Image description
অবৈধ নিয়োগে দাপুটে কর্মকর্তা : ১

ক্ষমতায় আসার পর ২০০৯ সালে দলীয় কর্মীদের ক্যাডার সার্ভিসে নিয়োগের প্রক্রিয়া শুরু করে আওয়ামী লীগ সরকার। ছাত্রলীগ কর্মীদের নিয়োগ দিতে এসআরও জারি করে। এসআরও অনুযায়ী স্বাস্থ্য পরীক্ষায় অনুপস্থিতি জনিত শূন্য ক্যাডার পদে মুক্তিযোদ্ধা কোটার প্রার্থী নিয়োগ দেয়ার নিয়ম চালু করা হয়। ২৮তম বিসিএস থেকে এসআরও কার্যকর করা হলেও এটি বাস্তবায়ন করা হয় ২৯ বিসিএস থেকে। এই বিসিএসএ ৩১ জন নারী প্রার্থীকে নিয়োগের জন্য সুপারিশ করে পাবলিক সার্ভিস কমিশন (পিএসসি)। অবৈধভাবে নিয়োগ পাওয়া এই কর্মকর্তারা গত ১২ বছর দাপটের সাথে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে কর্মরত থেকে প্রশাসনে নির্লজ্জ দলীয়করণ করেন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২৯তম বিসিএসের নিয়োগের প্রথম গেজেট হয় ২০১১ সালের ১০ জুলাই। এর ১৩ মাস পর পরের বছর ১২ আগস্ট ২০১২ সালে এই ভুয়া ক্যাডারদের নিয়োগের সুপারিশ করে গেজেট প্রকাশ করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন সিনিয়র সচিব আবদুস সোবহান সিকদার।

নিয়োগপ্রাপ্ত ৩১ জনের মধ্যে প্রশাসন ক্যাডারের সাতজন, আনসার ক্যাডারে দু’জন, শুল্ক ও আবগারি ক্যাডারে চারজন, ইকোনমিক ক্যাডারে পাঁচজন, পরিবার পরিকল্পনায় পাঁচজন, খাদ্য ক্যাডারে একজন, পররাষ্ট্র ক্যাডারে একজন, পুলিশ ক্যাডারে দু’জন, কর ক্যাডারে তিনজন ও সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারে একজন নিয়োগ পেয়েছেন।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, এই নিয়োগে প্রশাসন ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত ছিলেন সাত কর্মকর্তা, এর মধ্যে একজন কর্মকর্তা স্বাস্থ্য পরীক্ষায় অনুপস্থিত হওয়ায় যোগদান করতে ব্যর্থ হন। যোগদানকৃতদের মধ্যে বর্তমানে কিশোরগঞ্জের জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের স্থানীয় সরকার বিভাগের দায়িত্বে আছেন ছাত্রলীগের সাবেক নেত্রী মমতাজ বেগম। শেখ হাসিনার সাবেক জনপ্রশাসনবিষয়ক উপদেষ্টা এইচ টি ইমামের ঘনিষ্ঠ এক কর্মকর্তা কর্মজীবনের ১২ বছরই দাপটের সাথে চাকরি করেছেন। ২০১২ সালে ঢাকা বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়ে যোগদানের মাধ্যমে চাকরিজীবন শুরু করেন। এরপর সহকারী কমিশনার হিসেবে ঢাকা জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে, সহকারী কমিশনার (ভূমি) হিসেবে মতিঝিল ও ক্যান্টনমেন্ট সার্কেল, সিনিয়র সহকারী কমিশনার হিসেবে ঢাকা জেলা প্রশাসকের কার্যালয়, নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার, ঢাকার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক হিসেবে কাজ করেছেন। শেখ হাসিনার সাবেক জনপ্রশাসনবিষয়ক উপদেষ্টা এইচ টি ইমামের ঘনিষ্ঠ হওয়ায় ঢাকা বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়ের পাশাপাশি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়েও বদলি ও পদায়নে ভূমিকা রাখতেন এই কর্মকর্তা।

একইভাবে যোগদান করা পরিকল্পনা বিভাগের উপপ্রধান নাসরীন পারভীন গাজীপুরের জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সহকারী কমিশনার, মানিকগঞ্জের সাটুরিয়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার, টাঙ্গাইলের ভুয়াপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার, জামালপুর ও গাজীপুরের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের মতো গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় পদায়ন ছিলেন। অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় এলে তাকে পরিকল্পনা বিভাগে বদলি করা হয়।

একইভাবে যোগদান করেছিলেন অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের উপসচিব ফাতেমা জোহরা। এই কর্মকর্তা প্রভাব খাটিয়ে চাকরিজীবনের বেশির ভাগ সময় ঢাকার আশপাশে এবং চাকরির ১২ বছরের সাত বছরই মন্ত্রণালয়ে পদায়ন ছিলেন। পরিকল্পনা কমিশন, পরিকল্পনা বিভাগ, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, নরসিংদী ও মুন্সীগঞ্জের জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় কাজ করেছেন এই কর্মকর্তা।

একইভাবে যোগদান করা পিএসসির পরিচালক আসমাউল হুসনা লিজা ঢাকা বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়ে যোগদান করেন। সহকারী কমিশনার হিসেবে নারায়ণগঞ্জের জেলা প্রশাসকের কার্যালয়, মানিকগঞ্জের ঘিওর, গাজীপুরের কাপাসিয়া এবং গাজীপুর সদরের সহকারী কমিশনার (ভূমি), মানিকগঞ্জ সদর ও টাঙ্গাইলের সখীপুরের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, শরীয়তপুরের এডিসি, পাবলিক সার্ভিস কমিশনের উপপরিচালক হিসেবে পদায়ন ছিলেন। অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় এলে তাকে বাংলাদেশ ফলিত পুষ্টি গবেষণা ও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটে বদলি করা হয়।

কারিগরি শিক্ষা অধিদফতরের আঞ্চলিক পরিচালক সুুলতানা রাজিয়া একইভাবে কুমিল্লা জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সহকারী কমিশনার হিসেবে যোগদান করেছিলেন। তারপর জামালাপুর সদরের সহকারী কমিশনার (ভূমি), শেরপুরের নকলা ও ময়মনসিংহের দেওয়ানগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার, ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশনের আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করেছেন। একইভাবে যোগদান করা গোপালগঞ্জ জেলার সাজিয়া আফরীন খুলনা বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়ে যোগদান করেন। খুলনা জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সহকারী কমিশনার, সাতক্ষীরার তালা ও দেবহাটা উপজেলা নির্বাহী অফিসার, চুয়াডাঙ্গার এডিসি, খুলনা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে কাজ করেছেন।

একইভাবে ইকোনমিক ক্যাডারে যোগদান করা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপসচিব লিউজা উল জান্নাহ পরিকল্পনা কমিশনে সহকারী প্রধান হিসেবে চাকরি শুরু করেন। এরপর মুন্সীগঞ্জ জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সিনিয়র সহকারী সচিব, মাগুরার শ্রীপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার, মেহেরপুরের এডিসি হিসেবে কাজ করেছেন। অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পরও এই কর্মকর্তা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে বহাল রয়েছেন।

পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপসচিব মিজ মুন্না রাণী বিশ্বাস একইভাবে ইকোনমিক ক্যাডারে যোগদান করেন। পরিকল্পনা কমিশনের সহকারী পরিচালক হিসেবে যোগদানের সাত মাসের মাথায় তিনি মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সহকারী প্রধান হিসেবে বদলি হয়ে চলে আসেন। সেখানে পাঁচ বছর চাকরি করার পর সিনিয়র সহকারী প্রধান পদোন্নতি নিয়ে আরো দু’ বছর মন্ত্রিপরিষদে চাকরি করে মৌলভীবাজারের জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে সিনিয়র সহকারী কমিশনার হিসেবে যোগদান করেন। এরপর উপসচিব পদোন্নতি দিয়ে তাকে পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে বদলি করা হয়।

একইভাবে বিসিএস পরিবার পরিকল্পনায় যোগদান করা মোহাম্মদ কায়সার খসরু পরবর্তীতে ৩১তম বিসিএসএ প্রশাসন ক্যাডারে যোগদান করেন। প্রায় চার বছর টাঙ্গাইল জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে সহকারী কমিশনার হিসেবে কাজ করার পর চট্টগ্রামের মিরসরাই উপজেলার সহকারী কমিশনার হিসেবে পদায়ন করা হয়। এরপর চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের ভূমি অধিগ্রহণ কর্মকর্তা, টেকনাফ ও হাতিয়ার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করেছেন। বর্তমানে গাজীপুরের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক হিসেবে কর্মরত আছেন এই কর্মকর্তা।

