Image description
♦ অনিশ্চিত হয়ে পড়ছে শিশু-কিশোরের ভবিষ্যৎ ♦ পেরেন্টাল কন্ট্রোল সম্পর্কে জানেনই না অভিভাবকরা

ধানমন্ডির একটি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের নবম গ্রেডের শিক্ষার্থী। বয়স ১৪। পঞ্চম গ্রেডে পড়ার সময় অনলাইন ক্লাসের জন্য মেয়েকে ‘স্মার্ট ফোন’ দিতে বাধ্য হন অভিভাবকরা। ‘সেভেন গ্রেডে’ ওঠার পরই মোবাইলে আসক্ত হয়ে পড়ে সেই মেয়েটি। সারা রাত মোবাইল স্ক্রিনের ওপর পড়ে থাকে তার দুই চোখ। ক্রমেই খারাপ হতে থাকে তার পরীক্ষার রেজাল্ট। একসময় বাবা-মা টের পান তাদের আদরের মানিক একটি মাদকাসক্ত ছেলের সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে গেছে। মা-কে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে দিয়ে ছেলেকে বাসায় ডাকত। বিষয়টি টের পেয়ে বাধা দিলে ঘর থেকে বের হয়ে যেত। মোবাইল ফোন কেড়ে নিলে সে ঘরে ভাঙচুর করত। বাবা-মায়ের গায়ে হাত তুলত। তবে মানসম্মানের ভয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দ্বারস্থও হতে পারছিলেন না তারা। বাধ্য হয়েই আবাসন কোম্পানিতে চাকরিরত বাবা এবং গৃহিণী মা শরণাপন্ন হন মনোরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে। মাঝে কিছু সময় হাসপাতালে ভর্তি রেখে চলছিল তার চিকিৎসা। এখনো সে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে চিকিৎসা নিচ্ছে।

রাজধানীর একটি কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। বয়স ১৭ বছর। নবম শ্রেণিতে পড়ার সময় মোবাইল ফোনে একটি ছেলের সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে যায়। একপর্যায়ে অনলাইনেই তারা অন্তরঙ্গ ছবি বিনিময় করে। তবে কিছুদিন পর ওই ছেলেটির আসল চেহারা প্রকাশ পায়। ওই ছবি এবং ভিডিওর ভয় দেখিয়ে ভুক্তভোগী মেয়ের কাছে টাকা দাবি করে। বাধ্য হয়ে প্রতারকের চাহিদা পূরণ করে আসছিল ভুক্তভোগী মেয়েটি। তবে ক্রমেই বাড়তে থাকে চাহিদা। প্রচ রাগী বাবার ভয়ে তাকে কোনো কিছু জানাতেও সাহস পাচ্ছিল না মেয়েটি। মাঝে-মাঝেই অসুস্থ হয়ে পড়ে সে। সম্প্রতি তার এক কাজিনের মাধ্যমে এক মনোরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে শরণাপন্ন হয়। তবে তার জীবনে ঘটে যাওয়া ভয়ংকর ওই মুহূর্তটিকে কোনোভাবেই সে ভুলতে পারছে না।

মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. মেঘলা সরকার বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, মোবাইল ফোনে আসক্তির কারণে অপ্রাপ্ত বয়সের বাচ্চারা ভয়ংকর ভবিষ্যতের দিকে এগোচ্ছে। ফোনের বিষয়ে বাবা-মায়েদের সচেতন হতে হবে। কোনো অবস্থাতেই যাতে রাতের বেলায় মোবাইল ফোন না দেওয়া হয়। এক ঘণ্টার জন্য মোবাইল দিলেও তাদের নজরদারিতে রাখতে হবে।

তিনি বলেন, আমরা দেখেছি যেসব বাচ্চার রিয়েল লাইফে বন্ধুবান্ধব কম, সামাজিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত না থাকে, তারাই বেশি স্মার্ট ফোনে আসক্ত হয় বেশি। বাবা-মা বুঝতেই পারে না যে, তাদের সন্তানরা স্মার্ট ফোনে আসক্ত হয়ে পড়েছে।

বিশ্বায়নের এ যুগে সাইবার দুনিয়ার দরজা সবার জন্য উন্মুক্ত। তবে ইন্টারনেটে অবাধ বিচরণ শিশুর নিরাপত্তার জন্য ঝুঁকির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আইডি হ্যাক, তথ্য চুরির মতো সাইবার অপরাধ ঘটছে। এসব অপরাধের শিকার সবচেয়ে বেশি হচ্ছে ১৮ বছরের কম বয়সি শিশুরা। এসবের অন্যতম প্রধান কারণ হলো শিশু-কিশোরদের হাতে স্মার্ট ফোন। স্মার্ট ফোনের মাধ্যমেই ইন্টারনেটে আসক্ত হয়ে পড়ছে শিশু-কিশোররা।

অপ্রাপ্তবয়স্কদের স্মার্ট ফোনের অপব্যবহার নিয়ে প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী (ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়) ফয়েজ আহমদ তৈয়ব বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আমি সিভিল সোসাইটিসহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বডির সঙ্গে বসব। বিশেষ করে মেট্রোপলিটন এলাকার স্কুল-কলেজের অভিভাবকদের মতামত নেওয়া হবে। তারা যদি চান তাহলে আমরা আইন করার দিকে হাঁটব।

