
খাতা দেখার উদার নীতি’ থেকে সরে আসায় মাধ্যমিক ও সমমান পরীক্ষার ফলে শিক্ষার্থীদের মেধার প্রকৃত চেহারা বেরিয়ে এসেছে। সরকারের এই এক সিদ্ধান্তে নেমে গেছে পাসের হার; কমেছে জিপিএ ৫। শেষ ১৫ বছরের মধ্যে এত খারাপ ফল আর হয়নি।
গত দুই দশকে পাবলিক পরীক্ষার ফলের উল্লম্ফন নিয়ে নানা কথা চাউর ছিল। খাতা দেখার ক্ষেত্রে সরকারের ‘উদার নীতি’ বরাবরই সমালোচকদের নিন্দা কুড়িয়েছে। যদিও অতীতে সরকার কখনও তা স্বীকার করেনি। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর বদলে যাওয়া বাংলাদেশে এবারের এসএসসিই ছিল প্রথম পাবলিক পরীক্ষা।
শিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক সি আর আবরার আগেই বলেছিলেন, ‘সহানুভূতির নম্বর’ এবার থাকবে না। সংশ্লিষ্টরা জানান, ‘সহানুভূতির নম্বর’ বলতে পাবলিক পরীক্ষার খাতায় নম্বর কম থাকলে অতিরিক্ত নম্বর দিয়ে পাস করানো বা গ্রেড উন্নীত করার জন্য যে প্রথা প্রচলিত ছিল, তা বোঝানো হয়। এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার মতো পাবলিক পরীক্ষায় এ ধরনের ‘সহানুভূতির নম্বর’ দেওয়া বন্ধ করেছে সরকার।
আরও স্পষ্ট করে বললে, আগে ২৮ নম্বর পেলে ৩৩ করে পাস করানো বা ২-৫ নম্বর বাড়িয়ে গ্রেড উন্নীত করার যে অলিখিত নিয়ম ছিল, তা এখন আর নেই। এ ছাড়া অপ্রাসঙ্গিক বা ভুল উত্তরেও নম্বর দেওয়ার যে প্রথা ছিল, তাও বাতিল করা হয়েছে। আর সরকারের এ সিদ্ধান্তের প্রথম প্রভাব পড়েছে এবারের এসএসসি ও সমমান পরীক্ষার ফলে।
ফল বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, সব বোর্ডেই গণিতে পাসের হার আশঙ্কাজনক হারে কমেছে। অন্যান্য বিষয়ের চেয়ে গণিতেই বেশি শিক্ষার্থী অকৃতকার্য হয়েছে।
ফলের বিভিন্ন সূচক পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, শতভাগ পাস করা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা কমেছে। বিপরীতে বেড়েছে শতভাগ ফেল করা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা। শহর ও গ্রামাঞ্চলের শিক্ষার্থীদের মধ্যে ব্যবধান বেড়েছে। মানবিক শাখার শিক্ষার্থীরা আরও পিছিয়েছে।
গতকাল প্রকাশিত ফল অনুসারে, শহরের শিক্ষার্থীরাই মাধ্যমিকের ফলের শীর্ষে। পিছিয়ে পড়েছে গ্রামের শিক্ষার্থী। ঢাকা নগরীতে ৮০ শতাংশের বেশি শিক্ষার্থী পাস করেছে। অথচ একই বোর্ডের টাঙ্গাইলে পাসের হার ৬৩ শতাংশ, মুন্সীগঞ্জে ৬৭ শতাংশ। এতে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে– গ্রামের শিক্ষার্থীরা এখনও পিছিয়ে।
কাউকে দেওয়া হয়নি গ্রেস মার্ক
এবারের ফল নিয়ে মূল্যায়নে কোনো রাখঢাক করেননি আন্তঃশিক্ষা বোর্ড সমন্বয় কমিটির সভাপতি ও ঢাকা বোর্ড চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. খন্দোকার এহসানুল কবির। ফল প্রকাশ অনুষ্ঠানে তিনি স্পষ্টভাবে বলেছেন, যে ফল আমরা প্রকাশ করলাম, এটিই প্রকৃত। এবার বাড়তি নম্বর (গ্রেস মার্ক) কাউকে দেওয়া হয়নি।
এহসানুল কবির বলেন, বিগত সময়ে কী হয়েছে, কীভাবে ফল তৈরি করা হয়েছে; তা আমরা বলব না। উত্তরপত্র যথাযথভাবে মূল্যায়নের পর যা এসেছে, এবার সেটি উপস্থাপন করা হয়েছে। এতে আমাদের হাত নেই। এবার আমাদের ওপরমহল থেকে চাপ ছিল না। আমরাও পরীক্ষকদের এ অনুরোধ জানিয়েছি। তাদের যথার্থভাবে খাতা মূল্যায়ন করতে বলা হয়েছে।
পাসের হারে ধস
