
পার্বত্য চট্টগ্রামে বিচ্ছিন্নতাবাদি সশস্ত্র সন্ত্রাসী বাহিনী ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট-ইউপিডিএফকে সরাসরি সহযোগীতা করছে ভারত। হিন্দুত্ববাদি ভারত সরকারের প্রত্যক্ষ মদদে পাহাড়ে নৈরাজ্য সৃষ্টির মাধ্যমে রাষ্ট্রঘাতি অপতৎপরতায় লিপ্ত রয়েছে তারা। খোদ ভারতের মাটিতেই ওই সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর কমপক্ষে ছয়টি প্রশিক্ষণ ক্যাম্পের তথ্য পাওয়া গেছে। এসব ক্যাম্পে অস্ত্রের প্রশিক্ষণ নিচ্ছে তারা। শুধু তাই নয়, ওই সংগঠনের শীর্ষ নেতাদের অনেকের সেখানে বাড়ি ঘর, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এপারে খুন, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজিসহ নানা অপকর্ম করে বিনা বাধায় ভারতে ঢুকে পড়ছে ইউপিডিএফ সন্ত্রাসীরা। এই ক্ষেত্রে তাদের সহযোগীতা দিচ্ছে বিএসএফ। পার্বত্য অঞ্চলের নিরাপত্তা সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
সংশ্লিষ্টরা জানায়, তিন পার্বত্য জেলা থেকে বছরে আড়াইশ থেকে তিনশ কোটি টাকার চাঁদাবাজি করছে এই সন্ত্রাসী গোষ্ঠী ইউপিডিএফ। তার বিরাট অংশ ব্যয় করছে অস্ত্র গোলাবারুদ কেনায়। পার্বত্য চট্টগ্রামকে অস্থিতিশীল করতে সীমান্ত পথে আসছে ভারী যুদ্ধাস্ত্র আর গোলাবারুদ। এসব অস্ত্রের উৎসও ভারত। সাম্প্রতিককালে মিয়ানমারের আরাকান আর্মির হাত ধরেও ভারী আগ্নেয়াস্ত্র আসছে ইউপিডিএফ সন্ত্রাসীদের হাতে। ভারতেই বাংলাদেশ বিরোধী সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের আস্তানা রয়েছে এ অভিযোগ রয়েছে দীর্ঘদিনের। তবে সম্প্রতি খাগড়াছড়িতে কথিত একটি ধর্ষণের ঘটনাকে কেন্দ্র করে সন্ত্রাসী গোষ্ঠী ইউপিডিএফের নজিরবিহীন সন্ত্রাসী তা-বের পর এ বিষয়টি ফের আলোচনায় এসেছে।
দায়িত্বশীল সূত্রগুলো বলছে, ভারতের মাটিতে বিচ্ছিন্নতাবাদি গোষ্ঠীকে প্রশিক্ষণ দেওয়ার বিষয়টি বিভিন্ন পর্যায়ে সে দেশের সরকারের নজরে আনা হয়েছে। সর্বশেষ বিজিবি-বিএসএফ সীমান্ত সম্মেলনেও এ বিষয়টি উত্থাপন করে বাংলাদেশ। কিন্তু ভারত বিষয়টিকে পাত্তাই দিচ্ছে না। দায়িত্বশীল সূত্রগুলো বলছে, বিগত সাড়ে ১৫ বছর ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগ সরকারের নতজানু পররাষ্ট্রনীতি তথা ভারত তোষননীতির কারণে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেনি তৎকালীন সরকার। গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র জনতার গণ অভ্যুত্থানে হাসিনার পতনের সাথে সাথে ভারতীয় আধিপত্যবাদেরও পতন ঘটে। আর তাতেই বিক্ষুব্ধ ভারত তাদের সীমানায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব বিরোধী সশস্ত্র সন্ত্রাসী গোষ্ঠীকে আরো জোর মদদ দিতে শুরু করে। এ ধারাবাহিকতায় বিগত দেড় বছরে খাগড়াছড়িসহ পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকায় বেশ কয়েক দফা নৈরাজ্য সৃষ্টির অপচেষ্টা করেছে ইউপিডিএফ। সর্বশেষ গত সপ্তাহের শুরুর দিকে খাগড়াছড়িতে এক মারমা কিশোরীকে ধর্ষণের অভিযোগে নৈরাজ্য সৃষ্টি করে ইউপিডিএফ। অবরোধের নামে খাগড়াছড়ি জেলাকে অবরুদ্ধ করে সেখানে তারা দফায় দফায় বাঙালিদের হাটবাজার, বসতবাড়িতে অগ্নিসংযোগ, ভাঙচুর ও লুটতরাজ চালায়। তাদের নির্বিচারে গুলিবর্ষণে তিন উপজাতি নিহত এবং সেনা কর্মকর্তাসহ ১৫ জন আহত হয়েছে। এ সহিংসতার ঘটনায় ইউপিডিএফ সন্ত্রাসীদের ভারী অস্ত্র হাতে গুলিবর্ষণ করতে দেখা যায়। এরকম কয়েকটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও ভাইরাল হয়। স্থানীয়রা বলছেন, এরা ভারত থেকে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত, সেখান থেকেই অস্ত্র নিয়ে হামলায় অংশ নিয়েছে।
সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্রে ভারতে এ সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর ছয়টি ক্যাম্পের তথ্য পাওয়া গেছে। ক্যাম্পগুলো হলো- খাগড়াছড়ি জেলার সীমান্তবর্তী ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের ধলাই জেলার রতন নগর, খাগড়াছড়ির দীঘিনালা সীমান্তবর্তী ত্রিপুরার ধলাই জেলার টুইচামা, দীঘিনালা সংলগ্ন ত্রিপুরার নারায়ণপুর, একই এলাকার পঞ্চ রতন, খাগড়াছড়ি জেলার মহালছড়ি ও দীঘিনালা সংলগ্ন ত্রিপুরার ধলাই জেলার নারিকেল বাগান এবং অপর ক্যাম্পটি হলো পূর্ব সাবরুমে। এটি খাগড়াছড়ি-ফেনী সীমান্ত এলাকা যা রাঙামাটি ও খাগড়াছড়ি জেলার বাঘাইছড়ি ও দীঘিনালা সংলগ্ন এলাকায় অবস্থিত। জানা গেছে, ইউপিডিএফ এখন চারটি ভাগে বিভক্ত। সবচাইতে বড় গ্রুপটি হচ্ছে ইউপিডিএফ মূল হিসেবে পরিচিত। এ সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর চার শতাধিক সশস্ত্র ক্যাডার রয়েছে। তারাই মূলত ভারতের বিভিন্ন ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ নিচ্ছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দীর্ঘদিন ধরে ভারতের ওই ছয়টি ক্যাম্পে অস্ত্রের প্রশিক্ষণ নিচ্ছে সন্ত্রাসীরা। তারা পাহাড়ে নানা অপকর্ম করে নিরাপদে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে এসব ক্যাম্পে ঢুকে পড়ে। তাছাড়া শীর্ষ নেতাদের বিশেষ করে সশস্ত্র গ্রুপের নেতৃত্ব দানকারী অনেকের ওপারে বাড়িঘর ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানও রয়েছে। তারা সেখান থেকে অস্ত্র, গোলাবারুদ নিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। আবার নানা অপকর্ম করে অনেকটা নিরাপদেই সীমান্ত পাড়ি দিয়ে সেখানে চলে যায়। বিএসএফ তাদের সহযোগিতা করে। এসব সন্ত্রাসীরা ভারতের বিভিন্ন এলাকায় অবাধে চলাচল করে। তবে সীমান্তে বিএসএফ যেভাবে তাদের সহযোগিতা দেয় ভারতীয় পুলিশ তাদের না চেনার কারণে অনেক সময় গ্রেফতারও করে।
সর্বশেষ গত ২২ জানুয়ারি ভারতের অরুন্ধতীনগরের মিলনচক্র এলাকার আদর্শ পল্লী থেকে আগরতলা পুলিশ কর্তৃক ইপিডিএফ’র সশস্ত্র কমান্ডার সমাজ প্রিয় চাকমাকে দুই রাউন্ড তাজা কার্তুজ, বাংলাদেশি ২৫ হাজার টাকা এবং ভারতীয় দুই লাখ রুপিসহ আটকের খবর আসে ভারতীয় মিডিয়ায়। ২৩ জানুয়ারি অরুণাচল প্রদেশে ইপিডিএফ’র সশস্ত্র শাখার সদস্য রাজু চাকমাকে একে ৪৭ রাইফেল, দুইটি ম্যাগাজিন ও ৪৫ রাউন্ড গুলি ও বিপুল গোলাবারুদসহ আটক করে ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনী। বাংলাদেশে পাচারের পথে একটি বড় অস্ত্র চালান আটকও হয়েছে। গত ১৭ জানুয়ারি ভারতের মিজোরাম রাজ্যের মামিত জেলায় ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনী ছয়টি একে-৪৭ রাইফেল, ১০ হাজার ৫০টি কার্তুজ এবং ১৩টি ম্যাগাজিনসহ একটি বড় অস্ত্রের চালান আটক করে। ভারতীয় গণমাধ্যমের খবরে জানা যায়, এই অস্ত্রগুলো বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রেরণের উদ্দেশে ইউপিডিএফ (মূল) এবং মিয়ানমারের চীন ন্যাশনাল ফ্রন্টের (সিএনএফ) মধ্যে চোরাচালানের অংশ ছিল। অভিযানে পাঁচজনকে গ্রেফতার করা হয়, যাদের মধ্যে সিএনএফের এক নেতাও ছিল।
খাগড়াছড়ির আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত বাহিনীর একটি সূত্র জানায়, খাগড়াছড়ি এবং গুইমারায় অস্ত্রবাজির সাথে জড়িত ইউপিডিএফ সন্ত্রাসীদের অনেকেই সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ওপারে তাদের আস্তানায় আশ্রয় নিয়েছে। পার্বত্য এলাকায় বাংলাদেশ সীমান্তে এখনো পুরোপুরি নিরাপত্তা বলয় আনা যায়নি। আর এ সুযোগে দুর্গম এলাকা পাড়ি দিয়ে সন্ত্রাসীরা সহজে পালাতে পারে। ভারত সীমান্তে নিরাপত্তা নিñিদ্র হওয়ার পরও বিএসএফের সহযোগিতায় এসব সন্ত্রাসীরা সহজেই ভারতে যেতে পারে।
এদিকে খাগড়াছড়িতে অবরোধ প্রত্যাহার করলেও ফের নতুন করে সংঘাতের প্রস্তুতি নিচ্ছে ইউপিডিএফ। আর এক্ষেত্রে তাদের প্রত্যক্ষ সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছে ফ্যাসিবাদের দোসর কয়েকজন নেতা। ভারতের প্রত্যক্ষ মদদও রয়েছে পাহাড়কে অস্থিতিশীল করার পেছনে। স্থানীয়রা বলছেন, কথিত ধর্ষণের ঘটনাটি ছিল মূলত অজুহাত। আর ওই ঘটনাকে কেন্দ্র করে নৈরাজ্য সৃষ্টি করে ইউপিডিএফ। মারমা কিশোরীকে অপহরণের ঘটনায় শয়ন শীল নামে এক যুবক ধরা পড়ে। আর যে পাঁচ জনের নাম এসেছে তাদের মধ্যে দুই জন চাকমা, দুই জন মারমা এবং এক জন হিন্দু। সেখানে কোনো মুসলমান ছিল না। তাছাড়া ওই কিশোরীকে উদ্ধারের পর মেডিক্যাল টেস্টে ধর্ষণেরও কোনো আলামত মেলেনি। কিশোরী মারমা সম্প্রদায়ের হলেও মারমা জনগোষ্ঠীর পক্ষ থেকে ওই ঘটনা নিয়ে কোনোরকম রাজনীতি না করার আহ্বান জানানো হয়। পাহাড়ের অন্য সংগঠনগুলোও অপরাধীদের গ্রেফতারের দাবি জানিয়ে কোনোরকম নৈরাজ্য সৃষ্টি না করার আহ্বান জানান। অথচ কথিত ধর্ষণের ঘটনাকে পুঁজি করে পাহাড়ি বাঙালি দাঙ্গা সৃষ্টির সব অপচেষ্টা চালিয়েছে ইউপিডিএফ। তারা ‘জুম্ম ছাত্র জনতা’র ব্যানারে অবরোধসহ নাশকতামূলক কর্মকা-ে জড়িয়ে পড়ে। পরে দেখা যায় জুম্ম ছাত্র জনতার নেতা মূলত তারাই। খাগড়াছড়িতে সহিংসতার সময় ইউপিডিএফ সন্ত্রাসীরা সাধারণ উপজাতিদের ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে। অথচ এ নৈরাজ্যের সাথে গুটিকয়েক অপরাধী ছাড়া উপজাতিদের কোনো সংশ্লিষ্টতা ছিল না।
জানা গেছে, এ নৈরাজ্যে তাদের সহযোগিতা করেছে ফ্যাসিবাদের দোসরেরা। ঢাকায় বসে কতিপয় বামপন্থী সুশীল প্রকৃত ঘটনা না জেনে কথিত ধর্ষণের ঘটনার প্রতিবাদে বক্তৃতা-বিবৃতি দিয়ে মূলত বিচ্ছিন্নতাবাদিদের পক্ষাবলম্বন করেছে। খাগড়াছড়ির স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, সামনের দিনগুলোতেও এ ধরনের রাষ্ট্রঘাতি অপতৎপরতা চলতে পারে। নৈরাজ্যরোধে তারা সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে কঠোর অভিযানেরও দাবি তুলেছেন।