
৩১ মার্চ, ২০২৪ সাল। কালের কণ্ঠে প্রকাশিত হয় এযাবৎকালের সেরা ধারাবাহিক অনুসন্ধানী প্রতিবেদন ‘বেনজীরের ঘরে আলাদিনের চেরাগ’। দুর্নীতিবাজ, স্বৈরাচারী আওয়ামী লীগ সরকারের অন্যতম লাঠিয়াল এবং কসাই সাবেক পুলিশ প্রধান বেনজীর। এ অনুসন্ধানী প্রতিবেদন ছিল ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের সীমাহীন দুর্নীতি, অনিয়ম ও লুটতন্ত্রের মুখোশ উন্মোচন।
এ প্রতিবেদন সারা দেশে সাড়া ফেলে। শুরু হয় আওয়ামী লুটতন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। এটিই ছিল আওয়ামী লীগ পতনের টার্নিং পয়েন্ট। জুলাই বিপ্লবে এ অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের অবদান ছিল অনেক। কিন্তু বেনজীরের দুর্নীতির এ রিপোর্ট প্রকাশের পর আক্রান্ত হয় বসুন্ধরা গ্রুপ। একের পর এক মিথ্যা, ভিত্তিহীন অসত্য মামলা দায়ের হতে থাকে। তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ওরফে কসাই কামাল নিজেই দায়িত্ব নেন ‘বসুন্ধরা গ্রুপ’কে শায়েস্তা করার। কামাল ও বেনজীরের সন্ত্রাসী বাহিনী লেলিয়ে দেওয়া হয় বসুন্ধরা গ্রুপের বিরুদ্ধে, বসুন্ধরা গ্রুপের মিডিয়া হাউসের কণ্ঠরোধ করতে। একের পর এক হত্যা, চাঁদাবাজি, সন্ত্রাসের উদ্ভট, কাল্পনিক মামলা দায়ের করা হতে থাকে। কালের কণ্ঠের অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে যখন তৎকালীন সরকারের যেখানে উচিত ছিল বেনজীরের দুর্নীতি, অপকর্মের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া, তার বদলে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বসুন্ধরা মিডিয়ার কণ্ঠরোধে উদ্যত হন। মজার ব্যাপার হলো, বসুন্ধরা মিডিয়ার কণ্ঠরোধ করতে যাদের সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ব্যবহার করেন, তারা সবাই ছিলেন চিহ্নিত সন্ত্রাসী, লুটেরা, মাদক ব্যবসায়ী এবং চাঁদাবাজ। এদের বিরুদ্ধে মাদক ব্যবসা, সন্ত্রাস, হত্যার একাধিক অভিযোগ ছিল। নিজেদের এলাকায় এরা মাদক ব্যবসায়ী, সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজ হিসেবে চিহ্নিত। এসব মামলা থেকে স্পষ্টতই বোঝা যায় তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পৃষ্ঠপোষকতায় এবং সরাসরি মদতে এরা তাদের অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছিল নির্বিঘ্নে, নিরাপদে। মিডিয়ার কণ্ঠরোধে এদেরই ব্যবহার করেন তৎকালীন দুর্নীতিবাজ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
বেনজীর আহমেদের দুর্নীতির চিত্র উন্মোচন করে বসুন্ধরা মিডিয়া আওয়ামী লীগ শাসনামলের লুটতন্ত্রের চেহারাই উন্মোচন করে। এর বিপরীতে সরকার বসুন্ধরার বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেয় শীর্ষ সন্ত্রাসী ও মাদক ব্যবসায়ীদের। বসুন্ধরা গ্রুপের বিরুদ্ধে সে সময় যারা মিথ্যা, হয়রানিমূলক মামলা দায়ের করেছিল, তাদের মধ্যে ছিল মো. ইমদাদুল হকসহ আরও কয়েকজন। তারা শীর্ষ সন্ত্রাসী ও আসাদুজ্জামান খান কামালের দোসর। মূলত, নারায়ণগঞ্জ রূপগঞ্জে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সন্ত্রাসী বাহিনীর নেটওয়ার্ক লেলিয়ে দেওয়া হয়েছিল বসুন্ধরা মিডিয়ার কণ্ঠরোধের জন্য। আর স্বপ্রণোদিত হয়ে বসুন্ধরা গ্রুপের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করিয়েছিলেন তখনকার নারায়ণগঞ্জ জেলার এসপি গোলাম মোস্তফা রাসেল। তিনি ছিলেন কামালের অন্যতম ক্যাশিয়ার।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল জনগণের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন না। তিনি ছিলেন সন্ত্রাসীদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। জনগণের জানমালের হেফাজত নয়, বরং সন্ত্রাসীদের অবাধে সন্ত্রাসের সুযোগ করে দেওয়াই ছিল তার প্রধান কাজ। বিনিময়ে তাদের কাছ থেকে পেতেন বিপুল অঙ্কের টাকা। ১০ বছরের বেশি সময় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী থাকাকালীন কামাল গড়ে তুলেছিলেন ঘুষের সাম্রাজ্য।
কয়েকজন সহযোগীকে নিয়ে ঘুষের বিশাল নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছিলেন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। এই সাম্রাজ্যের হাত এত লম্বা ছিল যে, ঘুষ-চাঁদা না দিলেই পড়তে হতো কোপানলে। জীবন নাজেহাল হয়ে যেত।
পুলিশ, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর ও ফায়ার সার্ভিস থেকে আদায় করা হতো ঘুষের অর্থ। বস্তায় ভরে নেওয়া হতো টাকা। আর ব্যবসায়ী, পেশাজীবী ও সাধারণ মানুষ পড়তেন চাঁদাবাজির কবলে। ঘুষ-চাঁদাবাজির অর্থ নিরাপদে রাখতে পাচার করে দেওয়া হতো দেশের বাইরে। শীর্ষ সন্ত্রাসী, মাদক ব্যবসায়ীরাই ছিলেন কামালের অবৈধ সম্পদের প্রধান উৎস।
কিন্তু সাম্রাজ্যের পতনের পরই কামালের ঘুষ কারবারের থলের বিড়াল বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে। এরই মধ্যে ঘুষ গ্রহণ ও অর্থ পাচারের অভিযোগে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কামালসহ তার দুই সহযোগীর বিরুদ্ধে অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
দুদকের কাছে এরই মধ্যে কামালের অভিযোগের পাহাড় জমেছে। অনুসন্ধানের জন্য কমিশনের উপপরিচালক মো. জাহাঙ্গীর আলমের নেতৃত্বে টিম গঠন করা হয়েছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, আসাদুজ্জামান কামাল ঘুষ-চাঁদাবাজির জন্য তখনকার অতিরিক্ত সচিব ড. হারুন অর রশীদ বিশ্বাসের নেতৃত্বে একটি চক্র গড়ে তোলেন। এই চক্রের সদস্যরা হলেন- যুগ্মসচিব ধনঞ্জয় কুমার দাস, নারায়ণগঞ্জ জেলার এসপি গোলাম মোস্তফা রাসেল, মন্ত্রীর সহকারী একান্ত সচিব (এপিএস) মনির হোসেন, মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তা শরীফ মাহমুদ অপু, প্রশাসনিক কর্মকর্তা মোল্লা ইব্রাহিম হোসেন।
টাকা আদায় বা উত্তোলনে মূল ভূমিকা পালন করতেন হারুন অর রশীদ বিশ্বাস। হাজার হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন এই কামাল-হারুন সিন্ডিকেট। একপর্যায়ে হারুন অর রশীদ অবসরে গেলেও মন্ত্রণালয়ের সব ঘুষ, দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ করতেন তিনিই। আর ওইসব অর্থ নিরাপদে রাখতে পাঠানো হয়েছে দেশের বাইরে। টাকা দেশের বাইরে পাচারের ব্যবস্থা করতেন কামালের ব্যবসায়িক পার্টনার এস আলম গ্রুপের একটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক।