বিসিএস আনসার ক্যাডারে যোগদান করা শামীম আহমেদ জাপানে অধ্যয়নরত রয়েছেন। বিসিএস (শুল্ক ও আবগারি) ক্যাডারে কর্মরত রয়েছেন অস্পড়া বড়–য়া, ফরিদা ইয়াসমিন, ফাহমিদা মাহজাবীন, রোখসানা খাতুন। বিসিএস (পররাষ্ট্র) সুডানা ইকরাম চৌধুরী। বিসিএস (পুলিশ) যোগদান করা কর্মকর্তারা ইতোমধ্যে পুলিশ সুপার পদে পদোন্নতিও পেয়েছেন। তারা হলেন, র‌্যাবের উপপরিচালক আছাদুজ্জামান এপিবিএনের পুলিশ সুপার মাহফুজা আক্তার শিমুল। বিসিএস (কর) ক্যাডারে যোগদানকারীরা হলেন মোহাম্মদ শফিকুল ইসলাম, কামরুন নাহার শম্পা, মোসাম্মৎ মাকসুদা ইসলাম। শিক্ষা ক্যাডারে যোগদানকারী কর্মকর্তা হলেন এ টি এম কামরুজ্জামান।

এ দিকে ছাত্রলীগের সুপারিশ নিয়ে বাবার মুক্তিযুদ্ধের সার্টিফিকেট না থাকলেও এমনকি মুক্তিযোদ্ধা কোটাতে আবেদন না করেও অবৈধভাবে এই ব্যাচের সাথে যোগদান করেছেন ১৭ কর্মকর্তা। এর মধ্যে প্রশাসন ক্যাডারে দাপটের সাথে চাকরি করেছেন তিনজন।

এর মধ্যে বাংলাদেশ বনশিল্প উন্নয়ন করপোরেশনের সচিব হিসেবে চাকরি করছেন নাহিদা বারিক। এই কর্মকর্তা সহকারী কমিশনার হিসেবে নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে যোগদান করেন। এরপর সহকারী কমিশনার (ভূমি) হিসেবে বন্দর উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কার্যালয়, ফতুল্লা রাজস্ব সার্কেল, নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসার, কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিবের একান্ত সচিব, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের মতো গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় চাকরি করেছেন। অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর তাকে বনশিল্প করপোরেশনে বদলি করা হয়।

একইভাবে সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপসচিব রকিবুর রহমান খান চাকরিতে যোগদান করেন। ছাত্রলীগের প্রভাব খাটিয়ে পদায়ন বাগিয়ে নেন সহকারী কমিশনার (ভূমি) হিসেবে মতিঝিল ও ক্যান্টনমেন্ট সার্কেলের মতো জায়গায়। রাজউকের উপপরিচালক, নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁও ও ফরিদপুরের ভাঙ্গার ইউএনও, কৃষি মন্ত্রণালয়, বিদ্যুৎ বিভাগ, গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় পদায়ন ছিলেন। অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর তাকে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ে বদলি করা হয়।

একইভাবে ছাত্রলীগের সুপারিশে ভুয়া মুক্তিযুদ্ধ কোটায় নিয়োগ পাওয়া তোফাজ্জল হোসেন সহকারী কমিশনার (ভূমি) হিসেবে কাজ করেছেন মোহাম্মদপুর রাজস্ব সার্কেল, রমনা সার্কেল, ঢাকা জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সিনিয়র সহকারী কমিশনার, ঢাকার নবাবগঞ্জের উপজেলা নির্বাহী অফিসার, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের উপদেষ্টার একান্ত সচিব, নারায়ণগঞ্জের এডিসি, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়, তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রীর একান্ত সচিব হিসেবে। অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর তাকে জোনাল সেটেলমেন্ট অফিসার হিসেবে জামালপুরে বদলি করা হয়।

এ ছাড়াও পুলিশ ক্যাডারে মো: খোরশেদ আলম, সমবায় ক্যাডারে মো: কামরুজ্জামান, পরিবার পরিকল্পনা ক্যাডারে হালিমা খাতুন, সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারে (ভূগোল) হাফিজ আল আসাদ, রাষ্ট্রবিজ্ঞানে মিল্টন আলী বিশ্বাস। মো: জাকারিয়া, মো: শাব্বির আহম্মেদ, মঞ্জুর হোসেন, মামুন-অর-রশিদ, মো: আবদুল কাদির মিয়া, মো: জামসেদ হোসেন, ইমতিয়াজ মাহবুব, মনিরুজ্জামান, মো: মঈনুল হোসেন (চাচাকে বাবা দেখিয়েছে) থানা শিক্ষা অফিসার হিসেবে কর্মরত রয়েছেন।