
২০২৪ সালে পুঁজিবাজারে শেয়ারধারীদের লভ্যাংশ দিতে পারেনি ১৯ ব্যাংক। এগুলোর মধ্যে সাতটি ব্যাংক লোকসানের মুখে পড়ে। অপরদিকে, বাকি ১২ ব্যাংক মুনাফা দেখালেও অপর্যাপ্ত মূলধন ও খেলাপি ঋণের প্রভিশনিং ঘাটতি থাকায় লভ্যাংশ দিতে পারেনি।
এসব আর্থিক প্রতিষ্ঠান লভ্যাংশ দেওয়ার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে অনুমতি চেয়ে আবেদন করে।
তবে ব্যাংক কোম্পানি আইনের কথা উল্লেখ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক তাদের অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করে। আর্থিকভাবে অসচ্ছল ব্যাংকগুলোকে লভ্যাংশ ঘোষণা করা থেকে বিরত রাখা হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের বিধিনিষেধ অনেক সাধারণ বিনিয়োগকারীকে হতাশ করে তুললেও পুঁজিবাজার বিশ্লেষকরা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সিদ্ধান্তকে সমর্থন করে বলেছেন যে এই সিদ্ধান্তের মাধ্যমে স্বল্পমেয়াদি মুনাফার তুলনায় দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীলতাকে অগ্রাধিকার দিয়েছে।
দেশের পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ব্যাংক ৩৬টি। ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড ও ইউনিয়ন ব্যাংক এখনো তাদের ২০২৪ সালের আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেনি।
মুনাফা করলেও যে ব্যাংকগুলোকে লভ্যাংশ দিতে দেওয়া হয়নি সেই ১২ ব্যাংক হচ্ছে—আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংক, এক্সিম ব্যাংক, রূপালী ব্যাংক, মার্কেন্টাইল ব্যাংক, ওয়ান ব্যাংক, সাউথইস্ট ব্যাংক, এনআরবি ব্যাংক, এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংক, প্রিমিয়ার ব্যাংক, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক, ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক ও সাউথ বাংলা এগ্রিকালচার অ্যান্ড কমার্স ব্যাংক।
লোকসানে থাকা ব্যাংকগুলো হচ্ছে—এবি ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক, আইএফআইসি ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক ও সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক।
মূলধন ও প্রভিশনিংয়ের ঘাটতি দূর করতে বাংলাদেশ ব্যাংক মুনাফা অর্জনকারী ১২ ব্যাংককে তাদের নিজ নিজ বোর্ড কর্তৃক অনুমোদিত বাস্তবসম্মত ও সময়াবদ্ধ কর্মপরিকল্পনা জমা দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে।
এ ছাড়াও, গত মার্চে লভ্যাংশ দেওয়ার ক্ষেত্রে আরও কঠোর হয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
বর্তমানে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে প্রভিশনিং ডেফারাল পাওয়া ব্যাংকগুলোকে লভ্যাংশ দেওয়ার অনুমতি দেওয়া হয় না। আগামী বছর থেকে যেসব ব্যাংকের খেলাপি মোট ঋণের ১০ শতাংশের বেশি হবে তাদের ক্ষেত্রেও এই বিধিনিষেধ প্রযোজ্য।
ব্যাংকগুলোকে লভ্যাংশ দেওয়া থেকে বিরত রাখার বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সিদ্ধান্তকে সমর্থন জানিয়েছেন শান্তা অ্যাসেট ম্যানেজমেন্টের প্রধান নির্বাহী কাজী মনিরুল ইসলাম।
তিনি দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'ব্যাংকিং ব্যবসায় প্রচুর মূলধন প্রয়োজন। মূলধন ভিত্তি শক্তিশালী না করে তারা যদি লভ্যাংশ দেয়, তাহলে তা দীর্ঘমেয়াদে তাদের টিকে থাকার ওপর প্রভাব ফেলবে।'
এই কর্মকর্তা মনে করেন, পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারীরা হতাশা প্রকাশ করলেও মূলধন ভিত্তি শক্তিশালী হলে ব্যাংকগুলো তাদের আমানত ও ঋণ দেওয়ার পরিমাণ বাড়ানোর সক্ষমতা অর্জন করবে।
সিএফএ সোসাইটি বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট আসিফ খান ডেইলি স্টারকে বলেন, 'অনেক ব্যাংকের মূলধন কম। তাদের মূলধন ভিত্তি উন্নত করতে যতটা সম্ভব মুনাফা ধরে রাখা গুরুত্বপূর্ণ।'
তিনি আরও বলেন, 'একবার এই ব্যাংকগুলো ন্যূনতম মূলধনের প্রয়োজনীয়তা পূরণ করলে লভ্যাংশ দেওয়া আবার শুরু করতে পারবে। নতুন আমানত সংগ্রহ বা বাজারে বন্ড ছাড়া হলে তা তাদের সংকট দ্রুত কাটাতে সহায়তা করতে পারে।'
২০১০ সালের দিকে আকর্ষণীয় লভ্যাংশ দেওয়ায় ঢাকার পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারীদের কাছে ব্যাংকগুলোর শেয়ারের চাহিদা বেশি ছিল।
কিন্তু এখন অনেকে কম মুনাফা হয় এমন শেয়ারে বিনিয়োগ করতে চান।
এমন পরিস্থিতিতে ব্যাংকগুলোর সংকট শেয়ারের দামে ব্যাপকভাবে প্রভাব ফেলে।
পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ৩৬ ব্যাংকের মধ্যে ১৬টির শেয়ার অভিহিত দামের নিচে অর্থাৎ তিন থেকে আট টাকা ৬০ পয়সায় লেনদেন করছে। বাজার চাহিদা কমে যাওয়ায় বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করতে হিমশিম খাচ্ছে বেশ কয়েকটি ব্যাংক।
ছোট আমানতকারীরা এই কম-চাহিদার শেয়ারগুলো ধরে রেখে বিপাকে পড়েছেন। এমন পরিস্থিতি থেকে বের হওয়ার উপায় অনেকের কাছেই নেই।
পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারী জাকির হোসেন ডেইলি স্টারকে জানান, তিনি আর্থিক প্রতিবেদনের ওপর আস্থা রেখে তালিকাভুক্ত ব্যাংকগুলোর শেয়ার কিনেছেন। তার বিশ্বাস, প্রতিষ্ঠানগুলো বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে প্রতারণা করবে না।
'কিন্তু রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর গত বছর হঠাৎ করে ব্যাংকগুলো বিপুল পরিমাণ খেলাপি ঋণের খবর দেয়। ফলে তাদের আয় কমে যায় এবং লোকসান হয়।'
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে—গত মার্চের শেষে ব্যাংকিং খাতে মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ রেকর্ড চার লাখ ২০ হাজার ৩৩৫ কোটি টাকা হয়।
ব্যাংকগুলোর নিরীক্ষক, ক্রেডিট রেটিং এজেন্সি ও স্বতন্ত্র পরিচালকদের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলে জাকির হোসেন বলেন, 'সাধারণ বিনিয়োগকারীরা যদি বুঝতে পারতেন তাহলে এসব ব্যাংকে বিনিয়োগ করে লোকসানে পড়তেন না।'
তিনি ব্যাংক পরিচালকদের জবাবদিহিতার আওতায় আনার ও সরকারি তহবিলের অব্যবস্থাপনা ও বিনিয়োগকারীদের আস্থা কমে যাওয়ার পেছনে দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানান।