
সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর ধীরে ধীরে আগ্রাসী হতে থাকে নিষিদ্ধ ঘোষিত ছাত্রলীগ। ১৪ জুলাই তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শিক্ষার্থীদের ‘রাজাকার’ বলে সম্বোধন করেন। এরই প্রতিবাদে সেদিন মাঝরাতে রাজু ভাস্কর্যে বিক্ষোভ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। বিপুল সংখ্যক নারীশিক্ষার্থী সেদিন এই কর্মসূচিতে অংশ নেয়। একই দিনে নিষিদ্ধ ঘোষিত আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, যারা আন্দোলন করছে তাদের মধ্যে দুষ্কৃতকারী রয়েছে। তাদের সামলানোর জন্য ছাত্রলীগই যথেষ্ট। এসব বক্তব্যের প্রতিবাদে ১৫ জুলাই দুপুরে কর্মসূচি দেয় কোটাবিরোধীরা। সেদিন শিক্ষার্থীদের ওপর দফায় দফায় হামলা চালায় ছাত্রলীগ। শিক্ষার্থীদের সাথে ছাত্রলীগের সংঘর্ষে রণক্ষেত্রে পরিণত হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস।
ঢাবিতে শিক্ষার্থীদের ওপর নারকীয় হামলা : এদিন কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনরতদের ক্যাম্পাসছাড়া করতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তাণ্ডব চালিয়েছে ছাত্রলীগ। দুপুরের পর থেকে শুরু হওয়া হামলা ও পরে দু’পক্ষের সংঘর্ষ থেমে থেমে রাত পর্যন্ত চলে। দফায় দফায় ধাওয়া-পাল্টাধাওয়ার পর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের নিয়ন্ত্রণ নেয় তৎকালীন সরকারের মদদপুষ্ট ছাত্রসংগঠন। হামলায় আহত হয়ে কোটাবিরোধী আন্দোলনকারীদের অন্তত ৪০০ জন হাসপাতালে চিকিৎসা নেন। আবাসিক হল ও ক্যাম্পাসের বিভিন্ন স্থানে বহিরাগতদের নিয়ে ছাত্রলীগের একের পর এক হামলায় আহতরা ঢাকা মেডিক্যালে চিকিৎসা নিতে গিয়েও নিস্তার পায়নি। ছাত্রলীগের কর্মীরা আন্দোলনকারীদের বিকেল থেকে ঘিরে রেখে আতঙ্ক সৃষ্টির পর রাতে রড-কুড়াল নিয়ে হাসপাতালে ঢুকে তাদের ওপর হামলা চালায়। এতে ঢাকা মেডিক্যাল এলাকাও উত্তপ্ত হয়ে ওঠে।
এর আগে বিজয় একাত্তর হলের সামনে থেকে হামলার সূত্রপাত হলেও সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে নীলক্ষেত মোড় থেকে টিএসসি পর্যন্ত। কয়েকটি হলে অবরুদ্ধ হয়ে শিক্ষার্থীরা প্রতিরোধ করার চেষ্টা করে। ১৫ জুলাই দুপুর ১২টার দিকে ঢাবির রাজু ভাস্কর্যের সামনে সমাবেশ শুরু করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাকর্মীরা। সমাবেশ চলাকালীন বেলা ২টার দিকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব হল ও বিজয় একাত্তর হলে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ছাত্রলীগের মারধর ও আটকে রাখার সংবাদ আসে। এমন খবরে আন্দোলনরত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েক শত শিক্ষার্থী সহপাঠীদের উদ্ধার করতে প্রথমে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব হলে যায়। সেখানে নির্ভয়ে শিক্ষার্থীদের বের হওয়ার জন্য আহবান জানানো হয়। এ সময় কিছু শিক্ষার্থী হল থেকে বের হয়ে আসেন। পরে বঙ্গবন্ধু হল থেকে বের হয়ে আন্দোলনকারীরা বিজয় একাত্তর হলের গেট দিয়ে ঢুকলে ওপর থেকে ইটপাটকেল মারতে থাকেন ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা। এতে আন্দোলনরত কয়েকজন আহত হন। হামলার খবর পেয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীদের উদ্ধার করতে রাজু ভাস্কর্যের সামনের সমাবেশ থেকে প্রায় হাজার খানেক শিক্ষার্থী ঘটনাস্থলে আসেন। শুরু হয় দফায় দফায় সংঘর্ষ। এক পর্যায়ে লেগুনা ও মোটরসাইকেলে করে লাঠি-রড হাতে বিপুল পরিমাণ বহিরাগত এসে ছাত্রলীগের সাথে মিলিত হয়ে কয়েক দিক থেকে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ধাওয়া দেয়। এতে ছত্রভঙ্গ হয়ে যান আন্দোলনকারীরা। আহত হন অনেক নারীশিক্ষার্থীসহ দেড় শতাধিক শিক্ষার্থী। এ ছাড়াও বেশ কয়েকজন সাংবাদিকও আহত হন এই হামলায়।
বহিরাগত নিয়ে ছাত্রলীগের মহড়া : বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শিক্ষার্থীদের মোকাবেলায় বিপুল পরিমাণ বহিরাগতকে নিয়ে ঢাবিতে মহড়া দিয়েছে ছাত্রলীগ। এদিন দুপুরে কোটাবিরোধী শিক্ষার্থীদের সাথে সংঘর্ষের সময় এসব বহিরাগতদের আনে তারা। আন্দোলনরত শিক্ষার্থী ও ছাত্রলীগের সংঘর্ষের সময় জসীমউদদীন হলের মাঠে দেখা যায় মৌমিতা পরিবহনের তিনটি বাস, ইতিহাস পরিবহন ও ঠিকানা পরিবহনের দুটো করে মোট চারটি বাসে করে বহিরাগতদের নিয়ে আসে। বাসযাত্রীর সাথে কথা বলে জানা যায় এসব বাসে আসা যাত্রীরা বেশির ভাগ স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী ও সাভারের বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠানের শ্রমিক। এ ছাড়াও সংঘর্ষের শেষ পর্যায়ে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক শেখ ওয়ালি আসিফ ইনান ও ঢাকা মহানগর দক্ষিণ ছাত্রলীগ সভাপতি রাজিবুল ইসলাম বাজির নেতৃত্বাধীন দুটো মিছিলেও লাঠি-রড হাতে বিপুলসংখ্যক বহিরাগতদের হামলা করতে দেখা যায়। বিশেষ নারীশিক্ষার্থীদের ওপর বহিরাগতরা উপর্যুপরি হামলা চালায়।
