
পেশাদার মোটরযান চালকদের নতুন ড্রাইভিং লাইসেন্স তৈরিতে ও নবায়ন করাতে মেডিকেল সার্টিফিকেট ( চিকিৎসা সনদ ) বাধ্যতামূলক । কিন্তু অনেকে ভুয়া মেডিকেল সার্টিফিকেট তৈরি করে পেশাদার ড্রাইভিং লাইসেন্সের জন্য আবেদন করছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে । তাঁরা লাইসেন্সও পেয়ে যাচ্ছেন সরকারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ ( বিআরটিএ ) থেকে । সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান আজকের পত্রিকাকে বলেন , “ আমরা এগুলোর ( ব্যাপারে ) ব্যবস্থা নেব । ’ বিআরটিএ সূত্রে জানা গেছে , সড়ক পরিবহন আইনের বিধিমালার আলোকে নির্ধারিত ফরমে পেশাদার চালকের বিভিন্ন বিষয় দেখা হয় । কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই নির্ধারিত ফরম এবং মেডিকেল সার্টিফিকেট ভুয়া বানানো হচ্ছে । সাধারণত বিআরটিএর সার্কেল অফিসের আশপাশে যেসব কম্পিউটার কম্পোজের দোকান রয়েছে , সেগুলোয় এ ধরনের ভুয়া মেডিকেল সার্টিফিকেট তৈরি করে দেওয়া হয় । বিভিন্ন হাসপাতাল এবং ডাক্তারের নাম দিয়ে ফটোশপে এডিট করে মেডিকেল সার্টিফিকেট বানানো হচ্ছে ।
৮ হাসপাতালে হয় মেডিকেল পরীক্ষা পেশাদার ড্রাইভিং লাইসেন্সের মেডিকেল পরীক্ষায় জন্য বিআরটিএ ৮ টি হাসপাতাল নির্ধারণ করে দিয়েছে । তার মধ্যে আছে — কুর্মিটোলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠান ( নিটোর ) , ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল , ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ল্যাবরেটরি মেডিসিন অ্যান্ড রেফারেল সেন্টার , বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতাল ( সাবেক পিজি ) , জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল , মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর এবং কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতাল , রাজারবাগ ।
এসব হাসপাতালের ডাক্তারের থেকে আনা সার্টিফিকেট মেডিকেল সার্টিফিকেট হিসেবে গ্রহণ করা হয় । এর মধ্যে শুধু জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠান মেডিকেল সার্টিফিকেটের কপি অনলাইনে জিমেইলের মাধ্যমে বিআরটিএকে পাঠায় । এই বিষয়ে বিআরটিএ থেকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে চিঠি দেওয়া হয়েছে , মেডিকেল সার্টিফিকেট বিআরটিএকে অফিশিয়ালি মেইলে পাঠানোর জন্য । বিআরটিএর বিভিন্ন সার্কেলের একাধিক কর্মকর্তা বলেছেন , ‘ মেডিকেল সার্টিফিকেটটি ভুয়া কি না , সেটা প্রমাণ করার যথেষ্ট সুযোগ নেই আমাদের কাছে । তবে চোখের দেখায় বোঝা যায় যে সেটা ভুয়া এবং কিছু ক্ষেত্রে আমরা সেগুলো ভেরিফাই করেছি । আমরা এই ধরনের ভুয়া সার্টিফিকেট বাতিলও করতে পারছি না । কারণ, সার্টিফিকেটে ডাক্তার ও হাসপাতালের সিল সবই আছে ; সে ক্ষেত্রে অফিশিয়ালি বাদ দেওয়ার সুযোগ নেই । হাজার হাজার লাইসেন্স ম্যানুয়ালি ক্রস চেক করার সুযোগ কম; কারণ, একটি মাত্র হাসপাতাল সার্টিফিকেট আমাদের কাছে মেইলে পাঠায় , বাকি হাসপাতালগুলো পাঠায় না । ” সরেজমিনে দেখা যায় , মিরপুরসহ বিভিন্ন বিআরটিএ অফিসের পাশে গড়ে ওঠা কম্পিউটার কম্পোজের দোকানগুলোয় দেদার বানানো হচ্ছে মেডিকেল সার্টিফিকেট । টাকার বিনিময়ে হাসপাতাল , ডাক্তারের সিলসহ সই জাল করে বানিয়ে দেওয়া হচ্ছে মেডিকেল সার্টিফিকেট । এই কাজ বেশি করছেন একশ্রেণির দালাল ; যাঁরা ড্রাইভিং লাইসেন্স বানিয়ে দেওয়ার চুক্তি করছেন গ্রাহকদের সঙ্গে ।
