
অভিবাসন নীতি কঠোর করেছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)। এতে করে ইউরোপের দেশগুলোতে আশ্রয়প্রার্থী বাংলাদেশিদের মধ্যে আতঙ্ক বাড়ছে। অনেকের ভবিষ্যত অনিশ্চিত হয়ে উঠেছে। গত ২৫ সেপ্টেম্বর একটি চার্টার্ড ফ্লাইটযোগে ২৯ জন বাংলাদেশিকে ফেরত পাঠিয়েছে। এর আগে মার্চ মাসেও একইভাবে ৬০ জনকে ফেরত পাঠানো হয়। কূটনৈতিক সূত্র দাবি করেছে, ইইউ’র কঠোর অভিবাসন-নীতির কারণে দ্রুত নিষ্পত্তি করা হচ্ছে রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থীদের আবেদন।
ইউরোপীয় কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদনের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান বর্তমানে তৃতীয়। নতুন অভিবাসন-নীতি অনুযায়ী আবেদন পর্যালোচনা করে প্রত্যাখ্যান হওয়া অভিবাসীদের নিজ দেশে ফেরত পাঠানো হবে। বাংলাদেশিদের আশ্রয়ের আবেদন প্রত্যাখ্যানের হার প্রায় ৯৬ শতাংশ। তাই ইউরোপ থেকে ফেরত পাঠানোর হার বাড়তে পারে বলে ধারণা করছেন পরররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা। ঢাকার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সূত্রে জানা গেছে, গত ২৫ সেপ্টেম্বর বৃহস্পতিবার ইউরোপের গ্রিস, ইতালি এবং সাইপ্রাস থেকে আরও ২৯ জনকে ইইউ’র একটি চার্টার্ড ফ্লাইটে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো হয়েছে। ফ্লাইটটি ইসলামাবাদ হয়ে বৃহস্পতিবার সকাল ৮টায় ঢাকা এসে পৌঁছায়। ফিরে আসা ব্যক্তিদের মধ্যে ইতালি থেকে ১৬ জন, গ্রিস ৯ এবং সাইপ্রাস থেকে ৪ জনকে ফেরত পাঠানো হয়েছে বলে জানা গেছে। এই ২৯ জন ঢাকায় এসে পৌঁছালেও বাকিরা কবে আসবেন তা জানা যায়নি। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, ফেরত আসা ব্যক্তিদের অধিকাংশই তুরস্ক এবং লিবিয়া হয়ে অবৈধ উপায়ে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে গিয়েছিল। তবে এর মধ্যে গত বছরের ৫ আগস্টের পর গিয়েছিল কি না তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
চলতি বছর ইউরোপীয় সীমান্ত সংস্থা ফ্রন্টেক্স ৬০ জনের বেশি বাংলাদেশিকে প্রথমবারের মতো গত মার্চে একটি চার্টার্ড ফ্লাইটে ঢাকায় ফেরত পাঠায়। গ্রিসে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাস জানিয়েছে, ইউরোপীয় ইউনিয়নের বিভিন্ন দেশ ইতালি থেকে ২ জন, রোমানিয়া থেকে ৯ জন, চেক প্রজাতন্ত্রের ২ জন, ফ্রান্সের ৩ জন, মাল্টার ২ জন, স্পেনের ৪ জন, সুইডেন থেকে ২ জন ও সাইপ্রাসে ২০ জন বাংলাদেশি অভিবাসী ওই ফ্লাইটে ছিলেন। দূতাবাস জানিয়েছে, বিমানে যারা ছিলেন, তাদের আশ্রয়ের আবেদন খারিজ করা হয়েছিল। এটি ছিল চলতি বছরে বাংলাদেশি নাগরিকদের জন্য প্রথম জোরপূর্বক প্রত্যাবর্তন ফ্লাইট। দেশে ফিরে বাংলাদেশিরা জানান, তারা ইউরোপের বিভিন্ন দেশে বসবাস করছিলেন। গ্রিস থেকে ফেরত আসা এক বাংলাদেশি জানান, তিনি এথেন্সের একটি ক্যাম্পে ৭-৮ মাস ধরে আটক ছিলেন। ওই ক্যাম্পে হাজার হাজার বাংলাদেশি আটক আছেন। ইতালির বাংলাদেশ দূতাবাস সূত্রে জানা গেছে, সেদেশ থেকে ফেরত পাঠানো ১৬ জনের মধ্যে ১৩ জন ডাকাতি, পকেটমারা, চুরি, মাদকসহ বিভিন্ন ধরনের অপরাধে জড়িত ছিল।
