Image description

ডিসেম্বরের বদলে পরবর্তী দুই-এক মাসের মধ্যে নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট দিনক্ষণ ঘোষণা করা হলেও আপত্তি করবে না বিএনপি। বিএনপি মনে করে, অন্তর্বর্তী সরকারের উচিত দ্রুত সময়ের মধ্যে নির্বাচনের বিষয়ে সুস্পষ্ট ঘোষণা দেয়া। নির্বাচনের মাস বা তারিখ সুনির্দিষ্ট হলে বিদ্যমান রাজনৈতিক শঙ্কা যেমন কেটে যাবে, দেশও নির্বাচনের দিকে যাত্রা শুরু করবে। বিএনপি এও মনে করছে গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে তৈরি হওয়া নতুন রাজনৈতিক দল এনসিপি নানা কারণে বর্তমানে আর তেমন গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে নেই। নেতাদের অভিমত, এনসিপিকে ঘিরে যেটুকু সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল, সেটা এখন আর অটুট নেই।

গত মঙ্গলবার ফ্যাসিবাদবিরোধী যুগপৎ আন্দোলনের মিত্র গণতন্ত্র মঞ্চের সাথে রুদ্ধদ্বার বৈঠকে এসব বিষয় উঠে এসেছে বলে জানা গেছে।

আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন আদায়ে ঐকমত্য তৈরিতে গত ১৯ এপ্রিল থেকে ফ্যাসিবাদবিরোধী যুগপৎ আন্দোলনের মিত্র এবং নির্বাচন বর্জনকারী যুগপতের বাইরের দলগুলোর সাথে ধারাবাহিক বৈঠক করছে বিএনপি। এই ইস্যুতে ঐকমত্য তৈরির মাধ্যমে সরকারের ওপর পরোক্ষ ও মনস্তাত্ত্বিক চাপ অব্যাহত রাখবে দলটি। এসবের কিছু বৈঠক আনুষ্ঠানিক, আবার কিছু বৈঠক অনানুষ্ঠানিক হচ্ছে।

জানা গেছে, গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে গণতন্ত্র মঞ্চের সাথে রাত সাড়ে ৭টা থেকে সোয়া ৯টা পর্যন্ত অনুষ্ঠিত বৈঠকটি ছিল রুদ্ধদ্বার। বৈঠকে বিএনপির পক্ষে মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু এবং ভাইস চেয়ারম্যান বরকত উল্লাহ বুলু উপস্থিত ছিলেন। অন্যদিকে গণতন্ত্র মঞ্চের পক্ষে নাগরিক ঐক্যের মাহমুদুর রহমান মান্না, শহীদুল্লাহ কায়সার; বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাইফুল হক, আকবর খান; ভাসানী জনশক্তি পার্টির শেখ রফিকুল ইসলাম বাবলু, আব্দুল কাদের; গণসংহতি আন্দোলনের জোনায়েদ সাকি, আবুল হাসান রুবেল, জেএসডির শহীদ উদ্দিন মাহমুদ স্বপন ও তানিয়া রব উপস্থিত ছিলেন। বিএনপির নেতৃত্বাধীন ফ্যাসিবাদবিরোধী যুগপৎ আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ মিত্র হচ্ছে গণতন্ত্র মঞ্চ। ছয়দলীয় এই জোটের বক্তব্যকে বরাবরই গুরুত্বের সাথে নেয় বিএনপি।

বৈঠক সূত্রে জানা গেছে, গণতন্ত্র মঞ্চের পক্ষ থেকে বৈঠকে চার থেকে পাঁচটি ইস্যু উত্থাপন করা হয়। বিএনপি এগুলোর কোনোটির সাথে একমত হয়েছে, আবার কোনোটির সাথে একমত হয়নি। সার্বিকভাবে গণতন্ত্র মঞ্চের তরফ থেকে আগামী দিনে বিএনপির করণীয় কী, সেটা নিয়ে সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব দেয়া হয়েছে।

সূত্র মতে, বৈঠকে গণতন্ত্র মঞ্চের কয়েকজন নেতা বিএনপির নেতাদের বলেন, সংস্কার নিয়ে আপনারা যথেষ্ট আন্তরিক। গণতন্ত্র মঞ্চসহ যুগপতের শরিকদের সাথে ঐকমত্যে আপনারা ২০২৩ সালের জুলাইয়ে ৩১ দফা সংস্কার প্রস্তাবও দিয়েছেন। বর্তমানে এই ইস্যুতে ব্যাপকভাবে কাজও করছেন। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সাথে তিন দিন বৈঠকও করেছেন। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে নির্বাচনের দাবিটি যেভাবে ব্যাপক পরিসরে সামনে নিয়ে এসেছেন, সংস্কার ইস্যুতে আপনাদের নেতারা বক্তব্য-বিবৃতিতে সেভাবে সোচ্চার নন। অর্থাৎ সংস্কার নিয়ে আপনারা ব্যাকফুটে রয়েছেন। এতে করে মানুষের মধ্যে এক ধরনের ভুল বার্তা যাচ্ছে। তাই নির্বাচনী রোডম্যাপের পাশাপাশি সংস্কারের রোডম্যাপ নিয়েও সোচ্চার হওয়া দরকার। যাতে জনগণ বোঝে, বিএনপি শুধু নির্বাচন নয়, সংস্কারও চায়। বিএনপি গণতন্ত্র মঞ্চের এই প্রস্তাবের সাথে সহমত পোষণ করেছে বলে বৈঠক সূত্র জানিয়েছে।

এ ছাড়া বৈঠকে সংস্কার ইস্যুতে গণতন্ত্র মঞ্চের তরফ থেকে আরো বলা হয়, সংস্কার নিয়ে আপনাদের নেতারা একেক সময় একেক ধরনের বক্তব্য দিচ্ছেন, যা জনমনে বিভ্রান্তি তৈরি করছে। তখন বিএনপি এর উত্তরে বলেছে, দলের মাঠ পর্যায় বা মধ্যম সারির নেতারা যেটা বলছেন, সেটা তো মেসেজ না। দলের শীর্ষ ও দায়িত্বশীল নেতারা যা বলবে, সেটাই মূল মেসেজ। এরপর গণতন্ত্র মঞ্চ পরামর্শ দিয়ে বলে, তারপরও বিষয়টি বিএনপির বিবেচনায় নেয়া উচিত, যাতে করে সংস্কারের বিষয়ে বিএনপির আন্তরিকতা নিয়ে কোনো ধরনের বিভ্রান্তি তৈরি না হয়।

বৈঠকে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের নেতাদের চাঁদাবাজি, দখলবাণিজ্য নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেন মঞ্চের নেতারা। তখন বিএনপি নেতারা বলেন, মিডিয়া এটা নিয়ে অতিরঞ্জিত করছে। প্রত্যুত্তরে গণতন্ত্র মঞ্চ বলে, তাহলে আপনারা এর বিরুদ্ধে পাল্টা বয়ান তৈরি করছেন না কেন? এতে করে তৃণমূলে বিএনপি সম্পর্কে ভুল বার্তা যাচ্ছে। বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে আপনাদের বিবেচনায় নেয়া দরকার।

জানা যায়, বৈঠকে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) বিষয়টিও একপর্যায়ে আলোচনায় আসে। গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে তৈরি হওয়া নতুন এই রাজনৈতিক দলটি নানা কারণে বর্তমানে আর তেমন গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে নেই বলে মনে করছে বিএনপি। নেতাদের অভিমত, এনসিপিকে ঘিরে যেটুকু সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল, সেটা এখন আর নেই। বিএনপির প্রত্যাশা ছিল, স্বৈরাচার পতন আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখা ছাত্র নেতাদের দিয়ে গঠিত এই দলটি রাজনীতিতে নতুন কিছু করবে। কিন্তু রাজনৈতিক দল গঠনের পর গণ-অভ্যুত্থান এবং গত ১৫-১৬ বছর ধরে ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলন-সংগ্রামে থাকা বিএনপিকে নিয়ে তারা যে ধরনের বক্তব্য-বিবৃতি দিয়ে আসছেন, সেটা বিএনপিকে ক্ষুব্ধ করে তুলেছে। সে কারণে প্রথম দিকে এনসিপির সাথে একটা চমৎকার সম্পর্ক তৈরি কিংবা সম্ভাব্য নির্বাচনী জোটে আনার চিন্তা-ভাবনা থাকলেও এখন সেটাতে তেমন গুরুত্ব দিচ্ছে না বিএনপি। একইসাথে এনসিপির কিছু নেতার বিরুদ্ধে দুর্নীতির সাথে জড়িত হওয়াসহ নানান অভিযোগ উঠায়, সে ব্যাপারেও সজাগ রয়েছে বিএনপি। এমন কর্মকাণ্ডে পাবলিক সেন্টিমেন্ট যে এনসিপির বিরুদ্ধে চলে যাচ্ছে, বিএনপির বিবেচনায় রয়েছে সে বিষয়টিও। সব মিলিয়ে নতুন এই দলটির সার্বিক কার্যক্রম পর্যবেক্ষণে রেখেছে বিএনপি।