
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্রের সাংবিধানিক নয়, রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির পক্ষে বিএনপি। গত বুধবার ও মঙ্গলবার দুই দফায় অনুষ্ঠিত দলটির জাতীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে এ মত উঠে এসেছে। বৈঠকে মতামত দিয়ে দলটির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতারা বলেছেন, জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে ঘোষণাপত্র প্রণীত হওয়ার পর রাষ্ট্রের যথাযথ প্রসিডিউর অনুযায়ী এটিকে আর্কাইভ (সংরক্ষণ) করার পক্ষে তারা। সংবিধানের মূলনীতিতে অন্তর্ভুক্তের বিষয়ে একমত নন দলটির নীতিনির্ধারকরা।
সরকার ও রাজনৈতিক সূত্রগুলো জানিয়েছে, চলতি মাসের শেষ সপ্তাহের মধ্যে জুলাই ঘোষণাপত্র চূড়ান্ত করতে চায় সরকার। এটি চূড়ান্ত করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে সরকারের পরিকল্পনা উপদেষ্টা ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমদুকে। গত মঙ্গলবার জুলাই ঘোষণাপত্রের একটি খসড়া মতামতের জন্য বিএনপির কাছে পাঠায়। ইতোমধ্যে বিএনপি মতামত সহকারে খসড়াটি পরিকল্পনা উপদেষ্টার কাছে ফেরত পাঠিয়েছে।
এ বিষয়ে গতকাল এক অনুষ্ঠানে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, কয়েক দিন আগে সরকারের তরফ থেকে মতামত চাওয়া হয়েছে। আমরা গতকাল (বুধবার) রাতে সেই মতামত দিয়ে দিয়েছি। তিনি আরও বলেন, আমরা তিনবার সরকার চালিয়েছি। তাই সরকার, দেশ, জনগণ, রাষ্ট্র, পররাষ্ট্র, ভূরাজনীতি সম্পর্কে ধারণা আমাদের কোনো অংশে কম নেই। আমরাই প্রথম নতুন বাংলাদেশ চেয়েছি, আমরাই রাষ্ট্র কাঠামো পরিবর্তন করতে চেয়েছি, আমরাই অর্থনৈতিক কাঠামোর পরিবর্তন চেয়েছি।
অন্তর্বর্তী সরকারের তরফ থেকে বিএনপির কাছে পাঠানো জুলাই ঘোষণাপত্রের খসড়া নিয়ে দলীয় মতামত চূড়ান্তকরণ বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। এই বৈঠক শেষে বুধবার রাতেই খসড়ায় প্রয়োজনীয় সংযোজন-বিয়োজন এনে তা চূড়ান্ত করে সরকারকে দেওয়া হয়েছে।
দলের জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ঘোষণাপত্র তো ঘোষণাপত্র। এটি একটি রাজনৈতিক দলিল, যা আর্কাইভে (সংরক্ষণাগার) থাকতে পারে।
জুলাই ঘোষণাপত্রকে সংবিধানের মূলনীতিতে অন্তর্ভুক্তের বিষয়ে বিএনপি একমত নয়। এ বিষয়ে দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ঘোষণাপত্রের পুরোটা না নিয়ে জুলাই-আগস্ট ছাত্র গণ-অভ্যুত্থানের চেতনাটুকু ধারণ করে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য চতুর্থ তফসিলে শুধু ‘জুলাই অভ্যুত্থান ২০২৪’ আনা যেতে পারে।
সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, বাংলাদেশের সংবিধান ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর থেকে কার্যকর হয়। তখন কিন্তু স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের কার্যকারিতা শেষ। সে ঘোষণাপত্র চতুর্থ তফসিলে এসে স্বীকৃতি দেওয়া হয়, প্রতিটি আইন কিন্তু সংবিধানে উল্লেখিত নয়। বলা হলো, এটা তফসিলে থাকবে, এটাই বৈধতা, স্বীকৃতি। তিনি আরও বলেন, ঘোষণাপত্র লিটারেচার হিসেবে, ডকুমেন্টারি হিসেবে আর্কাইভে থাকে, সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত থাকে না। ’৭২-এর সংবিধানে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রকে সংযুক্ত না করা এটা প্রমাণ করে, কোনো ঘোষণাপত্র সংবিধানের অংশ হয় না। ঘোষণাপত্র হলো ঘোষণাপত্র, এটার রাজনৈতিক, ঐতিহাসিক গুরুত্ব থাকে, এটা আর্কাইভে থাকে। এটাকে জাতি বিভিন্ন সময় বিভিন্নভাবে উল্লেখ করে, স্মরণ করে।
সালাহউদ্দিন আহমেদ আরও বলেন, আমরা গণ-অভ্যুত্থান ২০২৪-এর গুরুত্ব, মর্যাদা, মহিমা ধারণ করি। আমরা এটাকে স্বীকৃতি দিই, সারা জাতি এটাকে স্বীকৃতি দেয়। এটাকে আমরা যথাযথ মর্যাদায় রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃতি দিতে চাই।
বিএনপি জুলাই ঘোষণাপত্রকে চতুর্থ তফসিলে অন্তর্ভুক্ত করার পক্ষে জানিয়ে তিনি বলেন, আর্টিকেল ১০৬ অনুসারে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকারের নিয়োগ এবং কর্মকা-ের বৈধতা চতুর্থ তফসিলে যুক্ত করে বৈধতা দেওয়া যেতে পারে।