ফল বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ২০১০ সালের পর আর কখনও এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় পাসের হার এত কম ছিল না। এবার পাস করেছে ৬৮ দশমিক ৪৫ শতাংশ শিক্ষার্থী। স্কুলের গণ্ডি পেরোনো এই শিক্ষার্থীদের মধ্যে ১ লাখ ৩৯ হাজার ৩২ জন জিপিএ ৫ পেয়েছে, যা পাস করা শিক্ষার্থীর ১০ দশমিক ৬৬ শতাংশ। এ হিসাবে গত বছরের চেয়ে এবার পাসের হার কমেছে ১৪ দশমিক ৫৯ শতাংশ। পূর্ণাঙ্গ জিপিএ ৫ পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমেছে ৪৩ হাজার ৯৭। গত বছর পাস করেছিল ৮৩ দশমিক ০৪ শতাংশ; জিপিএ ৫ পেয়েছিল ১ লাখ ৮২ হাজার ১২৯ জন।
দেড় দশকের মধ্যে ২০২১ সালে রেকর্ড ৯৩ দশমিক ৬ শতাংশ শিক্ষার্থী এসএসসি পাস করে। এ সময়ের মধ্যে ২০১৮ সালে পাসের হার ছিল সবচেয়ে কম; ৭৭ দশমিক ৮ শতাংশ।
দিনাজপুর শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মহা. তৌহিদুল ইসলাম বলেন, এবার সব বোর্ডের ফল খারাপ। এর পরও বিষয়টি যাচাই করে দেখা হচ্ছে। তবে পরীক্ষায় পাসের হার কম হওয়ার পেছনে রয়েছে গণিত। এ বিষয়ে অধিকাংশ শিক্ষার্থী খারাপ ফল করেছে, যা মোট হারের ওপর প্রভাব ফেলেছে।
গণিতে ভরাডুবি
১১ বোর্ডের বিষয়ভিত্তিক পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গণিতে সবচেয়ে ভালো করেছে কারিগরি শিক্ষা বোর্ড, যা ৮৮ দশমিক ৭২ শতাংশ। ঢাকা বোর্ডে গণিতে পাস করেছে ৭৫ দশমিক ১৪ শতাংশ। রাজশাহী বোর্ডে এ হার কিছুটা ভালো; ৮৬ দশমিক ৫২ শতাংশ। যশোরে ৮৫ দশমিক ০২ শতাংশ, চট্টগ্রামে ৮১ দশমিক ৫৩ শতাংশ আর সিলেটে ৮৩ দশমিক ১৭ শতাংশ। মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডেও গণিতে পাসের হার কম। সেখানে ৭৯ দশমিক ৭৩ শতাংশ শিক্ষার্থী কৃতকার্য হয়েছে।
তবে কুমিল্লা, দিনাজপুর ও ময়মনসিংহ বোর্ডের শিক্ষার্থীরা গণিতে আটকে যায়। কুমিল্লায় গণিতে পাস করেছে ৭২ দশমিক ০১ শতাংশ, দিনাজপুরে ৭১ দশমিক ৩৫ শতাংশ, বরিশালে ৬৪ দশমিক ৬২ শতাংশ এবং ময়মনসিংহে ৬৪ দশমিক ২৭ শতাংশ।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গণিত নিয়ে এখনও শিক্ষার্থীদের মধ্যে ভীতি রয়ে গেছে। পাশাপাশি গণিত শিক্ষকের সংকট, মানসম্মত পাঠদানের অভাব ও পর্যাপ্ত অনুশীলনের সুযোগ না থাকায় এমন ফল হচ্ছে। একই সঙ্গে পরীক্ষার্থীদের মধ্যে গাণিতিক ধারণার দুর্বলতা, অনুশীলনমূলক প্রশ্নে অনভ্যস্ততা এবং পাঠ্যবইনির্ভর না হয়ে কোচিং ও গাইডের ওপর নির্ভরতাও বিশেষ কারণ বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
ঢাকা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক অধ্যাপক এস এম কামাল উদ্দিন হায়দার বলেন, স্কুল পর্যায়ে গণিত শিক্ষার পদ্ধতিগত পরিবর্তন এবং হাতে-কলমে শিক্ষাদানের সুযোগ বাড়ানো না হলে ভবিষ্যতেও এমন বিপর্যয় এড়ানো কঠিন হবে।
ইংরেজি-গণিতে ধরাশায়ী বরিশাল
ফল বিশ্লেষণে উঠে এসেছে, এবার ফলের তলানিতে রয়েছে বরিশাল শিক্ষা বোর্ড। ইংরেজি ও গণিত বিষয়ের দুর্বল ফলের কারণে বরিশালে সামগ্রিক পাসের হারে ধাক্কা লেগেছে। এ দুই বিষয়ে অনেক শিক্ষার্থী অকৃতকার্য হয়েছে।
বরিশাল বোর্ডে ইংরেজিতে পাসের হার ৬৯ দশমিক ৬৬ শতাংশ; গণিতে আরও কম; ৬৪ দশমিক ৬২ শতাংশ। ইংরেজি ও গণিত– এ দুটি মূল বিষয়ের প্রতিটিতেই প্রায় এক-তৃতীয়াংশ শিক্ষার্থী অকৃতকার্য হয়েছে।