ইন্টারনেট আসক্তি নিয়ে জাতীয় মানসিক ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের ২০২১ সালের জরিপে উঠে এসেছে ইন্টারনেট আসক্তির ভয়ংকর চিত্র। জরিপের তথ্য অনুযায়ী, ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের ৭৬.১ শতাংশ ভিডিও দেখেন, সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যস্ত থাকেন ৫৫.৯ শতাংশ, গেমিংয়ে সময় ব্যয় করেন ৫৪.৫ শতাংশ। ব্যবহারকারীদের মধ্যে স্মার্ট ফোন ব্যবহার করেন ৭৯.৪ শতাংশ, ল্যাপটপ ৩.৯ শতাংশ, মোবাইল ৪.৫ শতাংশ, ডেস্কটপ ২.৮ শতাংশ এবং অন্যান্য মাধ্যমে ৪৮.৭ শতাংশ। ব্যবহারকারীদের মধ্যে ১০ থেকে ১৪ বছরের শিশুর সংখ্যা ১০.৮ শতাংশ, ১৫ থেকে ২৫ বছরের মানুষের সংখ্য ২৬ শতাংশ।

গত ২০২৩ সালে বেসরকারি সংস্থা ‘আঁচল ফাউন্ডেশন’-এর জরিপে উঠে আসে ইন্টারনেট ব্যবহারকারী শিক্ষার্থীদের ভয়ংকর তথ্য। ১ হাজার ৭৭৩ জন শিক্ষার্থীর ওপর চালানো এক জরিপে উঠে আসে মানসিক সমস্যায় ভোগা শিক্ষার্থীদের ৮৬ ভাগেরই ‘কারণ’ ইন্টারনেট। সমীক্ষায় দেখা গেছে, ৩৮ দশমিক ২ শতাংশ শিক্ষার্থী পড়াশোনা বিষয়ক কাজে ইন্টারনেট ব্যবহার করে থাকে। ৬৭ দশমিক ৫ শতাংশ অবসর সময় কাটাতে, ৪২ দশমিক ৯ শতাংশ যোগাযোগের প্রয়োজনে, ২৪ দশমিক ৯ শতাংশ অনলাইন গেম খেলতে বা ভিডিও দেখতে, ১২ দশমিক ৬ শতাংশ অনলাইনে কেনাকাটা করতে এবং ৮ শতাংশ অর্থনৈতিক প্রয়োজনে ইন্টারনেট ব্যবহার করে। এর মধ্যে ১৭ দশমিক ৮ শতাংশ ইন্টারনেটে পর্নো দেখা, সাইবার ক্রাইম, বাজি ধরা, বুলিং করা প্রভৃতি অপ্রীতিকর কাজের সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে পড়েছেন। ২৩ শতাংশ ধীরে ধীরে অন্তর্মুখী হয়ে পড়েছেন, ৩৫ দশমিক ৬ শতাংশ ডিপ্রেশনসহ বিভিন্ন ধরনের মানসিক চাপ অনুভব করেছেন এবং ২০ দশমিক ৩ শতাংশ সামাজিকভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছেন।

২০১৯ সালে ইউনিসেফের একটি প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, বাংলাদেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারী ১০ থেকে ১৭ বছর বয়সি ৩২ শতাংশ শিশু অনলাইন সহিংসতা, অনলাইনে ভয়ভীতি প্রদর্শন ও ডিজিটাল উৎপীড়নের শিকার হওয়ার মতো বিপদের মুখে রয়েছে। ইউনিসেফ দেশের স্কুল, কলেজ ও মাদরাসা শিক্ষাব্যবস্থার ১ হাজার ২৮১ জন স্কুল-বয়সি শিশু, যারা ইন্টারনেট ব্যবহার করে তাদের ওপর জরিপ এ প্রতিবেদন তৈরি করে। সমীক্ষায় উঠে আসে, প্রায় ২৫ শতাংশ শিশু (১০-১৭ বছর বয়সি) ১১ বছর বয়সের আগেই ডিজিটাল জগতে প্রবেশ করতে শুরু করে। এ ছাড়া, শিশুদের একটি বড় অংশ (৬৩%) প্রাথমিকভাবে ইন্টারনেট ব্যবহারের স্থান হিসেবে তাদের নিজেদের কক্ষটিকেই ব্যবহার করে। এটা ‘বেডরুম কালচার’-এর ব্যাপকতা নির্দেশ করে, যা অপেক্ষাকৃত কম নজরদারির মধ্যে ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগ তৈরি করে। উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুল অ্যান্ড কলেজের সিনিয়র শিক্ষক (ইংলিশ মিডিয়াম) মশাল ম ল বলেন, আমাদের স্কুলে ছাত্রছাত্রীদের জন্য স্মার্ট ফোন ব্যবহার অফিসিয়ালি নিষিদ্ধ করা হয়েছে অনেক আগে থেকেই। তবে জ্ঞান আহরণের জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণ রেফারেন্স বুক রাখা হয়েছে প্রতিষ্ঠানে। তারা চাইলেই এসব রেফারেন্স বুক স্টাডি করতে পারে।

শিশু ইন্টারনেট নিয়ে কাজ করেন সাইবার স্পেশালিস্ট সাদাত রহমান। তিনি এ প্রতিবেদককে বলেন, ইন্টারনেটের অপব্যবহারের কারনে সুইসাইড বাড়ছে। আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই) সংশ্লিষ্ট অপরাধ রীতিমতো আতঙ্ক ছড়াচ্ছে। এর বড় একটি অংশ শিশু এবং টিনএজরা। অথচ এ দেশে তাদের জন্য সরকারের বিশেষায়িত কোনো সার্ভিস নেই। পুলিশকে অবহিত করে কোনো সমাধানও মিলছে না।