Image description
চট্টগ্রামের ১৬ আসনে ‘যত নেতা তত গ্রুপ’ : জামায়াত চষে বেড়ালেও অস্পষ্টতা- ধোঁয়াশার রাজনীতি : জামায়াতের তৃণমূল নেতা-কর্মীরা কেন্দ্রীয়-নগর-জেলা নেতাদের কাছে ঘুরেফিরে প্রতিদিন একই প্রশ্ন করছেন: “আমরা কি ফেব্রুয়ারির ইলেকশনে যাবো”? জনগণ মুখিয়ে ১৬ বছর পর সুষ্ঠু সুন্দর নির্বাচনের প্রত্যাশায় : জনজোয়ারে ভেসে যাবে অন্য কোনো ‘খেলা’ “বাংলাদেশে পিআর পদ্ধতি সহজ হবে না; সহজ নয়” :সমাজচিন্তাবিদ ড. মইনুল ইসলাম

‘জনসমর্থন বিএনপির পক্ষেই। বিএনপি মানে ধানের শীষ। জিয়াউর রহমানের দল, খালেদা জিয়ার দল। সুষ্ঠু নিরপেক্ষ ভোটে জিতে বিএনপিই তো সরকার গঠন করবে এটা যুক্তির কথা। কিন্তু চট্টগ্রামের আনাচে-কানাচে চষে বেড়াচ্ছে জামায়াতে ইসলামী। তারা নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের সঙ্গেও হাতে হাত মিলিয়ে চলছে। আবার নির্বাচন চাইছে তারা পিআর পদ্ধতিতে। জনগণ তো পিআর-টিআর সিস্টেম কী তার কিছুই বোঝে না। জনগণ ইলেকশন চায়। আসলে জামায়াত কী চায়‘?

গতকাল বুধবার বন্দরনগরীর পাঁচলাইশ কাতালগঞ্জে একটি খাবার দোকানের (কুলিং কর্নার) সামনে জটলায় থাকা ৭/৮ জন যুবকের গল্পআড্ডা থেকে ওই কথাগুলো বলাবলি করতে শোনা গেল। এ সময় একজন বললেন, ‘ড. ইউনূস সরকার যদি ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনটা শেষ করতে না পারেন তাহলে তার ইজ্জত-সম্মান রক্ষা হবে না। জামায়াত-এনসিপির ফাঁদে পড়ে সেই মারাত্মক ভুল ড. ইউনূস কখেনোই করবেন বলে মনে হয় না’।

বন্দরনগরীসহ বৃহত্তর চট্টগ্রামের গ্রামে-গঞ্জে নির্বাচনী হাওয়া বইতে শুরু করেছে। বিকালে-সন্ধ্যায় মানুষজনের আলাপে-আড্ডায় নির্বাচন নিয়ে কথাবার্তা সরব। যদিও চায়ের কাপে ঝড় উঠতে আরো কিছুদিন লাগবে। চলতি অক্টোবর মাসের পর মাঝখানে আগামী নভেম্বর পার হলেই ডিসেম্বর মাসেই ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের শিডিউল ঘোষণা করবে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। গণঅভ্যুত্থানে পতিত পলাতক ফ্যাসিস্ট হাসিনার ‘রাতের ভোট’, ‘আমি, তুমি আর মামীর ভোট’, ‘ভোটারবিহীন ভোটের’ কারণে বিগত ১৬ বছর যাবত ভোটাধিকার-বঞ্চিত এদেশের জনগণ।

ভোটের ‘ক্ষুধা’ পূরণে ভোটাররা মুখিয়ে আছে আগামী রমজান মাসের আগে ফেব্রুয়ারিতে সুষ্ঠু নিরপেক্ষ সুন্দর একটি ঐতিহাসিক নির্বাচনের প্রত্যাশায়। বহু আকাক্সিক্ষত নির্বাচন নিয়ে একটা সন্দেহ-সংশয় কিংবা ধোঁয়াশা তৈরির মাধ্যমে গণতন্ত্রবিরোধী দেশি-বিদেশি অপশক্তি ও ষড়যন্ত্রকারীরা পর্দার আড়ালে এবং প্রকাশ্যে এখনো তৎপর। তবে নির্বাচনমুখী ঐক্যবদ্ধ জনজোয়ারে সব চক্রান্ত ভেসে যাবে। দেশকে অনির্দিষ্টকালব্যাপী নির্বাচন-বিহীন তথা গণতন্ত্রবিহীন রেখে ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের অন্য যে কোনো ‘খেলা’র নীলনকশার জাল ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে। এখানে-সেখানে রাজনীতি সচেতন সাধারণ মানুষের আলাপচারিতায় নির্বাচনমুখী এসব প্রত্যয় ও প্রত্যাশার কথাগুলো দিন দিন প্রবলভাবে ফুটে উঠছে।

বৃহত্তর চট্টগ্রামের মানুষ তুলনামূলক বেশি রাজনীতি-সচেতন। চট্টগ্রামকে বলা হয় আন্দোলন-সংগ্রাম, গণতন্ত্রের সূতিকাগার। বহু ঐতিহাসিক ঘটনা-অঘটন ও বাঁকে চট্টগ্রাম সাক্ষী। আবার, এই চট্টগ্রামকে বলা হয়, জাতীয়তাবাদী ও ইসলামী শক্তির শক্তপোক্ত ঘাঁটি। নির্বাচন-পূর্ব বর্তমান পর্যায়ে সচেতন মানুষজনের কথাবার্তা থেকে যেটা খুব সহজেই বোঝা যায়, চট্টগ্রামে জনসমর্থন বিএনপির দিকেই রয়েছে নিঃসন্দেহে। অতীতের সুষ্ঠু নির্বাচনগুলোর ফলাফলও তা-ই বলছে। কিন্তু সেই ‘জনসমর্থনের জোরে’র ওপর ভর এবং ভরসা করে এখনো ‘গভীর ঘুমে’ আচ্ছন্ন বিএনপি। এক পা দু-পা করে নির্বাচন ঘনিয়ে আসছে। অথচ বিএনপির নির্বাচনমুখী মাঠের তৎপরতা তেমন নেই।

বিএনপির কেন্দ্রীয় পর্যায়ের কোনো নেতা চট্টগ্রামে যখন মিটিং-মিছিলের কর্মসূচি দেন তখন কয়েক ঘণ্টার দৌঁড়ঝাঁপ। আবার ফিকে। নিস্তেজ। দলীয় কার্যালয়ে নেই ভিড়। নেই ভোটের আমেজ। বরং নির্বাচনকে সামনে রেখে চট্টগ্রাম মহানগর ও জেলার মোট ১৬ আসনে ‘যত নেতা তত গ্রুপ’ আর নেতায় নেতায় দ্বন্দ্ব-কলহ ক্রমেই প্রকট হচ্ছে। সেই সাথে তৃণমূলে দলের ভেতরে সম্ভাব্য এমপি প্রার্থী-জট নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা, পক্ষে-বিপক্ষে মেরুকরণ তৈরি হয়েছে এবং তা অব্যাহত রয়েছে। মহানগর ও জেলার অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ বিবেচিত নির্বাচনী আসনে বিএনপির পক্ষ থেকে এমপি প্রার্থী কে হচ্ছেন তা সংশ্লিষ্ট এলাকাবাসীরা তথা ভোটারও জানেন না। অথবা বিভ্রান্তিতে পড়ছেন। স্থানীয় দলীয় বিরোধ, গ্রুপিংয়ের সমস্যাগুলো কেন্দ্র থেকে নিষ্পত্তির জন্য নেই কার্যকর পদক্ষেপ।

অন্যদিকে আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে জামায়াতে ইসলামী নিজেদের অবস্থান মজবুত করা এবং জনসমর্থন আকর্ষণের টার্গেট নিয়ে সমগ্র চট্টগ্রামের আনাচে-কানাচে চষে বেড়াচ্ছে। মসজিদ, মক্তব-মাদ্রাসা, স্কুল-কলেজে, পাড়া-মহল্লায়, পেশাভিত্তিক প্রকাশ্যে এবং গুপ্তে নানান কৌশলে গণসংযোগ ও প্রচারণা চালাচ্ছে জামায়াত। চট্টগ্রামের ১৬টি নির্বাচনী এলাকায় প্রার্থী তালিকা চূড়ান্ত করায় সংশ্লিষ্ট এলাকাবাসীরা জেনে গেছেন জামায়াতের কে কোনো এলাকায় এমপি প্রার্থী হচ্ছেন। প্রার্থীদের সমর্থনে প্রচার সভা, লিফলেট, বই-পুস্তক বিতরণ চলছে। স্থানীয় সরকারি প্রশাসনের সঙ্গে সখ্যতা পাকাপোক্ত করে দলীয় অবস্থান সংহত করতে অতিমাত্রায় তৎপর জামায়াত। সেই সাথে নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ সংগঠনের স্থানীয় নেতা-কর্মীদের কাছে টানা, অমুসলিম সদস্যদের দলে ভেড়ানোর মাধ্যমে জনসমর্থনের পাল্লা ভারী করার নানামুখী চেষ্টা-চাতুর্য্য কৌশলে রীতিমতো মরিয়া।

