
‘আগামী বছরের ফেব্রুয়ারিতেই জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে’ বলে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের জাতিসংঘে দেওয়া ঘোষণা সব মহলে সমাদৃত হয়েছে। তাঁর সফরসঙ্গী তিন রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি এ ঘোষণাকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন। রাজনীতিসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করছেন, ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন অনুষ্ঠান নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যে সংকট ছিল প্রধান উপদেষ্টার জাতিসংঘ ঘোষণায় তা কেটে যাবে। আমেরিকায় তিন রাজনৈতিক দলের নেতা ও সরকারের মধ্যে বেশ কিছু বিষয়ে আলোচনা হয়েছে বলে জানা গেছে। সূত্র জানিয়েছে, ফেব্রুয়ারির নির্বাচন অনুষ্ঠানে পিআর, মার্কা- এসব কোনো বাধা হয়ে দাঁড়াবে না।
জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে উপস্থিত দেশের শীর্ষনেতারা একদিকে যেমন প্রধান উপদেষ্টার ভাষণের প্রশংসা করেছেন, তেমনি নির্বাচনি সংস্কার ও পরিবেশ তৈরির দাবিও উঠেছে স্পষ্টভাবে। ভাষণে নির্বাচনি রোডম্যাপ স্পষ্টভাবে উঠে আসায় সন্তোষ প্রকাশ করেছে বিএনপি। দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, নির্বাচন নিয়ে ভাষণটি অত্যন্ত জোরালো ছিল।
মহাসচিব বলেন, ‘আমরা উপলব্ধি করছিলাম যে আওয়ামী লীগ যে অবস্থায় দেশকে নিয়ে গিয়েছিল সে অবস্থায় মৌলিক পরিবর্তন ছাড়া, একদিকে রাষ্ট্রের কাঠামো পরিবর্তন, অন্যদিকে রাজনৈতিক পরিবর্তন ছাড়া এই দেশকে আবার পরিবর্তন করা কষ্ট হবে। সেটাই প্রধান উপদেষ্টা জাতিসংঘের সামনে তুলে ধরলেন। এ ব্যাপারে আমাদের অন্তত সংশয় নেই।’ জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকেও এসেছে ইতিবাচক সাড়া। দলটির নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মুহাম্মদ তাহের বলেন, নির্বাচনের আগে জুলাই চার্টার বাস্তবায়ন এবং দুই কক্ষবিশিষ্ট সংসদে পিআর পদ্ধতি চালু করাই এখন সময়ের দাবি। আবদুল্লাহ মুহাম্মদ তাহের বলেন, নির্বাচন ফেব্রুয়ারিতে করার ব্যাপারে কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু তার আগে কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সমাধান করা দরকার।
একই সুর শোনা গেছে এনসিপির পক্ষ থেকেও। দলটির নেতা আখতার হোসেন জানান, কেবল নির্বাচন নয়, তার আগে সুষ্ঠু পরিবেশ তৈরি করাই বড় চ্যালেঞ্জ। দলের এই অন্যতম শীর্ষ নেতা বলেন, নির্বাচনের আগে বাস্তব সংস্কার ছাড়া জনগণের আস্থা ফিরে আসবে না। আখতার হোসেন বলেন, ‘ফেব্রুয়ারিতে যে নির্বাচনের কথা বলা হয়েছে, সেটাকে আমরা ইতিবাচক হিসেবেই দেখি। কিন্তু তার আগে সংস্কারকাজগুলো সমাপ্ত করা হলে আরও গোছানোভাবে নির্বাচনের দিকে যাওয়া সম্ভব হবে।’
রাজনীতিসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, নির্বাচন সামনে রেখে তাদের এ সফর নিয়ে নানা গুঞ্জন রয়েছে। দলগুলোর মধ্যে আস্থার সংকট দূর করতে নেতাদের সফরসঙ্গী করা হতে পারে। তবে অনেকেই বলছেন, জুলাই সনদ ও নির্বাচন নিয়ে যতটুকু মতবিরোধ আছে, সেখানে এর সমাধান হতে পারে। দেশে ফিরলে তাদের কর্মকাণ্ড পর্যবেক্ষণ করলেই তা বোঝা যাবে। রাজনৈতিক মহল মনে করছে, ফ্যাসিবাদবিরোধী দলগুলোর নেতারা মুখে যা-ই বলুক, জুলাই সনদ ও নির্বাচন নিয়ে দলগুলোর মধ্যে যে মতবিরোধ রয়েছে, তা দ্রুতই সমাধান হবে। দেশ কোনো অস্থিতিশীল পথে যাক, তা এখন আর জনগণ চায় না। তাই রাজনৈতিক দলগুলোর উচিত রাজপথে নয়, আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধান করা। নির্বাচন সামনে রেখে রাজনৈতিক দলগুলোর এই ঐকমত্য ও আন্তর্জাতিক আয়োজনে উপস্থিতি যদি মাঠের আগামীর রাজনীতিতেও প্রতিফলিত হয়, তাহলে গণতন্ত্র আরও এক ধাপ এগিয়ে যাবে।
ভোট প্রস্তুতিতে দলগুলো : ফেব্রুয়ারিতে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে প্রস্তুতি নিচ্ছে রাজনৈতিক দলগুলো। জুলাই সনদ ও পিআর পদ্ধতি নিয়ে মতভেদ থাকলেও দলগুলো বর্তমানে আসনভিত্তিক প্রার্থী চূড়ান্তকরণে ব্যস্ত। দলের প্রার্থী চূড়ান্ত না করলেও প্রক্রিয়া শুরু করেছে বিএনপি। এ লক্ষ্যে গত বছরের ৫ আগস্ট জুলাই গণ অভ্যুত্থানের পর থেকে কাজ করছেন দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। এ পর্যন্ত তাঁর তত্ত্বাবধানে আসনভিত্তিক পাঁচটি জরিপও করা হয়েছে। সাংগঠনিক টিমের সদস্যদের মাধ্যমেও সম্ভাব্য প্রার্থীদের ব্যাপারে খোঁজখবর নিয়েছেন তিনি। আগামী মাসের মধ্যে ৩০০ আসনে বিএনপি ও মিত্র রাজনৈতিক দলের প্রার্থী চূড়ান্ত করবে বলে জানা গেছে। পিআরসহ কয়েকটি দাবিতে রাজপথে সরব থাকলেও জামায়াতে ইসলামী এরই মধ্যে ৩০০ আসনে প্রার্থী ঘোষণা করেছে। ২৯৬ আসনে প্রার্থী ঘোষণা করেছে খেলাফত মজলিস। প্রার্থী ঘোষণা করেছে ইসলামী আন্দোলন। গণঅধিকার পরিষদও আসনভিত্তিক প্রার্থীর নাম ঘোষণা শুরু করেছে। অন্যদিকে বিএনপি আসনভিত্তিক চূড়ান্ত প্রার্থীর নাম ঘোষণা না করলেও দলের অভ্যন্তরীণ জরিপের মাধ্যমে যোগ্য প্রার্থী বাছাই চলছে।
৩০০ আসনে প্রার্থী ঘোষণা না করলেও অনেক দলের শীর্ষনেতারা কে কোন আসন থেকে নির্বাচন করবেন, তা প্রকাশ করেছে নিবন্ধনের অপেক্ষায় থাকা জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। দলটির অন্তত অর্ধশত নেতার প্রার্থীর তালিকা চুড়ান্ত করা হয়েছে। গণঅধিকার পরিষদ ও এনসিপির একীভূত হওয়ার বিষয়ে আলোচনা চলছে। এ ছাড়া বিএনপি ও জামায়াতের বাইরে থাকা কয়েকটি দল নিয়ে নির্বাচনি জোট গঠনের প্রক্রিয়াও চলছে দলটিতে। বর্তমানে ইসির নিবন্ধন তালিকায় ৫০টি দল রয়েছে। নতুন করে আরও ছয়টি দলের নিবন্ধন প্রায় চূড়ান্ত। আগামী নির্বাচনে অর্ধশতাধিক রাজনৈতিক দল ভোটে অংশগ্রহণ করবে বলে মনে করা হচ্ছে।
জানতে চাইলে রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. মাহবুব উল্লাহ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস জাতিসংঘে দেওয়া ভাষনে আবারও ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের কথা বলেছেন। উনি নিশ্চয় সবকিছু জেনে বুঝেই বলেছেন। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টা এক বছরের বেশি সময় ধরে কথা বলছেন, তাদের সম্পর্কে নিশ্চয় ওনার ধারণা হয়েছে। ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হবেই, এই নিয়ে জল্পনাকল্পনার সুযোগ নেই।’