
লাইটার জাহাজকে ভাসমান গুদাম বানিয়ে ভোগ্যপণ্য মজুতের অপতৎপরতা আবারও শুরু হয়েছে। অসাধু ব্যবসায়ীরা পণ্যের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে বাজারে দাম বাড়ানোর হীন উদ্দেশ্য থেকেই এই কাজটি করে থাকেন বলে সংশ্লিষ্টরা অভিযোগ করেছেন। বিশেষ করে চাহিদাকে পুঁজি করে রমজানের আগে এই পথ অবলম্বন করেন তারা। এবার আগেভাগেই এমন অপতৎপরতা শুরু হয়েছে। এ কারণে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ (চবক) বন্দরের বহির্নোঙরে বঙ্গোপসাগর ও কর্ণফুলীতে লাইটার জাহাজে অভিযান চালিয়েছে। গত বৃহস্পতিবার পরিচালিত অভিযানে ৭ হাজার টন গম নিয়ে ১৫ দিন ধরে বসে থাকা ৬টি লাইটার জাহাজকে জরিমানা করা হয়েছে। একই সঙ্গে এসব জাহাজকে দ্রুত বন্দরের জলসীমা ত্যাগ করার নির্দেশনা দেওয়া হয়।
অভিযানের সত্যতা নিশ্চিত করে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব ওমর ফারুক বৃহস্পতিবার যুগান্তরকে বলেন, ‘কোনো লাইটার জাহাজ অহেতুক বসে আছে কিনা, বেআইনি কর্মকাণ্ডে লিপ্ত আছে কিনা এসব দেখভালের জন্য চবক মাঝে মধ্যেই ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে অভিযান টিম পাঠায় বহির্নোঙরসহ বন্দরের আওতাধীন সাগর ও নদী এলাকায়। বৃহস্পতিবারের অভিযানটিও রুটিন ওয়ার্ক হিসাবে পরিচালিত হয়েছে। গোপন তথ্যের ভিত্তিতেও অনেক সময় এ ধরনের অভিযান পরিচালনা করা হয়।’
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, দেশের বাজারে কোনো আমদানি পণ্যের দাম পড়ে গেলে দাম না ওঠা পর্যন্ত সেই পণ্যটি মজুত করে রাখা হয়। আবার বিদেশের বাজারে পণ্যের বুকিং রেট বা রপ্তানিমূল্যে কমলেও পণ্য মজুত করা হয়। সাধারণত আমদানিকারকরা নিজস্ব গুদাম কিংবা ভাড়ায় পরিচালিত বিভিন্ন গুদামে পণ্য মজুত করেন। কিন্তু গত কয়েক বছর আগে থেকে লাইটার জাহাজকে ‘ভাসমান গুদাম’ বানিয়ে পণ্য মজুতের প্রথা চালু হয়। ভাড়ার গুদামে দিনের পর দিন পণ্য মজুত করে রাখায় যে খরচ হয় সে হিসাবে লাইটার জাহাজে পণ্য মজুতে খরচ কম পড়ে। তাছাড়া খালাসের পর গুদামে পণ্য মজুত করলে তার হিসাব সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থা ও ব্যবসায়ী প্রতিনিধির হাতে থাকে। এতে চাহিদা অনুযায়ী পণ্য আছে কিনা তা জানা যায়। কৃত্রিম সংকট সৃষ্টির সুযোগ থাকে না। পক্ষান্তরে লাইটারে পণ্য মজুত করলে তার হিসাব খুব সহজে বের করা যায় না। গম, চাল, ডাল, তেল, চিনি, সরিষাসহ বিভিন্ন ভোগ্যপণ্যের ক্ষেত্রে মজুতের প্রবণতা বেশি দেখা যায়।
বিদেশ থেকে সমুদ্রপথে মাদার ভেসেল বা বড় আকারের জাহাজে করে পণ্য আমদানি করা হয়। চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরে এসব পণ্য খালাস করা হয় লাইটার বা ছোট জাহাজে। এসব জাহাজ নদীপথের অন্তত ৩৮টি রুটে পণ্য পরিবহণ করে থাকে। লাইটার জাহাজ নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট সেলের (ডব্লিউটিসি) তথ্য অনুযায়ী চট্টগ্রাম বন্দর থেকে প্রায় ২ হাজার লাইটার জাহাজ নদীপথে পণ্য পরিবহণে নিয়োজিত রয়েছে। সড়কপথে পণ্য পরিবহণ ব্যয় বেশি হওয়ার কারণে নদীপথকেই আমদানিকারকরা বেছে নেন। একটি ট্রাকে যেখানে ১০ টন থেকে ১৩ টন পণ্য পরিবহণ করা যায়; সেখানে একটি লাইটার জাহাজে ১ হাজার টন থেকে সর্বোচ্চ ৫ হাজার টন পর্যন্ত পণ্য পরিবহণ করা। এতে পরিবহণ খরচ সাশ্রয় হয়।
চট্টগ্রাম বন্দর সূত্র জানায়, একেকটি জাহাজকে মাদার ভেসেল থেকে পণ্য খালাস করে ৭২ ঘণ্টার মধ্যে বন্দরের জলসীমা ত্যাগ করার নির্দেশনা দেওয়া আছে। কিন্তু দেখা গেছে, লাইটার জাহাজগুলো পণ্য বোঝাই করে অনেক সময় ৩ দিনের স্থলে ১৫-২০ দিন কিংবা তারও বেশি সময় নদী-সাগরে ভাসতে থাকে। এর কারণ খুঁজতে গিয়েই লাইটার জাহাজকে ‘ভাসমান গুদাম’ হিসাবে ব্যবহারের অভিনব তথ্য উদঘাটন হয়। যেটি চালু হয়েছে ৫-৭ বছর আগে থেকেই।
চট্টগ্রামের চাক্তাই-খাতুনগঞ্জ আড়তদার কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ মহিউদ্দিন যুগান্তরকে বলেন, ‘এক মাসের ব্যবধানে চট্টগ্রামের পাইকারি বাজার খাতুনগঞ্জে রাশিয়া ও কানাডা থেকে আমদানি করা গমের দাম প্রতিমনে ১০০ থেকে ১৫০ টাকা পর্যন্ত কমে গেছে। কানাডা থেকে আমদানি করা গম বর্তমানে প্রতিমন ১ হাজার ৫৩০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। একইভাবে রাশিয়া থেকে আমদানি করা গম বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ৩৭০ টাকায়। এ ক্ষেত্রে অনেক সময় তারা লাইটার জাহাজকে ভাসমান গুদাম হিসাবে ব্যবহার করেন বলে তারাও জানতে পেরেছেন।
বৃহস্পতিবার চবক যে অভিযানটি পরিচালনা করেছে সেটি ‘ভাসমান জাহাজে ভোগ্যপণ্য মজুত রেখে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টির অপচেষ্টা রোধে বিশেষ অভিযান’ বলেই উল্লেখ করা হয়েছে। ওই অভিযানে দেখা যায়, নির্ধারিত তিন দিনের পরিবর্তে গাজীপুর লজিস্টিকস অ্যান্ড শিপিংয়ের মালিকানাধীন উম্মে কুলসুম নামে ছয়টি জাহাজ অতিরিক্ত ১২ দিন অবস্থান করছে-যেখানে ছিল প্রায় ৭ হাজার টন গম। অতিরিক্ত সময় ধরে অবস্থান করার কারণ হিসাবে পণ্যমূল্য বাড়ানোর একটা অশুভ প্রচেষ্টা বলে মনে করছে বন্দরের অভিযান টিম। এছাড়া নির্দেশনা উপেক্ষা করে সাগরে অবস্থান করায় ছয় জাহাজের পাশাপাশি লাইসেন্স, ফিটনেস ও অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থায় ত্রুটি থাকায় আরও বেশ কয়েকটি জাহাজকেও জরিমানা করা হয় বলে সূত্র জানিয়েছে।