আহত অর্ধশতাধিক নারীশিক্ষার্থী : ছাত্রলীগের হামলায় অর্ধশতাধিক নারীশিক্ষার্থী হামলার শিকার হয়েছেন। হামলায় ভুক্তভোগী এক শিক্ষার্থী বলেন, আমরা কোটা আন্দোলন শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলন করেছি। সেখানে ছাত্রলীগ হামলা করেছে। আমি মাফ চাওয়ার পরও তারা আমাকে ফেলে লাথি, কিল, ঘুষি মারে। ওখানকার কয়েকজন সাংবাদিক আমাকে সেইভ করে। কোটা আন্দোলনের সমন্বয়ক হাসনাত আবদুল্লাহ নয়া দিগন্তকে বলেন, আহতদের মেডিক্যালে নিয়ে যাওয়ার পরও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা হামলা করেছে। ককটেল নিক্ষেপ করেছে। আমাদের কোটা আন্দোলনের সমন্বয়ক মাহিন শাহরিয়ারের অবস্থা গুরুতর। পুলিশের কোনো ধরনের সাহায্য-সহযোগিতা করেনি।
রাতে ঢামেকে হামলা : ওই দিন বিকেল থেকে বেশ কয়েকবার চেষ্টা চালানোর পর রাত সাড়ে ৭টার দিকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ঢুকে চিকিৎসারত বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাকর্মীর ওপর হামলা চালিয়েছে ছাত্রলীগ। কেন্দ্রীয় ও ঢাকা মহানগর দক্ষিণ ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা হেলমেট পরে, লাঠিসোটা নিয়ে ঢামেকে প্রবেশ করে। এ সময় রড ও চাইনিজ কুড়াল নিয়ে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা কোটা সংস্কার আন্দোলনে আহত কয়েকজন শিক্ষার্থীর ওপর আবারো হামলা চালায়। এ ছাড়াও ঢামেকে দাঁড়িয়ে থাকা বেশ কয়েকটি অ্যাম্বুলেন্সও ভাঙচুর করে তারা। পরবর্তীতে উপস্থিত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা তাদের জরুরি বিভাগে ঢুকতে বাধা দেয়। এ সময় তারা বেশ কয়েকজন সাংবাদিকদের ওপরে চড়াও হয়।
ছাত্রলীগের হামলায় উত্তপ্ত ঢাবি : শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগের হামলার এই পরিস্থিতিতে করণীয় ঠিক করতে বৈঠক করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সব হলের প্রশাসনিক প্রধানরা। বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের ঢাবি ভিসি অধ্যাপক ড. মাকসুদ কামাল বৈঠকের সিদ্ধান্ত সম্পর্কে জানান। তিনি জানান, শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার জন্য আমাদের হলের প্রাধ্যক্ষরা রাতভর হলে অবস্থান করবেন। মিটিংয়ে আমাদের আরো কিছু বিষয় নিয়ে সিদ্ধান্ত হয়েছে। সেগুলো সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে জানিয়ে দেয়া হবে। এর আগে গতকাল কোটা আন্দোলনকারীদের একাংশ হলপাড়ার দিকে মিছিল গেলে বিজয় একাত্তর হলের ওপর ইটপাটকেল ছুড়তে শুরু করে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। পরে কোটাবিরোধীদের সাথে পাল্টাপাল্টি সংঘর্ষ হয়। ছাত্রলীগের হামলার মুখে সাধারণ শিক্ষার্থীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে। পরবর্তীতে ঢাকা মেডিক্যাল, বুয়েট ক্যাম্পাসের দিকে অবস্থান নেয় তারা। হামলায় বেশ কয়েকজন সাংবাদিক আহত হয়েছেন। আহত সাংবাদিকের মধ্যে ডেইলি স্টারের সাংবাদিক প্রবীর দাস ও প্রথম আলোর ফটোসাংবাদিক গুরুতর আহত হয়েছেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে (ঢাবি) কোটাবিরোধী আন্দোলনকারীদের পিটিয়ে ছত্রভঙ্গ করে দেয়ার পর ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে দ্বিতীয় দফায় হামলা চালায় ছাত্রলীগ। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে আহত চিকিৎসাধীন শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা করে ছাত্রলীগ। এ সময় ককটেল বিস্ফোরণের খবরও পাওয়া গেছে। ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি সাদ্দাম হোসেন ও শেখ ওয়ালী আসিফ ইনানের নির্দেশে হামলা করা হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
হামলার প্রতিবাদে কর্মসূচি ঘোষণা : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের ওপর ছাত্রলীগের হামলার প্রতিবাদে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশের কর্মসূচি ঘোষণা করে কোটাবিরোধীরা। ১৬ জুলাই মঙ্গলবার দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বেলা ৩টা থেকে বিক্ষোভ মিছিল কর্মসূচি পালনের কথা জানান বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম।