
‘আমাকে এখানে প্রতিনিয়ত অত্যাচার করা হয়। খাবার খেতে দেয় না। গোসল করতে দেয় না। রুম বন্দি করে রাখা হয়েছে। আমাকে সাহায্য করুন প্লিজ। আমার ফোন মাঝেমধ্যে নিয়ে নেয়। আবার বাসায় টাকা চাওয়ার জন্য দেয়। আমি ভুল করেছি। আরও বড় ক্ষতির হাত থেকে আমাকে রক্ষা করুন।’ নারী পাচারকারী চক্রের মাধ্যমে চীনে যাওয়ার পর সেখানকার বন্দিদশা থেকে মোবাইল ফোনে এভাবেই যুগান্তরের কাছে বাঁচার আকুতি জানান নীলা (ছদ্মনাম)। তিনি বলেন, আমাকে উদ্ধার করতে ঢাকায় একটি মামলা হয়েছে। কিন্তু মামলা হওয়ার পরই বিষয়টি জেনে যায় চক্রের সদস্যরা। এখন আমার ওপর নির্যাতনের মাত্রা আরও বেড়ে গেছে।
শুধু নীলা একাই নন; গত ১৪ বছরে চীনে পাচার হওয়া কয়েকশ বাংলাদেশি তরুণীর অবস্থা তার মতো। এছাড়া নির্যাতনের হাত থেকে রেহাই পেতে সম্প্রতি কৌশলে দেশে ফিরে এসেছেন হেলেনা (ছদ্মনাম)। তিনি যুগান্তরকে বলেন, ‘আমাকে এবং আমার বান্ধবীকে চাকরির মিথ্যা প্রলোভন দেখিয়ে চীনে পাঠিয়েছিল প্রতারক চক্র। বাংলাদেশ থেকে আরও তরুণী সেখানে নিয়ে যাব-এমন আশ্বাস দিয়ে আমি দেশে ফিরলেও আমার বান্ধবী (নীলা) এখনো আটকা পড়ে আছে। পাচারকারীরা এখন আমাকেই চক্রের সদস্য হিসাবে ব্যবহার করতে চাচ্ছে। আমার মাধ্যমে আরও তিন-চারটা মেয়ে চীনে পাঠাতে চাচ্ছে ওরা। আমি যেভাবে সবকিছুতে জড়িয়ে গেছি, অন্য কোনো মেয়ে এভাবে প্রতারিত হোক, তা আমি চাই না।’
যুগান্তরের অনুসন্ধানে জানা যায়, লোভনীয় চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে বাংলাদেশ থেকে পাচার করা হচ্ছে তরুণীদের। একটি প্রভাবশালী চক্র নির্বিঘ্নে চালিয়ে যাচ্ছে এমন অপকর্ম। চক্রের নেতৃত্বে আছেন আব্বাস মোল্লা। তার প্রধান সহযোগী হলেন সিলভী নামের এক নারী। অন্য সদস্যদের মধ্যে আছেন-জাহিদুল ইসলাম ওরফে বাবু এবং আকাশসহ বেশ কয়েকজন। চক্রটির টার্গেট-অসহায় দরিদ্র পরিবারের সুন্দরী তরুণী। পাসপোর্ট, ভিসা এবং ইমিগ্রেশনসহ সবকিছুই করে দেন তারা। দেশের বিভিন্ন স্থানে জাল বিস্তার করেছে চক্রের সদস্যরা। যে তরুণী সাধারণত যে কাজ পছন্দ করেন তাকে ওই কাজের জন্যই মোটা অঙ্কের বেতনে চাকরির অফার দেওয়া হয়। চীনে পাঠানোর পর তাদের বিক্রি করে দেওয়া হয়। একেকজন তরুণীকে বিক্রি করা হয় ৫০ লাখ টাকায়। এসব ঘটনায় মামলা করার পর উলটো বিপাকে পড়ছেন ভুক্তভোগীরা।
পুলিশ ও ভুক্তভোগী তরুণীদের সঙ্গে কথা বলে এবং যুগান্তরের নিজস্ব অনুসন্ধানে উঠে এসেছে উল্লিখিত সব চাঞ্চল্যকর তথ্য। আরও জানা গেছে, পাচারকারী চক্রের সিন্ডিকেট অনেক শক্তিশালী। টার্গেট করা তরুণীদের পাসপোর্ট করা হয় মাত্র চার ঘণ্টার মধ্যে। সাধারণত পুলিশ ভেরিফিকেশন ছাড়া পাসপোর্ট দেওয়া হয় না। কিন্তু চক্রের সদস্যরা পাসপোর্টের যাবতীয় কজ সম্পন্ন করেন ভেরিফিকেশন ছাড়াই। শুধু তাই নয়, পাসপোর্ট নেওয়ার আগে তারা ব্যবহার করেন ভুয়া জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি কার্ড)। ভিসা পেতে সাধারণ মানুষের বেশ কয়েকদিন অপেক্ষা করতে হলেও চক্রের সদস্যরা দিনে দিনেই পেয়ে যান। কেউ বিদেশ যেতে চাইলে ইমিগ্রেশন কর্মকর্তারা সাধারণত বিদেশ যাওয়ার কারণ জানতে চান। এছাড়া আনুষঙ্গিক অনেক প্রশ্ন করেন। কিন্তু পাচার চক্রের সদস্যরা যাদের বিদেশ পাঠান ইমিগ্রেশনে তাদের কোনো প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয় না। ভুক্তভোগীরা জানিয়েছেন, পাচারকারীরা যেভাবে পাসপোর্ট অধিদপ্তর ও ভিসা সেন্টার কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করেছে; একইভাবে ম্যানেজ করছেন ইমিগ্রেশন কর্মকর্তাদের।
চীন থেকে দেশে ফিরে আসা ভুক্তভোগী ওই হেলেনা যুগান্তরকে বলেন, সিলভী নামের একটি মেয়ে আছে। চীনা নাগরিকের সঙ্গে তার বিয়ে হয়েছে। সিলভী এবং তার স্বামী মিলেই এ ব্যবসা করেন। সিলভী দম্পতির এ চক্রে আরও বেশ কয়েকজন লোক আছে। চক্রটি গত ১৪ বছর ধরে চীনে নারী পাচার করছে। তিনি বলেন, সিলভীর সঙ্গে আমার ফেসবুকে পরিচয় হয়। আমি বিউটি পার্লারে কাজ করতাম। আমার সঙ্গে কথোপকথনের একপর্যায়ে সিলভিয়া বলেন, ‘চীনে বিউটি পার্লারের কাজের চাহিদা অনেক বেশি। তুমি যেহেতু পার্লারের কাজ ভালো জানো, তাই তুমি চাইলে তোমাকে চীনের ভালো একটি পার্লারে অনেক টাকার চাকরি দিতে পারি।’ আমি তার প্রস্তাবে রাজি হওয়ার কারণেই আজ সর্বনাশ হয়েছে। তিনি বলেন, প্রতারক চক্রের খপ্পরে পড়ার বিষয়টি বুঝতে পারার পর চীনা নাগরিকদের বলি, ‘আমরা দেশে ফিরে যেতে চাই।’ তখন আমাদের জানানো হয়, আমার এবং আমার বান্ধবীকে ৫০ লাখ টাকা করে মোট এক কোটি টাকায় কিনে নেওয়া হয়েছে। তিনি আরও বলেন, আমি দেশে আসার পরপরই চারজন তরুণীর ভিসা করা হয়েছে। তাদের নিয়ে আমাকে চীনে যাওয়ার জন্য চাপ দিচ্ছে সিলভী ও তার চক্রের সদস্যরা। ইতোমধ্যেই সবার টিকিট কাটা হয়ে গেছে। কিন্তু আমি চাচ্ছি না যে, আমার মতো অন্য কোনো মেয়ের জীবন নষ্ট হোক।
ভুক্তভোগীরা জানিয়েছেন, আট বছর আগে এই চক্রে যোগ দিয়েছে সিলভী। এ চক্রের সদস্যরা প্রতি মাসে ১০-১৫ জন তরুণীকে চীনে পাঠান। যাদের চীনে পাঠানো হয়েছে তারা কখনো দেশে ফিরতে পারবে কিনা তা নিশ্চিত না। চীনা নাগরিকদের চাহিদা পূরণ না করতে পারার কারণে সম্প্রতি একজন বাংলাদেশি মেয়েকে সেখানে মেরে মাটিতে পুঁতে রাখা হয়েছে। সম্প্রতি চীনে নেওয়ার পর এক তরুণীর পরিবারের কাছ থেকে মুক্তিপণ নেওয়া হয়েছে। কিন্তু তাদের দেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়নি।
ভুক্তভোগী এক তরুণী জানান, পাচার চক্রের সদস্যদের বিরুদ্ধে বুধবার শাহ আলী থানায় মামলা করেছি। এরপর আমার ওপর হুমকির মাত্রা বেড়ে গেছে। মামলা করার সঙ্গে সঙ্গেই তাদের কাছে খবর পৌঁছে গেছে। থানা থেকেই মামলার বিষয়টি তাদের জানানো হয়েছে। আমাকে হত্যা করার আগে থানায় মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি করা হবে বলেও হুমকি দিচ্ছে। আমাকে হত্যা করতে মাত্র দুই লাখ টাকা লাগবে বলেও জানিয়েছে চক্রের সদস্য আব্বাস। শাহ আলী থানাতেই আমার নামে মামলা হবে এবং ওই থানার ওসিকে দিয়েই আমাকে গ্রেফতার করানো হবে বলে ভয় দেখানো হচ্ছে। আমার দায়ের করা মামলায় তাদের কিছুই হবে না বলেও জানিয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মামলা হওয়ার পর আত্মগোপনে থেকে পুলিশ প্রশাসনকে ম্যানেজ করার চেষ্টা করছে চক্রের সদস্যরা। মূল হোতা আব্বাসসহ একাধিক সদস্যের মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলেও তাদের পাওয়া যায়নি। তবে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় হোয়াটসঅ্যাপে কথা হয় মামলার আসামি ও পাচার চক্রের অন্যতম সদস্য জাহিদুল ইসলাম বাবুর সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘চীনে লোক পাঠানোর সঙ্গে আমার কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। আব্বাস এবং সিলভী এ কাজ করে থাকতে পারেন।’ আব্বাস-সিলভীর সঙ্গে আপনার সম্পর্ক কী-জানতে চাইলে বলেন, তারা আমার পরিচিত। অসহায় নারীদের আমি সহায়তা করি। এরই অংশ হিসাবে মৌ নামের এক তরুণীকে এক হাজার ৩০০ টাকা বাস ভাড়া দিয়ে গ্রাম থেকে ঢাকায় এনে বিউটি পার্লারে চাকরি দিয়েছি। পরে আব্বাসের সঙ্গে তার (মৌ) পরিচয় হয়। মামলা হওয়ার পর আব্বাস তার মোবাইল ফোন বন্ধ করে রেখেছে। আমি তার সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করছি।
পুলিশের অবহেলার বিষয়টি উল্লেখ করে তরুণী বলেন, আমি একজন মেয়ে মানুষ। কিন্তু মামলার এজাহারে পুলিশ আমার লিঙ্গ লিখেছে পুরুষ। আর আমি পেশায় বিউটি পার্লার কর্মী। কিন্তু এজাহারে লেখা হয়েছে পতিতা। এর চেয়ে দুঃখজনক আর কী আছে?
জানতে চাইলে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা শাহ সুলতান মাহমুদ যুগান্তরকে বলেন, চক্রের সদস্যদের বিষয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পেয়েছি। তাদের ধরতে প্রযুক্তিগত সহযোগিতা নেওয়া হচ্ছে। বিষয়টি নিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অন্যান্য ইউনিটও কাজ করছে। আশা করছি, শিগগিরই তাদের আইনের আওতায় আনতে পারব। এজাহারে লিঙ্গ এবং পেশা পরিবর্তনের কারণ জানতে চাইলে বলেন, ওটা ঠিক করে দেব।