
পিরোজপুরের কাউখালীতে শ্রী গুরু সংঘ কেন্দ্রীয় আশ্রমের কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে আওয়ামী লীগ নেতা বিপুল বরন ঘোষের বিরুদ্ধে। ৫ আগস্টের আগে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের ক্ষমতা দেখিয়ে ওই অর্থ তিনি আত্মসাৎ করেন বলে অভিযোগ করেছেন আশ্রমের সাধারণ সদস্যরা। বিপুল বরন কাউখালী উপজেলা আওয়ামী লীগের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিষয়ক সম্পাদক। উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি সুনীল চন্দ্র কুন্ডুকে সঙ্গে নিয়ে টানা ১১ বছর আশ্রমটি নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখেন তিনি। এই সময়ে স্থায়ী আমানতসহ বিভিন্ন উপায়ে পকেটস্থ করেন বিপুল পরিমাণ অর্থ। প্রাথমিক অনুসন্ধানে আত্মসাতের প্রমাণ মেলার পর তাকে আজীবনের জন্য বহিষ্কার করা হয়েছে আশ্রমের সব পদ ও প্রাথমিক সদস্য পদ থেকে। তার দায়িত্ব পালনের সময়ের আয়-ব্যয়ের হিসাবের তদন্ত চলার কথাও জানিয়েছেন আশ্রমের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক। অভিযোগ অস্বীকার করে বিপুল বলেন, ‘রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের সুযোগে আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র চলছে। যে অভিযোগ তোলা হয়েছে তার একটিও সত্য নয়।’ শ্রী গুরু সংঘ সনাতন ধর্মাবলম্বীদের একটি সেবামূলক ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান। সারা দেশে এই সংগঠনের ১০৮টি শাখা ও লক্ষাধিক সদস্য রয়েছে। সদস্যদের দান-অনুদান আর সরকারি-বেসরকারি সহায়তায় চলে প্রতিষ্ঠানটি। পিরোজপুরের কাউখালীতে এই সংঘের প্রধান কেন্দ্র। এখান থেকেই মূলতঃ সারা দেশে পরিচালিত হয় কার্যক্রম। পরিচালনার জন্য রয়েছে একটি কার্যনির্বাহী কমিটি। এই কমিটির কোষাধ্যক্ষ ছিলেন বিপুল বরন।
স্থানীয়ভাবে শ্রী গুরু সংঘ কেন্দ্রীয় আশ্রম নামে পরিচালিত এই সংগঠনের একাধিক সদস্য জানান, আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার কয়েক বছর পর আশ্রমের নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতে নিয়ে নেন বিপুল বরন ঘোষ। সংঘের সহ-প্রকাশনা সম্পাদক সুনীল চন্দ্র কুন্ডু ছিলেন তার প্রধান সঙ্গী। এই দুজন মিলে একপ্রকার কুক্ষিগত করে ফেলেন আশ্রমকে। সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে বানিয়ে রাখেন কাঠের পুতুল। উপজেলা আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা হওয়ায় তাদের বিরুদ্ধে কেউ কথা বলারও সাহস পেত না। নিজেদের ইচ্ছামতো সংঘ চালানোর পাশাপাশি টানা ১১ বছরে আত্মসাৎ করেন আশ্রমের অর্থ। এখানে সংঘের কমিটি ছিল ৭১ সদস্যবিশিষ্ট। কিন্তু বিপুল বরন তার একক ইচ্ছায় নিজস্ব লোকজন নিয়ে পক্ষ ভারী করার টার্গেটে ৮১ সদস্যের কমিটি বানান। এই কমিটি আবার গঠিত হতো তার ইচ্ছায় অনুসারী লোকজন দিয়ে। নির্বাচন কমিশন পর্যন্ত গঠন করতেন ইচ্ছামতো। ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক স্বার্থে বছরের পর বছর ব্যবহার করেন সংগঠনটিকে। স্থানীয় আওয়ামী লীগকে বোঝাতেন, উপজেলার সনাতনীরা তার কথার বাইরে যায় না। যে কারণে আ.লীগ নেতারাও গুরুত্ব দিতেন তাকে। এই সুযোগে ভুয়া ভাউচারে ক্রয় দেখানোসহ বিভিন্ন উপায়ে আত্মসাৎ করেন লাখ লাখ টাকা। এমনকি সংঘের নামে ব্যাংকে থাকা স্থায়ী আমানতের ১০ লাখ টাকাও তুলে আত্মসাৎ করেন বিপুল।