মিরপুরে পেশাদার ড্রাইভিং লাইসেন্স নবায়ন করতে এসেছিলেন মো . আলিফ । তাঁর সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের । তিনি বলেন , ‘ লাইসেন্সের কাজে অনেক ভেজাল (জটিল) । অনেকগুলো কাগজপত্র লাগে । এর মধ্যে মেডিকেল সার্টিফিকেট করানো একটা জটিলতা । হাসপাতালে ঘুরতে ঘুরতে দিন শেষ । আমাদের এত সময় নেই । দোকানে মেডিকেল সার্টিফিকেট বানিয়ে দেয় , সেটা দিয়ে কাজ চালিয়ে নিয়েছি । ' জাল মেডিকেল সার্টিফিকেটের কারণে যদি আবেদন বাতিল হয় তখন কী হবে - এ প্রশ্নে আলিফ বলেন,‘ জানি না আবেদনটি বাতিল হবে কিনা । তবে আমার পরিচিত অনেক চালক চালক এইভাবে লাইসেন্স নিয়েছেন । ' জানতে চাইলে _ বিআরটিএর চেয়ারম্যান মো . ইয়াসীন আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘ আমি আসার পরে এই ধরনের অভিযোগ পেয়েছি, ব্যবস্থাও নিয়েছি । আমাদের এডি ( সহকারী পরিচালক ) প্যানেলে যাঁরা আছেন , তাঁদের প্রত্যেককে চিঠি দেওয়া হয়েছে । কারণ, এসব অ্যাটাচমেন্ট অনলাইনে আসে, সেখানে অনেক সময় ভুল দেয় । তাই অ্যাটাচমেন্টগুলো যাচাই করে সত্যতা পেলে তারপরে অনুমোদন দেন । তবে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ সরাসরি রিপোর্টটা আমাদের সার্ভারে আপলোড করে দিলে ভালো হতো । ’
মেডিকেল পরীক্ষায় চালকের যেসব বিষয় দেখা হয় সড়ক পরিবহন আইনের বিধিমালায় পেশাদার ড্রাইভিং লাইসেন্সের মেডিকেল সার্টিফিকেটের মাধ্যমে চালকের যে বিষয়গুলো পরীক্ষা করা হয় , সেগুলো হলো — প্রার্থীর বয়স , দৃষ্টিশক্তির কোনো ত্রুটি আছে কি না , প্রার্থী সহজে লাল ও সবুজ রং চিহ্নিত করতে পারেন কি না , প্রার্থীর রাতকানা এবং বধিরতা রোগ আছে কি না , মোটর যান চালনায় অক্ষম এ রকম অঙ্গহানি প্রার্থী আছে কি না , মদ বা ড্রাগে আসক্তির কোনো লক্ষণ আছে কি না । এ ছাড়া প্রার্থীর শনাক্তকরণ চিহ্ন আছে কি না , তা - ও দেখা হয়ে থাকে । যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক মো. হাদিউজ্জামান আজকের পত্রিকাকে বলেন , ফাঁকফোকরের সুযোগ নিয়ে অদক্ষ , মানসিক এবং শারীরিকভাবে অসুস্থ ব্যক্তি যদি ড্রাইভিং লাইসেন্স পান এবং তিনি যদি সড়কে থাকেন , তাহলে সড়ক যতই মাখনের মতো করা হোক , দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না । দুর্ঘটনার অন্যতম ফ্যাক্টর ( কারণ ) হলো হিউম্যান এরর ( মানুষের ভুল ) । শারীরিকভাবে অসুস্থ এবং মাদকাসক্ত চালক যদি সড়কে থাকেন , অন্য চালক দক্ষ এবং অভিজ্ঞ হলেও সড়কে শৃঙ্খলা ফিরবে না । বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের ( এআরআই ) গবেষণায় দেখা যায় , ২০১০ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে দুর্ঘটনায় জড়িত মাদকাসক্ত চালক ছিলেন ১২-১৪ শতাংশ । এই সংখ্যা ২০২০-২১ সালে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২২ থেকে ২৪ শতাংশ । বর্তমান সময়ে এই সংখ্যা আরও ঊর্ধ্বমুখী বলে জানিয়েছে সংস্থাটি । এটি বাড়ার কারণ হচ্ছে , চালকদের জীবনমানের এখনো কোনো পরিবর্তন হয়নি । সড়ক পরিবহন আইনে যেসব পদক্ষেপের কথা বলা হয়েছে , তার কোনোটি বাস্তবায়িত হয়নি ।
সমাধান মিলতে পারে প্রযুক্তিতে বিআরটিএর কর্মকর্তারা বলছেন , বিআরটিএর সার্ভারে বিএমডিসির রেজিস্টার্ড ডাক্তারদের যুক্ত করতে হবে । ডাক্তাররা যে মেডিকেল সার্টিফিকেট দেবেন , সেটা বিআরটিএ সিস্টেমে চলে আসবে স্বয়ংক্রিয়ভাবে । এতে ভুয়া সার্টিফিকেট ভেরিফাই করা সহজ হবে । যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক মো . হাদিউজ্জামান আজকের পত্রিকাকে বলেন , ‘ টেকনোলজি অনেক এগিয়ে গেছে , কিউআর কোডসংবলিত মেডিকেল সার্টিফিকেট করা উচিত । তাহলে যে কেউ কিউআর কোড স্ক্যান করে বুঝতে পারবেন , সার্টিফিকেটটা আসল নাকি নকল । '