দলের জাতীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠক সূত্র জানায়, বৈঠকে নেতারা বলেছেন, ২০২৪ সালের গণ-অভ্যুত্থান সংবিধানে স্থান দেওয়া হলে তাতে ভবিষ্যতে জটিলতা বাড়তে পারে। কেউ কেউ আবার স্বৈরাচারবিরোধী গণ-অভ্যুত্থানকেও সংবিধানে রাখার দাবি তুলতে পারে। এ জন্য তারা রাজনৈতিক দলিল হিসেবে রাষ্ট্র্রের আর্কাইভে ২০২৪ সালের ঘোষণাপত্র সংরক্ষণের পক্ষে মত দিয়েছেন।
স্থায়ী কমিটির একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, খসড়ার প্রথম পয়েন্টে উল্লেখিত আছেÑ ‘বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের এ ভূখ-ের মানুষ স্বাধীনতা অর্জনের জন্য যুগের পর যুগ সংগ্রাম করেছিল এবং এর ধারাবাহিকতায় পাকিস্তান আন্দোলনের মাধ্যমে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন থেকে ১৯৪৭ সাল থেকে স্বাধীনতা অর্জন করেছিল।’ এই অংশ অপ্রয়োজনীয় বিবেচনা করে তা বিএনপি বাদ দিয়েছে। তবে পাকিস্তানের ২৩ বছরের শোষণ থেকে মুক্তির লক্ষ্যে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের প্রসঙ্গটি রাখা হয়েছে। দলটির নেতারা বলেছেন, ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে গৌরবময় বিজয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সেই স্বাধীনতা যুদ্ধকেই প্রধান অর্জন হিসেবে উল্লেখ করে ঘোষণাপত্র শুরু হওয়া উচিত।
খসড়া ঘোষণাপত্রের এক জায়গায় আছেÑ ‘যেহেতু পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন শাসনামলের রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো বিনির্মাণের ব্যর্থতা ও অপর্যাপ্ততা ছিল এবং এ কারণে বাংলাদেশের প্রাতিষ্ঠানিক গণতন্ত্র, আইনের শাসন ও শাসকগোষ্ঠীর জবাবদিহি প্রতিষ্ঠা করা যায়নি।’ বিএনপি এ ক্ষেত্রে ‘বিভিন্ন শাসনামলের জায়গায়’ ‘আওয়ামী শাসনামলের’ কথা উল্লেখ করেছে।
খসড়ায় এক-এগারো সংশ্লিষ্ট একটি পয়েন্টে উল্লেখিত ‘ক্ষমতার সুষ্ঠু রদবদলের রাজনৈতিক ব্যর্থতার সুযোগে’ কথাগুলো পরিবর্তন করে ‘দেশি-বিদেশি চক্রান্তের সুযোগে’ লেখার সুপারিশ করেছে বিএনপি।
এ ছাড়া দলটি ১৯৭২ সালের ‘সংবিধান পুনর্লিখন বা প্রয়োজনে বাতিল করার অভিপ্রায়’ বাদ দিয়ে ‘সংবিধানের বিদ্যমান সংস্কার উপযুক্ত প্রক্রিয়ায় সংশোধন’ করার পক্ষে মত দিয়েছে।
জানা গেছে, ঘোষণাপত্রের খসড়া থেকে ‘সেকেন্ড রিপাবলিক’ প্রসঙ্গটি বাদ দিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। গত জানুয়ারি মাসে প্রস্তুত করা ঘোষণাপত্রের খসড়ার শেষ অংশে ‘সেকেন্ড রিপাবলিক’ কথাটি উল্লেখ ছিল। জানা গেছে, এর বাইরেও খসড়ায় আরও কিছু শব্দগত সংযোজন-বিয়োজন করেছে বিএনপি।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটি গত বছরের ৩১ ডিসেম্বর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র প্রকাশ করতে চেয়েছিল। হঠাৎ ঘোষণাপত্রের বিষয়টি আসায় বিভিন্ন মহল থেকে প্রশ্ন ওঠে। তখন সরকারের পক্ষে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব জানিয়েছিলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের একটি ঘোষণাপত্র তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ অবস্থায় নিজেদের অবস্থান থেকে সরে এসে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটি ঘোষণাপত্র প্রকাশের জন্য অন্তর্বর্তী সরকারকে ১৫ জানুয়ারি পর্যন্ত সময় বেঁধে দেয়। তবে ছাত্রদের দেওয়া সময়সীমা শেষ হওয়ার পরদিন গত ১৬ জানুয়ারি জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র চূড়ান্ত করার লক্ষ্যে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও অংশীজনের সঙ্গে মতবিনিময় করেন। কিন্তু পরবর্তী সময়ে এই ইস্যুতে সরকারের কার্যক্রম ধীরগতিতে চলতে থাকে। গত ৩০ জুন প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনার সামনে অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন জুলাই আন্দোলনে আহতরা। নতুন রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) সম্প্রতি সরকারকে আগামী ৩ আগস্টের মধ্যে জুলাঘোষণাপত্র ঘোষণার দাবি জানিয়েছে। এ অবস্থায় চলতি জুলাই মাসের মধ্যেই ঘোষণাপত্র প্রকাশ করতে কাজ করে যাচ্ছে সরকার।