
ঢাকায় যখন জাতীয় পার্টির অফিসে অগ্নিসংযোগ করা হচ্ছে; কয়েকটি রাজনৈতিক দল এরশাদ প্রতিষ্ঠিত দলটিকে নিষিদ্ধের দাবিতে আন্দোলন করছে; তখন রংপুর বিভাগে দলটির নেতাকর্মীরা আরো চাঙ্গা হচ্ছেন। বিগত তিনটি বিতর্কিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সঙ্গে ‘আসন ভাগাভাগি’ করে সংসদে যাওয়ায় প্রতিবাদে যারা দলের নীতি নির্ধারকদের গালিগালাজ করতেন; এখন তারাও জাতীয় পার্টির পক্ষে কথা বলছেন। বিশেষ করে জামায়াতের ব্যপক প্রচারণায় মূলত জাতীয় পার্টির নেতাকর্মীরা সক্রিয় হয়ে উঠছেন। সুশীল সমাজ, বুদ্ধিজীবী, বিভিন্ন পেশাজীবী এবং রংপুর-গাইবান্ধা-কুড়িগ্রামের ১০টি সংসদীয় আসনের বিভিন্ন এলাকা সরেজমিন ঘুরে স্থানীয় মানুষদের সঙ্গে কথা বলে এমন চিত্র পাওয়া গেল। গত ১৭ সেপ্টেম্বর রাতে যখন রংপুর নগরীর সেন্ট্রাল রোডের জেলা ও মহানগর জাতীয় পার্টি কার্যালয়ে দলটির নেতাকর্মীদের সঙ্গে আড্ডায় বসেছিলাম; তখন দলটির কয়েকজন নেতা জানান, “জাতীয় পার্টিকে নিষিদ্ধের দাবি জানিয়েছে কয়েকটি দল। পরিস্কারভাবে বলছি, ‘নো জাতীয় পার্টি রংপুরে নো নির্বাচন।’ জাতীয় পার্টিকে নিষিদ্ধের চেষ্টা হলে রংপুর বিভাগে কোনো নির্বাচন হতে দেয়া হবে না।
’৯১ সালে ‘নো এরশাদ নো নির্বাচন’ এবং ২০০৬ সালে ইয়াজউদ্দিনের শাসনামলে ‘নো এরশাদ নো নির্বাচন’ দাবি ওঠায় ২০০৭ সালের ২২ জানুয়ারির নির্বাচন ভন্ডুল হয়েছিল ওয়ান ইলেভেনে ক্ষমতা দখলের মাধ্যমে। এবার জাপাকে নির্বাচন করতে না দিলে আট জেলায় কোনো নির্বাচন হতে দেয়া হবে না।” আড্ডায় দলটির প্রেসিডিয়াম সদস্য ও মহানগর জাতীয় পার্টির সাধারণ সম্পাদক এস এম ইয়াসির জানান, জাতীয় পার্টি আগামী সংসদ নির্বাচনে অংশ নেবে এবং রংপুর বিভাগের ৩৩টি আসনে শক্তিশালী প্রার্থী দেবে। রংপুর জাতীয় পার্টির দুর্গ ছিল, আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে। আমাদের ওপর চোখ তুলে তাকানোর চেষ্টা রংপুরের জনগণকে সঙ্গে নিয়ে প্রতিরোধ করা হবে। তার দাবি রংপুর বিভাগের ৩৩টি আসনের জাতীয় পার্টি হারানো আসনগুলো পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হবে। সেই সঙ্গে আগামী নির্বাচনে সব অসম্ভবকে সম্ভব করে অনেক অনেক বেশি আসনে জয়ী হবে। আওয়ামী লীগের নীরবে থাকা ভোটারগণ লাঙ্গলে ভোট দেবে সে দাবিও করেন তিনি।
রংপুর থেকে গাইবান্ধা-১ সুন্দরগঞ্জের দূরত্ব প্রায় ৫০ কিলোমিটার। বাসের পাশাপাশি ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার যাতায়াত এই রুটে। যেতে যেতে চোখে পড়ে পাকা রাস্তার দু’ধারে সবুজের সমারোহ। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের পোষ্টার। পথের ধারের সাপ্তাহিক হাট-বাজারে প্রচ- ভীড়। কর্মব্যস্ত স্থানীয়রা জানালেন, ২০১৪ সাল থেকে দেশে তিনটি জাতীয় নির্বাচন হলেও গাইবান্ধা-১ আসন সুন্দরগঞ্জে ভোট হয়েছে পাঁচ বার। ’১৪ সালের প্রার্থী ও ভোটারবিহীন নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগের এমপি লিটন মারা যাওয়ায় আরো দুই বার উপনির্বাচন হয়েছে। স্থানীয় ভোটারদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ’৯১ সালে জাপার হাফিজ উদ্দিন প্রমাণিক, ’৯৬ সালে জাপার ওহিদুজ্জামান