
জামায়াতে ইসলামীর সমাবেশের পাল্টা হিসেবে ঢাকায় এখন কোনো সমাবেশ করতে চায় না বিএনপি। দলটি মনে করছে, পাল্টা কর্মসূচিতে গেলে নিজেদের দুর্বলতা এবং প্রতিপক্ষের গুরুত্ব বেড়ে যাবে। তাই পাল্টা সমাবেশের কোনো প্রয়োজন নেই। কারণ, বিএনপির রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক সক্ষমতা নতুন করে প্রমাণ করার কিছু নেই। বিএনপি বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ ও জনপ্রিয় রাজনৈতিক দল। বিগত দিনে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের যে আন্দোলন-সংগ্রাম হয়েছে, তার প্রতিটি বাঁকে এ দলটির ভূমিকা রয়েছে, এখনো ভূমিকা রেখে চলছে। দেশকে গণতন্ত্রে উত্তরণের পথে যখন যে কর্মসূচির প্রয়োজন হয়, বিএনপি সেই কর্মসূচি দিয়ে যাচ্ছে এবং আগামীতেও তা অব্যাহত থাকবে।
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, বিএনপি এখন গণঅভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তির কর্মসূচি পালন নিয়ে ব্যস্ত রয়েছে। জুলাই-আগস্ট স্মরণে দলটির ৩৬ দিনব্যাপী যে কর্মসূচি চলছে, সেগুলোর সর্বশেষ কর্মসূচি হিসেবে আগামী ৬ আগস্ট ঢাকায় সর্ববৃহৎ বিজয় মিছিল অনুষ্ঠিত হবে। এ নিয়ে এখনো সেভাবে দলীয় প্রস্তুতি শুরু না হলেও এই কর্মসূচিকে মহাসমাবেশে রূপ দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে বিএনপির। বিজয় মিছিল ঘিরে সেদিন ঢাকায় স্মরণকালের সর্ববৃহৎ জনসমাগম ঘটাবে দলটি, যা জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের সাম্প্রতিক সমাবেশকে বহুগুণে ছাপিয়ে যাবে। এর মধ্য দিয়ে আগামী ফেব্রুয়ারিতে প্রতিশ্রুত জাতীয় নির্বাচনের লক্ষ্যে অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর পরোক্ষভাবে এক ধরনের চাপও সৃষ্টি করতে চাইবে বিএনপি। কারণ, সুনির্দিষ্ট দিনক্ষণ ঘোষিত না হওয়ায় দলটির এখনো শঙ্কা—নির্বাচন প্রলম্বিত, এমনকি বানচাল করারও ষড়যন্ত্র রয়েছে। এর অংশ হিসেবে সরকারের কোনো একটি অংশের সহায়তায় কেউ কেউ দেশে উদ্দেশ্যমূলক পরিস্থিতি তৈরি করতে তৎপর রয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে মিটফোর্ড হত্যাকাণ্ডের ঘটনা তারই প্রমাণ।
পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচনসহ সাত দফা দাবিতে গত শনিবার রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে প্রথমবারের মতো এককভাবে সমাবেশ করেছে জামায়াতে ইসলামী। এই সমাবেশে ব্যাপক জনসমাগম ঘটে। এতে করে নির্বাচনী রাজনীতিতে বিএনপি চাপে পড়ে গেল কি না, রাজনৈতিক অঙ্গনে এমন আলোচনা হচ্ছে। তবে বিএনপির দায়িত্বশীল একাধিক নেতার সঙ্গে আলাপকালে তারা বলেন, এটা একটা নিরর্থক আলোচনা। এখানে চাপের কিছু নেই। গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে বিভিন্ন দলের বিভিন্ন দাবি-দাওয়া থাকবে, ভিন্নমত থাকবে। ডেমোক্রেটিক প্র্যাকটিসের অংশ হিসেবে দলগুলো তাদের সেই দাবি-দাওয়া জানাবে, সভা-সমাবেশ করবে—এটাই স্বাভাবিক। গণতন্ত্রে তাদের সে অধিকার রয়েছে। জামায়াতের সমাবেশকে এভাবেই দেখছে বিএনপি। দলটির দাবি, বিগত ফ্যাসিস্ট আমলে দেশে গণতন্ত্রের চর্চা ছিল না। ফলে রাজনৈতিক দলগুলোর সভা-সমাবেশ করারও কোনো অধিকার ছিল না।
জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সিনিয়র সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন কালবেলাকে বলেন, জামায়াতে ইসলামী একটা শান্তিপূর্ণ সমাবেশ করেছে, নেতাকর্মীরা এসেছেন। এটা রাজনীতির জন্য ভালো। এর পাল্টা হিসেবে আমরা কোনো কর্মসূচির চিন্তা-ভাবনা করিনি। আমরা মাঠে আছি, জামায়াতে ইসলামীও মাঠে আছে, যে যার দলীয় কর্মসূচি করছে। এখানে প্রতিযোগিতার তো কোনো বিষয় নেই।
গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী সরকারের পতনের পর পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বিএনপি ও জামায়াত আলাদা পথে হাঁটতে শুরু করে। দুদলেরই এখন লক্ষ্য আগামী নির্বাচনের মধ্য দিয়ে সরকার গঠন করা। তবে নানা ইস্যুতে দল দুটির মধ্যে প্রায়ই টানাপোড়েন দেখা যাচ্ছে, রয়েছে পাল্টাপাল্টি রেষারেষিও। একে অন্যের বিরুদ্ধে সমালোচনায়ও মুখর। বক্তব্য-বিবৃতি ছাড়াও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একদল আরেক দলকে টার্গেট করে নানা ধরনের ক্যাম্পেইনে লিপ্ত রয়েছেন তাদের কর্মী-সমর্থকরা। সর্বশেষ মিটফোর্ড হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় বিএনপি-জামায়াতের মধ্যে সম্পর্কের দারুণ অবনতি ঘটে। তার পরও বিএনপি মনে করে, রাজনৈতিক ঐক্যের স্বার্থে ফ্যাসিবাদ মোকাবিলায় তাদের ভূমিকা একই পথে থাকবে।
অবশ্য দীর্ঘদিনের মিত্র হলেও আগামী নির্বাচন সামনে রেখে জামায়াতের সঙ্গে এবার ‘নির্বাচনী জোট’ করছে না বিএনপি। এটা এখন অনেকটাই স্পষ্ট। ফ্যাসিবাদবিরোধী যুগপতের মিত্রদের নিয়ে ‘নির্বাচনী জোট’ গঠনের পরিকল্পনা করছে বিএনপি। অন্যদিকে জামায়াতও ইসলামী দলগুলোসহ ‘পিআর’ চাওয়া অন্যদের নিয়ে জোট গঠনে তৎপর রয়েছে। এর অংশ হিসেবে পিআর পদ্ধতিতে যারা জাতীয় নির্বাচন চায়, তাদের সোহরাওয়ার্দীর সমাবেশে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল জামায়াত। সেখানে বিএনপিকে কোনো দাওয়াত দেওয়া হয়নি। বিএনপি পিআর নয়, বিদ্যমান ব্যবস্থায় নির্বাচন চায়।
বিএনপি এখন ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তি পালনে ৩৬ দিনব্যাপী ধারাবাহিক কর্মসূচি পালন করছে; যা গত ৩০ জুন মধ্যরাতে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ছাত্রদলের মোমবাতি প্রজ্বালনের মধ্য দিয়ে শুরু হয়েছে। এর অংশ হিসেবে আজ সোমবার বিকেলে রমনার ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে গণঅভ্যুত্থানে পেশাজীবীদের অবদান নিয়ে বাংলাদেশ সম্মিলিত পেশাজীবী পরিষদের (বিএসপিপি) উদ্যোগে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হবে। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান এতে ভার্চুয়ালি প্রধান অতিথি থাকবেন। এ ছাড়া আগামীকাল মঙ্গলবার কাকরাইলের ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে মহিলা দলের উদ্যোগে ‘ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে নারীদের অবদান’ শীর্ষক আলোচনা হবে। ২৮ জুলাই স্বেচ্ছাসেবক দলের উদ্যোগে ডেঙ্গু ও করোনা প্রতিরোধে পানি ও ডোবা পরিষ্কারের কর্মসূচি এবং ‘মায়ের ডাক’ ও ‘আমরা বিএনপি পরিবার’-এর উদ্যোগে ‘গণতান্ত্রিক পথযাত্রায় শিশু’ শীর্ষক আলোচনা সভা; ২ আগস্ট ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ বিএনপির উদ্যোগে ‘পালাব না, কোথায় পালাব? শেখ হাসিনা পালায় না’ শীর্ষক পথনাটক এবং উত্তরা, রামপুরা, মিরপুর ও যাত্রাবাড়ীতে সংক্ষিপ্ত সমাবেশ; ৩ আগস্ট ছাত্রদলের উদ্যোগে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ছাত্রসমাবেশ; ৪ আগস্ট যুবদলের উদ্যোগে শহীদদের সম্মাননা প্রদান এবং ‘আমার না বলা কথা’ শীর্ষক অনুষ্ঠান এবং সবশেষ কর্মসূচি হিসেবে ৬ আগস্ট বিএনপির অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের উদ্যোগে কেন্দ্রীয়ভাবে বিজয় মিছিল অনুষ্ঠিত হবে।
তবে সেদিন ঢাকাজুড়ে একাধিক মিছিল হবে, নাকি কেন্দ্রীয়ভাবে একটি মিছিল হবে—সেটা হলে কোথা থেকে শুরু এবং কোথায় গিয়ে শেষ হবে, তা এখনো চূড়ান্ত হয়নি। অবশ্য এই কর্মসূচি ঘিরে ঢাকায় ব্যাপক জনসমাগম ঘটাবে বিএনপি।
জানতে চাইলে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী কালবেলাকে বলেন, জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থান স্মরণে একটার পর একটা কর্মসূচি চলছে। সামনে আরও কর্মসূচি আছে। তার পর ওটার (বিজয় মিছিল) প্রস্তুতি শুরু করব।
দলের ঢাকা বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক কাজী সাইয়েদুল আলম বাবুল কালবেলাকে বলেন, তারা এখন বিএনপি ঘোষিত গণঅভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তির ধারাবাহিক কর্মসূচিগুলো পালন করছেন। বিজয় মিছিল নিয়ে শিগগির প্রস্তুতি সভা অনুষ্ঠিত হবে। সেখানেই বিজয় মিছিলের কর্মসূচি কীভাবে পালিত হবে, মিছিলের ব্যাপকতা কেমন হবে, সবকিছু নিয়ে আলোচনা হবে। তবে ওই কর্মসূচি ঘিরে ঢাকায় ব্যাপক জনসমাগম ঘটবে।