যে প্রশ্ন জামায়াতের তৃণমূলে
জামায়াতে ইসলামীর আকস্মিক দাবি পিআর পদ্ধতিতে আগামী নির্বাচন হতে হবে। দাবি আদায়ে জামায়াত আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করেছে এবং মিছিল মিটিং নিয়ে মাঠে নেমেছে। অন্যদিকে অন্তর্বর্তী সরকার এবং নির্বাচন কমিশন (ইসি) আগামী রমজানের আগে ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথমার্ধে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের রোডম্যাপ ধরে অগ্রসর হচ্ছে। বাংলাদেশ সংবিধানে পিআর পদ্ধতি নেই। আবারো জনগণও পিআর পদ্ধতি বোঝেন না। তাহলে নির্বাচনী রোডম্যাপ ঘোষণার পর কার বিরুদ্ধে জামায়াতের আন্দোলন? জামায়াতের শীর্ষ নেতারা এটাও বলে আসছেন, নির্বাচন ফেব্রুয়ারিতে হতে হবে; এমনকি ডিসেম্বরে হলেও আপত্তি নেই। আবার এটাও বলছেন তারা, পিআর পদ্ধতিতে ছাড়া দেশে কোনো নির্বাচন হতে পারে না; কীসের নির্বাচন? নির্বাচনের পরিবেশ কোথায় আছে? ইত্যাদি। নির্বাচন নিয়ে জামায়াতের এহেন অস্পষ্ট, পরস্পরবিরোধী, দ্বিমুখী ও ধোঁয়াশায় ঘেরা অবস্থানের কারণে রাজনীতি সচেতন জনসাধারণের মাঝে বিভিন্ন প্রশ্ন ও সন্দেহ উঁকিঝুঁকি দিয়েছে যে, দীর্ঘ ১৬ বছর পর গণতন্ত্রে উত্তরণে জামায়াত আদৌ নির্বাচন চায় কিনা? পিআর-এর নেপথ্যে কী চায় দলটি?

খোঁজ-খবর নিয়ে জানা গেছে, জামায়াতের তৃণমূল পর্যায়ের নেতা-কর্মী-সমর্থকরা দলীয় ফোরামে অথবা ব্যক্তিগতভাবে কেন্দ্রীয়-নগর-জেলা নেতাদের কাছে পেলে ঘুরে ফিরে হরদম একটাই প্রশ্ন-সংশয় ব্যক্ত করছেনÑ ‘আমরা কি ফেব্রুয়ারির ইলেকশনে যাবো? পিআর পদ্ধতির দাবি কিভাবে পূরণ হবে? জনসাধারণ কিভাবে, কবে পিআর পদ্ধতি সম্পর্কে বুঝবেন? পিআর পদ্ধতি না হলে জামায়াত কী তাহলে ভোট বর্জন করবে? পিআর পদ্ধতির দাবি আদায় নাকি বর্তমান সংবিধান মাফিক ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন অনুষ্ঠানÑ এ প্রশ্নে সবমিলিয়ে জামায়াতের অভ্যন্তরেও বিশেষত তৃণমূল পর্যায়ে এক ধরনের ধোঁয়াশা, অস্পষ্টতা এবং দোদুল্যমানতা বিরাজ করছে। তৃণমূল নেতা-কর্মীরা গণসংযোগে ছুটছেন ঠিকই; কিন্তু পিআর পদ্ধতি নিয়ে জনসাধারণের প্রশ্নবাণে জর্জরিত হচ্ছেন প্রতিনিয়তই।

এদিকে পিআর (সংখ্যানুপাতিক হার) পদ্ধতিতে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কোনো কোনো মহলের দাবি প্রসঙ্গে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও সমাজ চিন্তাবিদ প্রফেসর ড. মইনুল ইসলাম দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, আমাদের বাংলাদেশে পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন ব্যবস্থা চালু করা সহজ হবে না। এবার তড়িঘড়ি করে তো সম্ভবই হবে না। কেননা ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সম্পন্ন করতেই হবে। বিলম্বের কোনো অবকাশ নেই। অবশ্য ভবিষ্যতের নির্বাচনে আমরা যদি উচ্চকক্ষে পিআর পদ্ধতি চালু করতে পারি তাহলে এর সুফল-কুফলগুলো কী বোঝা যাবে। বাংলাদেশে মূল সংসদে নিম্নকক্ষে পিআর পদ্ধতি সহজে হবে না; সহজে নয়।