বরিশাল শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ইউনুস আলী সিদ্দিকী বলেন, শিক্ষার্থীদের মেধার প্রকৃত অবস্থা জানতেই ‘সহানুভূতি দেখানো’ কিংবা ‘খাতায় অতিরিক্ত নম্বর’ দেওয়া হয়নি। যার প্রভাব পড়েছে ফলে।
অকৃতকার্য ৬ লাখ ৬৬০ শিক্ষার্থী
৯ সাধারণ শিক্ষা বোর্ড এবং মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষা বোর্ড মিলিয়ে ৬ লাখ ৬৬০ শিক্ষার্থী এবার অকৃতকার্য হয়েছে। এর মধ্যে ৩ লাখ ২৪ হাজার ৭১৬ ছাত্র এবং ২ লাখ ৭৫ হাজার ৯৪৪ ছাত্রী।
১৩৪ প্রতিষ্ঠানের কেউ পাস করেনি
এবার ৩ হাজার ৭১৪টি কেন্দ্রে ৩০ হাজার ৮৮টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা পরীক্ষায় অংশ নেয়। এর মধ্যে ১৩৪ প্রতিষ্ঠান থেকে কেউ পাস করেনি। গত বছর শতভাগ ফেল করা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ছিল ৫১। সেই হিসাবে শতভাগ ফেল করা প্রতিষ্ঠান এবার বেড়েছে ৮৩টি।
মেয়েদের জয়জয়কার
এবার মেয়েদের পাসের হার ৭১.০৩ শতাংশ, ছেলেদের ৬৫.৮৮ শতাংশ। সেই হিসাবে এবারও পাসের হারে এগিয়ে ছাত্রীরা। এ বছর সব শিক্ষা বোর্ডে ছাত্রদের চেয়ে ছাত্রীরা ৩.৭৯ শতাংশ বেশি পাস করেছে; ৮ হাজার ২০০ ছাত্রী বেশি জিপিএ ৫ পেয়েছে। এ নিয়ে টানা ১০ বছর এসএসসিতে পাসের হারে এগিয়ে থাকল মেয়েরা। সর্বশেষ ২০১৫ সালে ছাত্রীদের চেয়ে পাসের হারে এগিয়ে ছিল ছাত্ররা।
কেন এই ফল বিপর্যয়?
গত বছর কুমিল্লা বোর্ডের এসএসসিতে পাসের হার ছিল ৭৯ দশমিক ২৩ শতাংশ। এ বছর পাসের হার কমে দাঁড়িয়েছে ৬৩ দশমিক ৬০ শতাংশে। এ ব্যাপারে কুমিল্লা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক শামছুল ইসলাম বলেন, গণিত ও ইংরেজিতে শিক্ষার্থীরা এ বছর ফেল করেছে বেশি। এর মধ্যে গণিতে ২৭ দশমিক ৯৯ এবং ইংরেজিতে ১১ দশমিক ২২ শতাংশ ফেল করায় পাসের হার কমেছে।
চট্টগ্রাম বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ইলিয়াছ উদ্দিন আহাম্মদ বলেন, এ বোর্ডে মানবিক বিভাগের শিক্ষার্থীরা এবার খারাপ ফল করেছে। এ ছাড়া গ্রামের বেশ কিছু স্কুলের ফল ভালো হয়নি। একটি স্কুলে আবার পাসের হার শূন্য। এসবের নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে বোর্ডের সামগ্রিক ফলে।
সিলেট বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন চৌধুরী বলেন, গত বছরের তুলনায় এবার গণিত ও ইংরেজিতে কম নম্বর পেয়েছে শিক্ষার্থীরা। এটা প্রভাব ফেলেছে।
ময়মনসিংহ বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ বলেন, আমরা শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও সংশ্লিষ্ট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধানদের বলেছি শিক্ষার্থীদের প্রতি যত্নশীল হতে।
যশোর বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মোসাম্মাৎ আসমা বেগম বলেন, এবার অন্য কোনো চাপ না থাকায় মেধার সঠিক মূল্যায়ন হয়েছে।
অভিভাবক ফোরামের ক্ষোভ
দেশের স্কুল-কলেজে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীর স্বার্থ রক্ষাকারী অভিভাবকদের সংগঠন অভিভাবক ঐক্য ফোরামের সভাপতি জিয়াউল কবির দুলু এক বিবৃতিতে এসএসসি ও সমমান পরীক্ষার ফল বিপর্যয়ে গভীর উদ্বেগ ও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। ফল বিপর্যয়ের মূল কারণ বের করে শিক্ষার মানোন্নয়নে অন্তর্বর্তী সরকারকে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।