এই চক্র জেলায় পুলিশ সুপার নিয়োগে সর্বনিম্ন ৮০ লাখ থেকে দুই কোটি টাকা পর্যন্ত ঘুষ নিত। তাদের আশীর্বাদ ছাড়া পুলিশের কেউ কোনো জেলায় বা গুরুত্বপূর্ণ পদে পদায়ন পেতেন না। জেলা পুলিশ সুপার হিসেবে পদোন্নতির ক্ষেত্রে ঘুষ আদায় করা হতো ১ থেকে ৩ কোটি টাকা।
বিভিন্ন প্রমাণ ঘেঁটে দেখা গেছে, ২০২২ সালের ৩০ জুন গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের (জিএমপি) কমিশনার হিসেবে নিয়োগ পান ডিআইজি মোল্লা নজরুল ইসলাম। ৫ কোটি টাকার বিনিময়ে মোল্লা নজরুলকে গাজীপুরের কমিশনার হিসেবে পদায়ন করা হয়। এর মাস খানেক আগে হারুন অর রশীদ বিশ্বাসের কাছে ৫ কোটি টাকার একটি চেক দেন মোল্লা নজরুল। গাজীপুরের কমিশনার হিসেবে নিয়োগের পর হোটেল ওয়েস্টিনে হারুন অর রশীদের কাছ থেকে ৫ কোটি টাকার চেক ফেরত নেন। এর বদলে তিনি নগদ টাকা ২ কোটি আর বাকি ৩ কোটি টাকার আরেকটি চেক দেন। আর লেনদেনের এসব টাকা বস্তায় ভরে পৌঁছে দেওয়া হতো আসাদুজ্জামান খান কামালের তেজগাঁওয়ের মনিপুরী পাড়া এলাকার বাসায়।
কামালের ছেলে সাফি মোদ্দাসের খান জ্যোতির ছিল আরেকটি চক্র। পিতা-পুত্রের দ্বন্দ্বও হয়েছে বিভিন্ন সময়। পুলিশের এক কর্মকর্তাকে বদলি করতে গিয়ে ব্যর্থ হন জ্যোতি। কামাল তাকে জানান, হারুন অর রশীদের সঙ্গে কথা বলতে। এ নিয়ে গত জুন মাসে বাসায় কলহ তৈরি হয়। ক্ষুব্ধ হয়ে বাসায় ব্যাপক-ভাঙচুর করেন জ্যোতি।
এদিকে এনজিওর ‘নো অবজেকশন সার্টিফিকেট’ বা ‘এনওসি’ দিতে গিয়ে প্রতি সংস্থা থেকে ৮০ লাখ থেকে ১ কোটি টাকা চাঁদা দিতে হতো আসাদুজ্জামান খান কামালের দরবারে। ২০১৮ সালে রাজধানীর উত্তরা এলাকার একটি উন্নয়ন সংস্থার এনওসি নিতে গেলে বিপত্তি শুরু হয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। পুলিশের বিশেষ শাখা, জেলা প্রশাসক, এনএসআই ইতিবাচক প্রতিবেদন দাখিল করে। তারপরও অদৃশ্য কারণে ফাইলটি মাসের পর মাস আটকে রাখা হয় মন্ত্রণালয়ে। বাধ্য হয়ে ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে নির্বাচনের আগে মন্ত্রীকে ৮৫ লাখ টাকা দেয় সেই এনজিও। মনিপুরী পাড়ায় কামালের বাসার সামনে টাকার ব্যাগটি দেওয়া হয় তার পরিবারের এক সদস্যের কাছে।
ফায়ার সার্ভিস এবং সিভিল ডিফেন্সে কোনো সার্কুলার হলেই মন্ত্রীর দপ্তর থেকে একটি তালিকা পাঠানো হতো। সেই অনুযায়ী নিয়োগ দিতে ফায়ার সার্ভিসকে বাধ্য করতেন সাবেক এই মন্ত্রী। ২০২৩ সালে ২ অক্টোবর ৫৩৫ জনকে নিয়োগ দেয় ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তর। এর মধ্যে ছিলেন ৪৩৬ পুরুষ ফায়ার ফাইটার, ১৫ জন নারী ফায়ার ফাইটার ও ৮৪ জন গাড়িচালক। নিয়োগ কার্যক্রমের শুরুতেই মন্ত্রীর দপ্তর থেকে ২৫০ জনের একটি তালিকা পাঠানো হয় ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের কাছে। সাবেক এই মন্ত্রীর নির্দেশে সেই তালিকা মোতাবেক নিয়োগ দিতে বাধ্য হয় ফায়ার সার্ভিস। সেই নিয়োগে জনপ্রতি ৮ থেকে ১২ লাখ টাকা নেন কামাল-হারুন সিন্ডিকেট। এভাবেই ঘুষের নেটওয়ার্ক করে বাংলাদেশকে সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজ, মাদক ব্যবসায়ীদের অভয়ারণ্যে পরিণত করেছিলেন আসাদুজ্জামান খান কামাল।