ক রিজভী সরকার, থানা কৃষক দলের আহ্বায়ক এমএ কাইয়ূম, থানা ছাত্রদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক অপু রায়হান।
পাগলা থানা বিএনপি’র সাবেক আহ্বায়ক ডা. মুফাখখারুল ইসলাম রানার সঙ্গেও বিএনপি’র একটি বড় অংশ রয়েছেন। তিনিও এলাকায় নিয়মিত সময় দিচ্ছেন। তার সঙ্গে থাকা বিএনপি নেতাদের মধ্যে রয়েছে- পাগলা থানা বিএনপি’র সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক শেখ মোহাম্মদ ইশহাক, মুহাম্মাদ আব্দুল হামিদ, সোয়াদুর রহিম ও কবির সরকার। গফরগাঁও থানা ছাত্রদলের আহ্বায়ক মুক্তার হোসেন, গফরগাঁও থানা যুবদলের যুগ্ম আহ্বায়ক আব্দুল আজিজ সাদেক, গফরগাঁও সরকারি কলেজ ছাত্রদলের সভাপতি ফাহমিদুল ইসলাম ফাহিম ও সাধারণ সম্পাদক মাহিদুর রহমান মাহিদ। (২০১৮ সালে ১টা মামলা)। এই আসনে আলোচনায় আছেন ময়মনসিংহ জেলা বিএনপি’র ১নং যুগ্ম আহ্বায়ক আলমগীর মাহমুদ আলমও। তার সঙ্গে রয়েছে- গফরগাঁও পৌর বিএনপি’র সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক আব্দুস সালাম, আবু সায়েম ও মিজানুর রহমান পল্টন। পৌর বিএনপি’র সাবেক সদস্য জয়নাল আবেদীন চানু, পৌর স্বেচ্ছাসেবক দলের আহ্বায়ক ইমন হাসান, গফরগাঁও থানা ছাত্রদলের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক আব্দুস সালাম বিল্পব, থানা স্বেচ্ছাসেবক দলের আহ্বায়ক মীর মুজাম্মেল হক মনন ও ইউনিয়ন বিএনপি’র সাধারণ সম্পাদক ফজলুল হক। প্রার্থী হিসেবে প্রচারে আছেন পাগলা থানা বিএনপি’র সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক এডভোকেট আল ফাত্তাহ মো. আব্দুল হান্নান খান। তিনিও এলাকায় মিটিং সমাবেশ করছেন। তার সঙ্গে রয়েছে- পাগলা থানা বিএনপি’র সদস্য আমির হোসেন ও আমিরুদ্দিন। গফরগাঁও থানা স্বেচ্ছাসেবক দলের ১নং যুগ্ম আহ্বায়ক দিদারুল ইসলাম। আলোচনায় আছেন পাগলা থানা বিএনপি’র সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক আক্তারুজ্জামান বাচ্চু। তিনিও ভোটারদের কাছে যাচ্ছেন। ভোট চাচ্ছেন। তার সঙ্গে রয়েছে- গফরগাঁও থানা বিএনপি’র সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক আবু সাইদ মাস্টার, গফরগাঁও থানা বিএনপি সদস্য হেলালুদ্দিন, স্বেচ্ছাসেবক দলের সদস্য সচিব সেলিম আহমেদ।
জানতে চাওয়া হলে এবি সিদ্দিকুর রহমান মানবজমিনকে বলেন, কমিটি হয়ে গেলে বিভেদ থাকবে না। আগামী নির্বাচনে এই আসন পুনরুদ্ধার করা হবে। দল আমাকে মনোনয়ন দিলে গফরগাঁও থেকে চাঁদাবাজি, দখলবাজি ও সন্ত্রাসমুক্ত করতে সময় লাগবে না। দ্রুত একক প্রার্থী ঘোষণা করলে কোন্দল থাকবে না। এই সমস্যা সমাধান করতে হলে আগাম প্রার্থী ঘোষণা সময়ের দাবি।
এদিকে ডা. মোফাখখারুল ইসলাম রানা মানবজমিনকে বলেন, আমি কোনো বিভেদের মধ্যে নেই। মনোনয়ন যে কেউ চাইতে পারে। তবে দল যাকে যোগ্য মনে করবে তাকে মনোনয়ন দিবেন। হাইকমান্ড যাকে বাছাই করবে আমি তার পক্ষেই কাজ করবো। দলীয় সিদ্ধান্তকে শ্রদ্ধা জানাই। তবে এলাকার মানুষ চিকিৎসাসেবায় বঞ্চিত; আমার সুযোগ হলে ঢাকার উন্নত চিকিৎসা আমার গ্রামের মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে চেষ্টা করবো। আর গফরগাঁও বিএনপি’র কোন্দল সমাধান জরুরি। তা-না হলে এই আসন উদ্ধার করতে কষ্ট হয়ে যাবে। আমি মনে করি মনোনয়ন চূড়ান্ত হলে সব বিভেদ ভুলে সবাই দলের পক্ষে ঝাঁপিয়ে পড়বে।