যুগান্তরের হাতে আসা আশ্রমের বিভিন্ন কাগজপত্রে দেখা গেছে, ২০২৩ সালের ২০ জুন কৃষি ব্যাংক কাউখালী শাখা থেকে স্থায়ী আমানতের ওই ১০ লাখ টাকা তুলে নেন বিপুল। তখন তিনি উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে নির্বাচন করছিলেন। ৫ আগস্টের পর বিষয়টি নিয়ে অভিযোগ উঠলে ব্যবস্থা নেয় কার্যনির্বাহী কমিটি। টাকা ফেরত চাইলে টালবাহানা শুরু করেন বিপুল। পরে প্রথমে সাময়িক অব্যাহতি এবং পরে তাকে আজীবনের জন্য বহিষ্কার করা হয় সংঘ থেকে। উঠিয়ে নেওয়া স্থায়ী আমানতের বিপরীতে লভ্যাংশের ৩৯ হাজার ২৯১ টাকা। চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে কমিটির কাছে জমা দিলেও ১০ লাখ টাকা এখনো রয়ে গেছে তার কাছে। এই টাকা ফেরত দিতে সময় চেয়ে গত ১ জুলাই বিপুল বরন আবেদন করেন আশ্রম কমিটির কাছে। কিন্তু সেই আবেদন নাকচ করে দেন কমিটির সদস্যরা। স্থায়ী আমানত ভেঙে টাকা আত্মসাতের বিষয়টি সামনে আসার পর বিপুল বরন ঘোষের দায়িত্ব পালনকালীন হিসাবপত্র যাচাই করতে গিয়ে ধরা পড়ে আরও বড় আত্মসাতের ঘটনা। সব মিলিয়ে যার পরিমাণ ছাড়িয়ে যাবে কোটি টাকারও বেশি।
পরিচয় না প্রকাশের শর্তে আশ্রমের একাধিক সূত্র জানায়, ১৩২তম আবির্ভাব উৎসবের প্রকাশনা বাবদ সাদা কাগজে ভাউচার লিখে ৩ লাখ ৩৫ হাজার টাকা নিয়েছেন বিপুল। অন্যান্য ছাপা বাবদ দেখিয়ে নিয়েছেন ১ লাখ ৩১ হাজার ৭শ টাকা। উৎসবের রান্নার সরঞ্জাম কেনা আর আনুষঙ্গিক ব্যয় দেখিয়ে আরও ১৭ লাখ টাকা নেওয়া হয়েছে, যার ভাউচারসহ কোনো কাগজপত্র সঠিক নেই। এভাবে দুস্থদের জন্য শাড়ি কেনা, মাসিক পত্রিকা ছাপানো, কালী মন্দিরের উন্নয়নে ইট কেনা, গাড়ি কেনা-বেচা ও মার্বেল পাথর ক্রয়সহ নানা খাতের লাখ লাখ টাকা পকেটে ঢুকিয়েছেন বিপুল বরন।
সংঘের সভাপতি অধ্যক্ষ পরিমল কর্মকার বলেন, ‘কতটা নিচু মানসিকতার হলে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের অর্থ আত্মসাৎ করা যায়। এটা তো বিশ্বাসের ঘরে চুরি। আমরা প্রাথমিক একটা অডিট করেছি। তাতেই বিপুল অঙ্কের কারচুপি ধরা পড়েছে। বর্তমানে দাপ্তরিক অডিট চলছে। বিপুল বরনের দায়িত্ব পালনকালীন ১১ বছরের আয়-ব্যয়ের হিসাব যাচাই করা হবে। এরপর প্রয়োজনে আইনগত ব্যবস্থায় যাব আমরা।’
ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক পরিতোষ মণ্ডল বলেন, ‘লাখো মানুষের এরকম একটি সংগঠন থেকে সাদা কাগজ আর ভুয়া ভাউচার দিয়ে টাকা সরানো হয়েছে। মন্দির আশ্রম আর পূজার বাজেট থেকে কোনো সনাতনী টাকা সরাতে পারে এটা আমরা দুঃস্বপ্নেও ভাবিনি। অডিট শেষ হলেই বোঝা যাবে আত্মসাতকৃত অর্থের মোট পরিমাণ কত। তবে এটা কোটির নিচে হবে না।’
অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে বিপুল বরন ঘোষ বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ আনা হয়েছে, তার কোনোটিই সত্য নয়। রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর ক্ষমতালোভীরা আমাকে সরিয়ে আশ্রম দখল করেছে। আমি কোনো অর্থ আত্মসাৎ করিনি। ১০ লাখ টাকার যে স্থায়ী আমানতের কথা বলা হচ্ছে, সেটা আমার জমি ক্রয়ের বিনিময়ে আশ্রম কর্তৃপক্ষের দেওয়ার কথা ছিল। সেই সিদ্ধান্তের রেজুলেশনও আছে। আমি কোনো অর্থ আত্মসাৎ করিনি।’ আশ্রমকে জমি দিয়েছেন কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সবকিছু চূড়ান্ত ছিল। কিন্তু নানা জটিলতায় দলিল রেজিস্ট্রি করে দিতে পরিনি।’ রেজিস্ট্রি দলিল না দিয়েই কী করে স্থায়ী আমানত ভেঙে টাকা নিলেন-জিজ্ঞেস করলে অবশ্য কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি বিপুল বরন। কেবলই বলেন, তিনি ষড়যন্ত্রের শিকার।