বাদশা, ২০০১ সালে জামায়াতের আবদুল আজিজ, ২০০৮ সালে জাপার কর্ণেল (অব.) কাদের খান এমপি হন। ২০১৪ সালে বিতর্কিত নির্বাচনে আওয়ামী লীগের এমপি লিটন খুনের পর উপনির্বাচনে আওয়ামী লীগের এমপি হন আবুল কালাম আজাদ। তিনি মারা যাওয়ায় দ্বিতীয় দফায় উপনির্বাচনে জাতীয় পার্টির শামিম হায়দার পাটোয়ারি কয়েকদিনের জন্য এমপি হন। ২০১৮ সালের রাতের ভোটে জাপা এবং ২০২৪ সালের ডামি নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী বিজয়ী হন। কিন্তু এবার জামায়াত ব্যাপক ভাবে মাঠে নেমেছে। এ আসনে বিএনপি দুর্বল এবং জাতীয় পার্টি ও জামায়াত শক্তিশালী। সুন্দরগঞ্জের ভোটার একটি রাজনৈতিক দলের কেন্দ্রীয় নেতা রওশন জানান, এবার ভোটের আগেই ভোটারদের মধ্যে জামায়াত ঠেকাও আওয়াজ উঠেছে। নির্বাচনে জামায়াতের প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি, জাতীয় পার্টিসহ অন্যান্য যে দলের যে প্রার্থী শক্তিশালী হবেন তাকেই সবাই ভোট দেবে।
রংপুর টাউন হলে সাংস্কৃতিসেবী, ভাওয়াইয়া শিল্পী, নাট্ট ব্যাক্তিত্বদের এক আড্ডায় তারা জানান, রংপুর বিভাগে জাতীয় পার্টি ক্রমান্বয়ে শক্তিশালী হয়ে উঠছে। দলটির বিরুদ্ধে যতই প্রচারণা এবং দলটিকে খ-বিখ- করা হচ্ছে ততই এরশাদ প্রেমীরা ঐকবদ্ধ হচ্ছেন। সাংস্কৃতির ব্যক্তিত্ব মকসুদার রহমান মুকি বলেন, আমরা নির্বাচন চাই। নির্বাচনে যারাই ক্ষমতায় আসুক না কেন ভোট হওয়া দরকার। এখানে এখনো মোস্তাফিজুর রহমান মোস্তফা ব্যপক জনপ্রিয়। জাপাকে ঠেকানো জামায়াত-বিএনপির পক্ষ্যে সম্ভব নয়। সাংস্কৃতির ব্যক্তিত্ব আমিনুল ইসলাম হারুন বলেন, শুনছি জাতীয় পার্টি নিষিদ্ধের দাবি উঠেছে। জাতীয় পার্টির বিরুদ্ধে ক্যাম্পেইন হলে নির্বাচনের আগে দলটি আরো শক্তিশালী হবে। রংপুর বিভাগে জাতীয় পার্টি ক্রমান্বয়ে সুসংগঠিত হচ্ছে। ৩৩ আসনের মধ্যে ২৫টি আসন বিজয়ী হওয়ার টার্গেট করে দলটি প্রস্তুতি নিচ্ছে বলেও একজন নেতা দাবি করেন।
রংপুরের রাজনীতি এবং ভোটের মাঠে এখনো যে জাতীয় পার্টি ফ্যাক্টর তা বোঝা গেল চার দিন ধরে কয়েকটি নির্বাচনী আসন ঘুরে বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষের সঙ্গে কথা বলে। জাতীয় পার্টি নির্বাচন করতে না পারলে ভোটের চিত্র হবে একরকম। আর দলটি নির্বাচন করতে পারলে ভোটের চিত্র হবে অন্যরকম। রংপুর-৪ (পীরগাছা-কাউনিয়া) আসনের ভোটার সরকারি চাকরিজীবী কামরুল হাসান জানালেন, রংপুরের ছয়টি আসনের মধ্যে এ আসনে বিএনপির সম্ভাব্য প্রার্থী ঘরে ঘরে গিয়ে প্রচারণা চালাচ্ছেন। ধারণা করা হচ্ছে ১৯৭৯ সালের দ্বিতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর বিএনপি এবার আসনটি পেতে পারে। কিন্তু দু’টি উপজেলার ভোটারদের মধ্যে আঞ্চলিকতার বিভেদ রয়েছে। বিশেষ করে কাউনিয়ার হারাগাছের মানুষকে পীরগাছার মানুষ পছন্দ করেনা। কিন্তু প্রতিবার সব দলই বেছে বেছে হারাগাছের টাকাওয়ালাদের প্রার্থী দেয়। বিএনপি হারাগাছের প্রার্থী দেবে ধারণা করা হচ্ছে। সে ক্ষেত্রে জাতীয় পার্টি যদি পীরগাছা থেকে প্রার্থী দেয় তাহলে ভোটের চিত্র পাল্টে যাবে।
রংপুরের শহীদ আবু সাঈদের ম্যূরালের পাশে পার্কের মোড়ে প্রতিদিন বিকেলে মানুষের জটলা হয়। নানা বয়সী ছেলেমেয়েরা বিকেলে আড্ডা দেয়। তাদের কয়েকজন স্থানীয় সাংবাদিকের সঙ্গে দেখে পরিচয় জেনে জানতে চাইলেন, জাতীয় পার্টি কি ফের ভাঙছে? উত্তর দেয়ার আগেই তাদের একজন বললেন, জাতীয় পার্টি বলতে কিন্তু এরশাদ পরিবারকে বোঝানো হয়। দল যত খন্ডই হোক না কেন, এরশাদ পরিবারের সদস্যরা যে খন্ডে থাকবেন তারাই হবে দলের মূল শ্রোত। অন্যদের দিয়ে দলকে ব্রাকেটবন্দী করে লাভ নেই। চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে ‘স্যার জাতীয় পার্টি কি নিষিদ্ধ হচ্ছে?’ বললেন, বর্তমান প্রশাসনে জামায়াত বেশি। আর জামায়াত এখন জাপার নিষিদ্ধের দাবিতে আন্দোলন করছে। ঢাকার সাংবাদিক জবাব দেয়ার আগেই তাদের অপরজন বললেন, জাতীয় পার্টি নিষিদ্ধে দাবি যারাই করবে তাদের ভোট কমবে। আর রংপুরে জাপার ভোট বাড়বে। আওয়ামী লীগের আয়োজিত নির্বাচন করায় জাতীয় পার্টি নিষিদ্ধে দাবি করছে জামায়াত। অথচ একই কাজ করেছে ইসলামী আন্দোলন নামের চরমোনাইয়ের পীরের দল। আওয়ামী লীগের দালাল পীরের দলকে সঙ্গে নিয়ে হাসিনার আরেক দালাল জাতীয় পার্টি নিষিদ্ধের দাবি করছে। জামায়াতের কি বিপরীত্য রাজনীতি! অবশ্য আগের রাতে জাহাজ কোম্পানি মার্কেটের ব্যবসায়ী ফারুক আহমেদ জাতীয় পার্টি নিষিদ্ধের দাবি প্রসঙ্গে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছেন, জাতীয় পার্টি তার নিজের রাজনীতি করে। আওয়ামী লীগের ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করতে জাতীয় পার্টির ’১৪, ’১৮, ’২৪ সালের নির্বাচনে অংশ নেয়া যদি অপরাধ হয়, তাহলে ড. কামাল হোসেনকে হায়ার করে নেতা বানিয়ে ’১৮ সালের নির্বাচনে অংশ নেয়ার অপরাধে বিএনপির নিষিদ্ধে দাবি তোলা উচিত। আর জামায়াত কার ইন্ধনে জাতীয় পার্টি নিষিদ্ধের দাবি করছে তা সবাই বোঝে। আমরা স্পষ্টভাবে বলতে চাই জাতীয় পার্টিকে বাদ দিয়ে রংপুরে কোনো নির্বাচন হতে দেয়া হবে না।
রংপুর বিভাগের ১০টি সংসদীয় আসন ঘুরে বিভিন্ন জনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ঢাকার কাকরাইলে জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় কার্যালয় ভাঙচুর এবং অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটলেও উত্তরাঞ্চলের রংপুর বিভাগের রাজনীতি ও নির্বাচনে দলটি এখনো বড় ফ্যাক্টর। নিষিদ্ধের দাবিতে ঢাকায় কয়েকটি দল আন্দোলন করলেও দলটির নেতারা আগামী ফেব্রুয়ারি মাসে অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেওয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। দলটির নেতাদের ধারণা রংপুর এখনো জাতীয় পার্টির দুর্গ হয়েই রয়েছে। বিভাগের ৩৩টি আসনে শক্তিশালী প্রার্থী দিয়ে নির্বাচনে অংশ নিলে অভাবনীয় ফল পাওয়ার আশা করছে দলটির জেলা-উপজেলা পর্যায়ের নেতারা। বিশেষ করে ’৯১ ও ’৯৬ সালের নির্বাচনী ফলাফলের মতোই দলটি এবার কমপক্ষে ১৫ থেকে ২০টি আসনে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে বিজয়ী হতে পারবে। এর আগে দলটির কো-চেয়ারম্যান রংপুর মহানগর সভাপতি ও সাবেক সিটি মেয়র মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা বলেছেন, এবার আওয়ামী লীগের নীরব থাকা কর্মী-সমর্থকরা জাতীয় পার্টির প্রার্থীকেই ভোট দেবেন।