দীর্ঘ কয়েক মাস আলোচনার পর গত মার্চে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) অনিয়মিত অভিবাসীদের দেশে ফেরত পাঠানোর কাজ দ্রুততর করার জন্য নতুন পরিকল্পনা প্রকাশ করেছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অভিবাসন নীতি কঠোর করার জন্য ইইউ চাপে রয়েছে। ইউরোপীয় কমিশন ‘প্রত্যাবর্তন কেন্দ্র’ বা ‘রিটার্ন হাব’ গঠনের একটি প্রস্তাব উত্থাপন করেছে। কিছু সদস্য দেশ এই উদ্যোগের পক্ষে থাকলেও, মানবাধিকার সংস্থাগুলো এর কঠোর সমালোচনা করেছে। বর্তমানে ইইউ’র সদস্য দেশগুলোতে অনিয়মিত অভিবাসীদের বহিষ্কারের হার ২০ শতাংশেরও কম। এই হার বাড়ানোর লক্ষ্যে ব্রাসেলস সদস্য রাষ্ট্রগুলোকে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে বলছে।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের পরিকল্পনা অনুযায়ী, সদস্য রাষ্ট্রগুলোকে ইইউ’র বাইরের অঞ্চলে অভিবাসীকেন্দ্র স্থাপনের অনুমতি দেওয়া হবে। যাদের আশ্রয়ের আবেদন প্রত্যাখ্যান হয়েছে এবং যারা দেশ ছাড়ার আইনি নির্দেশের আওতায় রয়েছেন, তাদের নতুন ‘রিটার্ন হাব’-এ পাঠানো হবে। ইইউ নিজস্ব কোনও কেন্দ্র পরিচালনা করবে না, বরং সদস্য দেশগুলোর ওপর এই দায়িত্ব ছেড়ে দেবে। কেন্দ্রগুলোর আইনি কাঠামো আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে পরিচালিত হবে। যারা ইউরোপ ত্যাগ করতে অস্বীকৃতি জানাবেন, তাদের জন্য নিষেধাজ্ঞা, পরিচয়পত্র বাজেয়াপ্ত করা এবং আটক রাখার মতো ব্যবস্থা নেওয়া হতে পারে। এক দেশের নেওয়া সিদ্ধান্ত অন্য দেশেও কার্যকর হবে, যেমন- অস্ট্রিয়ায় নেওয়া সিদ্ধান্ত স্পেনেও প্রয়োগ করা যাবে। ইইউ’র নতুন পরিকল্পনা প্রসঙ্গে গ্রিসে বাংলাদেশ দূতাবাসের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে জানান, অনেকেই আশ্রয়-আবেদন এক দেশ থেকে প্রত্যাখ্যান হওয়ার পর পালিয়ে আরেক দেশে গিয়ে আবেদন করেন। নতুন নিয়ম অনুযায়ী সেই সুযোগ আর নেই।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, ইউরোপের দেশগুলোতে বিপুল সংখ্যক অভিবাসী প্রবেশ করার পর থেকে তাদের অ্যাসাইলাম পলিসি সংস্কার করার কাজ শুরু হয়। কয়েক বছরের প্রচেষ্টায় গত বছর ইউরোপের পার্লামেন্টে পলিসি সংস্কারের অনুমোদন মেলে। এই পলিসির আওতায় দ্রুত রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদনগুলো নিষ্পত্তি করা হবে। তাতে করে যাদের আবেদন প্রত্যাখ্যান করা হবে, তাদেরকে দ্রুত নিজ নিজ দেশে ফেরত পাঠানো হবে।
১২ অবৈধ পথে ইউরোপযাত্রা
বাংলাদেশ থেকে ১২টি অবৈধ পথে ইউরোপে যাচ্ছেন অভিবাসনপ্রত্যাশীরা। এসব অবৈধ পথের মধ্যে শীর্ষে রয়েছে ঢাকা থেকে আকাশপথে দোহা-মিসর হয়ে লিবিয়া এবং পরে সাগরপথে মূল গন্তব্য ইতালি। ৪০ শতাংশ বাংলাদেশি অবৈধ অভিবাসনপ্রত্যাশী এই পথ ব্যবহার করেন। অনিয়মিত অভিবাসীদের ওপর করা এক গবেষণায় এসব তথ্য উঠে এসেছে। গবেষণায় বলা হয়, বাংলাদেশি অবৈধ অভিবাসনপ্রত্যাশীদের ইউরোপে পছন্দের গন্তব্যের মধ্যে রয়েছে ইতালি, জার্মানি, গ্রিস, সাইপ্রাস, অস্ট্রিয়া, তুরস্ক ও ফ্রান্স। ভাগ্য ফেরানোর স্বপ্ন নিয়ে প্রতিবছর কয়েক হাজার বাংলাদেশি অবৈধ পথে ইউরোপের বিভিন্ন দেশের উদ্দেশে যাত্রা করেন।
লিবিয়া থেকে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ২০০৯ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত ৬২ হাজার ৫৮৩ জন বাংলাদেশি ইউরোপের বিভিন্ন দেশে গেছেন। ঝুঁকিপূর্ণভাবে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিতে গিয়ে অভিবাসীবাহী নৌযান মাঝেমধ্যে ডুবে যায়। আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার (আইওএম) তথ্য অনুযায়ী, এ বছর ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপ যাওয়ার পথে ২ হাজার ২৫০ জনের বেশি মানুষের প্রাণ গেছে।
প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, অবৈধ অভিবাসীদের জন্য বেশি ব্যবহৃত অন্য পথগুলো হলো ঢাকা-তুরস্ক-গ্রিস-আলবেনিয়া-কসোভো-সার্বিয়া-হাঙ্গেরি-অস্ট্রিয়া; ঢাকা-তুরস্ক-গ্রিস-আলবেনিয়া-কসোভো-সার্বিয়া-ক্রোয়েশিয়া-হাঙ্গেরি-অস্ট্রিয়া-জার্মানি এবং ঢাকা-তুরস্ক-গ্রিস-আলবেনিয়া-কসোভো-সার্বিয়া-ক্রোয়েশিয়া-হাঙ্গেরি-অস্ট্রিয়া-ইতালি। গবেষণায় বলা হয়, অবৈধ অভিবাসীদের মধ্যে ২২ শতাংশের মতে, ইউরোপে উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ রয়েছে। ৩৩ শতাংশ বলেন, শিক্ষা অনুযায়ী প্রত্যাশিত চাকরি পাওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তায় তাঁরা ঝুঁকি জেনেও অবৈধ পথে ইউরোপমুখী হয়েছেন। এ ছাড়া দেশে কর্মসংস্থানের কম সুযোগ, চাকরিতে স্বল্প বেতন, দেশের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে অসন্তুষ্টি তাঁদের অনিয়মিত অভিবাসী হওয়ার পথে ঠেলে দিয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সামরিক বাজেট বাড়াচ্ছে ইইউ। তাদেরকে ন্যাটো এবং একইসঙ্গে ইউক্রেনকেও যুদ্ধ পরিচালনার অর্থ দিতে হচ্ছে। আর তাতে করে চাপ বাড়ছে ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোতে। গত ১০ সেপ্টেম্বর ‘আশ্রয়-আবেদন বাতিল হওয়া আশ্রয়প্রার্থীদের নিজ নিজ দেশে ফেরত পাঠানোর প্রক্রিয়া দ্রুত হওয়া দরকার’ বলে মন্তব্য করেছেন ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ফন ডেয়ার লাইয়েন।
প্রেসিডেন্ট লাইয়েন বলেন, আবেদন বাতিল হয়ে যাওয়া আশ্রয়প্রার্থীদের নিজ নিজ দেশে ফেরত পাঠানোর ক্ষেত্রে আমাদেরকে আরও দায়িত্বশীল হতে হবে। এমন অবস্থা হওয়া উচিত নয় যে, ইউরোপে থাকার যাদের আইনি অধিকার নেই, তাদের মাত্র ২০ ভাগ ফেরত যাচ্ছেন।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের তথ্য বলছে, ২০২৪ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত ৫৭ হাজার ৫৫০ জন বাংলাদেশি নাগরিক প্রথমবার আশ্রয়ের জন্য আবেদন করেছেন। আর ২০২৪ সালে বাংলাদেশিদের আবেদন সফল হওয়ার হার ছিল মাত্র ৪ শতাংশ। ২০২৫ সালের মে পর্যন্ত বাংলাদেশিদের ৪৫ হাজার ১২৯টি আবেদন নিষ্পত্তির জন্য অপেক্ষমাণ ছিল। ইইউ তথ্য বলছে, চলতি বছরের জুনে ফ্রান্স, ইতালি এবং গ্রিস অভিবাসীদের আবেদন নিষ্পত্তির হার বাড়িয়ে দিয়েছে। সংশ্লিষ্টরা ধারণা করছেন, আবেদন নিষ্পত্তির গতি বাড়লেই বাংলাদেশিদের ফেরত আসাও বৃদ্ধি পাবে।
গত ১০ সেপ্টেম্বর স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীর (অব.) সঙ্গে ইউরোপীয় কমিশনের অভিবাসন ও আশ্রয়বিষয়ক পরিচালক মিশেল শটার সাক্ষাৎ করেছেন। পরিচালক মিশেল শটার ইইউ-ভুক্ত দেশে সাম্প্রতিক অভিবাসনবিরোধী অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক চাপ ক্রমাগত বাড়ছে বলে জানান। তিনি উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় বাংলাদেশি নাগরিকদের তার ইউনিয়নভুক্ত দেশে অবৈধ অভিবাসনের বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে এ বিষয়ে কাজ করার জন্য বাংলাদেশকে আহ্বান জানান। মিশেল অভিবাসনের বিষয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়েও বৈঠক করেন। সেখানেও তিনি অবৈধ অভিবাসীদের ফেরত পাঠানোর বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেন। তবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আনুষ্ঠানিকভাবে ওই আলোচনার বিষয়ে কিছু জানায়নি। মন্ত্রণালয়ের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানান, অবৈধ অভিবাসনে বাংলাদেশ সবসময় নিরুৎসাহিত করে।
বৈঠক প্রসঙ্গে গত ১১ সেপ্টেম্বর ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাংলাদেশ মিশন জানিয়েছে, অভিবাসন ব্যবস্থাপনা ইউরোপীয় ইউনিয়নের জন্য শীর্ষ অগ্রাধিকার। বাংলাদেশের জন্য আমরা নিরাপদ ও মর্যাদাপূর্ণ নিয়মিত অভিবাসনকে সমর্থন করি। অবৈধ পথে ইউরোপ প্রবেশ রোধের প্রচেষ্টা জোরদার করছি।