Image description
 

জুলাই জাতীয় সনদের সংবিধান সম্পর্কিত দলগুলোর মতবিরোধের পরিপ্রেক্ষিতে বিকল্প বেশ কিছু উপায় নির্ধারণ করেছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। মতবিরোধ নিরসনে জুলাই জাতীয় সনদের সংবিধান সম্পর্কিত প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়নে সরকারকে দুটো প্যাকেজ প্রস্তাব সুপারিশ করতে পারে ঐকমত্য কমিশন।
প্রথম প্যাকেজে সংবিধান আদেশ, সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদের অধীনে সুপ্রিম কোর্টের অভিমত বা উপদেশ গ্রহণ এবং গণভোট। বিকল্প হিসেবে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সঙ্গে গণপরিষদ বা সংবিধান সংস্কার সভার মাধ্যমে শুরুতেই নির্বাচিত এমপিরা সনদের সংবিধানিক সম্পর্কিত বিষয়গুলোর সমাধান করবে। 
গত শুক্রবার রাতে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের ভার্চুয়াল সভায় এমনটি আলোচনা হয় বলে একটি নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে। সূত্র জানায়, জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নে কমিশনকে একাধিক সুপারিশ দিতে বলেছে সরকার। তা নিয়ে শুক্রবারের ভার্চুয়াল সভায় আলোচনা হয়। সেখানে দুটি প্যাকেজ প্রস্তাব সরকারকে দিতে বলেছেন বিশেষজ্ঞরা। যার প্রথমটিতে থাকবে সংবিধান আদেশ, সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদের অধীনে সুপ্রিম কোর্টের অভিমত বা উপদেশ গ্রহণ এবং গণভোট। দ্বিতীয় প্যাকেজে বিকল্প হিসেবে সংবিধান সংস্কার সভা। যেখানে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের নির্বাচিত সংসদ সদস্যরা শুরুতে সংবিধান সংস্কার সভার মাধ্যমে সাংবিধানিক বিষয়গুলোর সমাধান করবে। 
আগামী ৫ অক্টোবর জাতীয় ঐকমত্য কমিশন রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে পুনরায় বৈঠকে বসতে পারে বলে জানা গেছে। সেখানেই এই দুটো প্যাকেজ নিয়ে দলগুলোর মতামত ও সিদ্ধান্ত চাইতে পারে কমিশন। 
শুক্রবার ভার্চুয়াল বৈঠকে বিশেষজ্ঞ হিসেবে অংশ নেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এম এ মতিন, অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মঈনুল ইসলাম চৌধুরী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুষদের ডিন মোহাম্মদ ইকরামুল হক, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র অ্যাডভোকেট ড. শরিফ ভূইয়া, ব্যারিস্টার তানিম হোসেইন শাওন ও ব্যারিস্টার ইমরান সিদ্দিক। 
আলোচনায় কমিশনের পক্ষে অংশ নেন সহ-সভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ, সদস্য ড. বদিউল আলম মজুমদার, বিচারপতি মো. এমদাদুল হক, ড. ইফতেখারুজ্জামান ও ড. মো. আইয়ুব মিয়া। এ ছাড়া জাতীয় ঐকমত্য গঠন প্রক্রিয়ায় যুক্ত প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দারও এতে যুক্ত ছিলেন?
জুলাই সনদ বাস্তবায়নের উপায় নির্ধারণে সর্বশেষ গত ১৭ সেপ্টেম্বর রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে  বৈঠক করে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। সেখানে জুলাই সনদের সংবিধান সম্পর্কিত বিষয়গুলো সংবিধান আদেশের মাধ্যমে অন্তর্বর্তী সরকারকে বাস্তবায়নের সুপারিশ করে কমিশন। বিষয়গুলো জাতীয় নির্বাচনের দিন গণভোটের মাধ্যমে জনগণের  বৈধতা নেওয়ার কথা বলা হয়। 
ওই দিনের আলোচনায় বিএনপিসহ কয়েকটি দল সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদের অধীনে সুপ্রিম কোর্টের অভিমত বা উপদেশ গ্রহণের সুপারিশ করে।  রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে থেকে ওঠা নতুন প্রস্তাব নিয়ে ২০ সেপ্টেম্বর বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে  বৈঠক করে কমিশন। সেখানে সিদ্ধান্ত হয় সংবিধান আদেশ এবং গণভোটের সঙ্গে সুপ্রিমকোর্টের অভিমত নেওয়ার বিষয়টি সমন্বয় করার। 
জুলাই জাতীয় সনদের সংবিধান সম্পর্কিত প্রস্তাবগুলো টেকসই সমাধানের জন্য সংবিধান সংস্কার সভার নির্বাচনের প্রস্তাবটি গণতন্ত্র মঞ্চভুক্ত দল রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন, জেএসডি ও গণসংহতি আন্দোলনের পক্ষে দেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) পক্ষে বলা হয়েছে, গণপরিষদের মাধ্যমে জুলাই সনদ বাস্তবায়ন। যেখানে সংবিধান সংস্কার বা পুনর্লিখনের পরে গণপরিষদের সদস্যরা সংসদ সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে পারবেন। এক্ষেত্রে গণপরিষদ ও জাতীয় সংসদ নির্বাচন একসঙ্গে হতে পারে। 
 বৈঠকে উপস্থিত এক বিশেষজ্ঞ বলেন, ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে ইতোপূর্বে অনুষ্ঠিত বৈঠকে একাধিক রাজনৈতিক দল যেহেতু ১০৬ অনুচ্ছেদের ভিত্তিতে সুপ্রিম কোর্টের মতামত নিতে চাচ্ছে, তা একটি অপশন হিসেবে দেওয়া যেতেই পারে। এক্ষেত্রে সংবিধান আদেশ ও গণভোটের সঙ্গে সুপ্রিম কোর্টের মতামত নেওয়ার বিষয়টি থাকবে। অন্যদিকে সরকারের পক্ষ থেকে কমিশনকে সনদ বাস্তবায়নে একাধিক বিকল্প দিতে বলা হয়েছে। সে জন্য চিন্তা করা হচ্ছে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত জাতীয় সংসদ গণপরিষদ বা সংবিধান সংস্কার সভার কাজ করতে পারেন কি না। 
দুটো প্যাকেজ প্রস্তাবের বিষয়ে ওই বিশেষজ্ঞ বলছেন, সংবিধান আদেশে গণভোটের কথা বলা থাকবে। যেটি জারির পরে ১০৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সুপ্রিম কোর্টের অভিমত বা উপদেশ গ্রহণের জন্য পাঠানো হবে। বিকল্প হিসেবে, জাতীয় সংসদ ও সংবিধান সংস্কার সভার নির্বাচন একসঙ্গে হবে। এক্ষেত্রে নির্বাচিত এমপিরা সংবিধান সংস্কার সভা ও জাতীয় সংসদে এক সঙ্গে বসবেন। বিষয়টি শুক্রবারের সভায় আলোচনা হয়েছে। কারণ সিদ্ধান্ত নেওয়ার সহজের জন্য সরকার থেকে একাধিক প্রস্তাব দিতে বলা হয়েছে। 
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের পক্ষ থেকে শনিবার পাঠানো সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, জুলাই সনদ বাস্তবায়নের উপায় ও পদ্ধতি সম্পর্কিত একাধিক সুপারিশ নিয়ে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আবারও সভা করেছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছে, ঐকমত্য কমিশন জুলাই সনদ বাস্তবায়নের সম্ভাব্য উপায় সম্পর্কে সরকারের কাছে একাধিক সুপারিশ উপস্থাপন করবে। 
এতে বলা হয়েছে, সভায় বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের তরফ থেকে প্রস্তাবিত গণপরিষদ গঠন, সংবিধান আদেশ জারি, ১০৬ অনুচ্ছেদের অধীনে সুপ্রিম কোর্টের অভিমত বা উপদেশ গ্রহণ এবং গণভোট আয়োজনের সম্ভাব্যতা নিয়ে আলোচনা হয়।
জুলাই সনদ বাস্তবায়নে ১২ দলীয় জোট একমত ॥ ‘সাংবিধানিক ধারা অব্যাহত রাখা, নির্বাচন বানচলের ষড়যন্ত্র প্রতিহত ও জুলাই সনদের বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া ও সম্ভাব্য করণীয়’ নিয়ে বেশ কয়েকটি দল ও জোটের সঙ্গে বৈঠক করেছে ১২ দলীয় জোটের নেতারা। শনিবার দুপুরে রাজধানীর একটি হোটেলে এই বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।
বৈঠকে সকল দলের নেতারা জুলাই সনদ বাস্তবায়নে আইনি ভিত্তির ওপর গুরুত্বারোপ করেন এবং জাতীয় ঐক্যমত্যের স্বার্থে যেকোনো ছাড়ের বিনিময়ে জুলাই সনদ বাস্তবায়ন ও অঙ্গীকারনামায় স্বাক্ষর করার ব্যাপারে একমতে পৌঁছান।
নেতারা মনে করেন, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিনেই ‘জুলাই সনদ অঙ্গীকারনামার ভিত্তিতে’ বাস্তবায়নের পক্ষে একটি গণভোট আয়োজন করা যেতে পারে। এ ছাড়া নেতারা মনে করেন, সাংবিধানিক আদেশ বা সংবিধান সংশ্লিষ্ট মৌলিক সংস্কার বাস্তবায়নের জন্য সংবিধানের ১০৬ নম্বর অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি সুপ্রিম কোর্টের কাছে মতামত জানতে চাইতে পারেন। নেতারা অঙ্গীকার করেন যে, বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থে যেকোনো মূল্যে জুলাই সনদ বাস্তবায়ন ও স্বাক্ষর প্রক্রিয়ায় সকলেই ঐক্যবদ্ধ থাকবেন।
বৈঠকে ১২ দলীয় জোটের পক্ষ থেকে জোটের মুখপাত্র বাংলাদেশ এলডিপির চেয়ারম্যান শাহাদাত হোসেন সেলিম, জোটের সমন্বয়ক বাংলাদেশ জাতীয় দলের চেয়ারম্যান সৈয়দ এহসানুল হুদা, জাতীয়তাবাদী সমমনা জোটের আহবায়ক ড. ফরিদুজ্জামান ফরহাদ, গণঅধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খান, আমজনতার দলের সভাপতি কর্নেল অবসরপ্রাপ্ত মিয়া মশিউজ্জামান, সাধারণ সম্পাদক তারেক রহমান, এনডিএমের মহাসচিব মোমিনুল আমিন, জাতীয় পার্টির মহাসচিব আহসান হাবীব লিংকন, জাকের পার্টির মহাসচিব শামীম হায়দার, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের মহাসচিব মুফতি গোলাম মহিউদ্দিন ইকরাম, ন্যাশনাল লেবার পার্টির চেয়ারম্যান লায়ন ফারুক রহমান, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান শামসুদ্দিন পারভেজ, লেবার পার্টির সহসভাপতি এস এম ইউসুফ উপস্থিত ছিলেন।