চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে চলমান বাণিজ্যযুদ্ধ ক্রমেই বাড়ছে। তবে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দ্বিতীয় মেয়াদে দায়িত্ব নিতে যাওয়া ডোনাল্ড ট্রাম্প তাঁর আক্রমণের দৃষ্টি এখন যুক্তরাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ মিত্র ও ব্রিকসের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ভারতের দিকে ঘুরিয়েছেন। পরিস্থিতি মোকাবিলায় ভারত বিকল্প পথ খুঁজছে এবং তারই অংশ হিসেবে তারা নীরবে চীনের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নত করার দিকে ঝুঁকছে। এটি কীভাবে একটি বড় ভূরাজনৈতিক পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিতে পারে, তা নিয়ে লিখেছেন দেবাশীষ রায় চৌধুরী
ডোনাল্ড ট্রাম্প হোয়াইট হাউসে ফেরার সপ্তাহ কয়েক আগেই ব্রিকসভুক্ত দেশগুলোকে একটি কড়া সতর্কবার্তা দিয়ে রেখেছেন। তিনি তাঁর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ট্রুথ সোশ্যালে লিখেছেন, ‘পারো তো অন্য কোনো বেকুব খুঁজে নাও (এখানে তিনি বোঝাতে চেয়েছেন, ব্রিকস দেশগুলো যুক্তরাষ্ট্রকে বেকুব পেয়ে তার কাছ থেকে আর্থিক সুবিধা হাতিয়ে নিচ্ছে; কিন্তু এখন থেকে আর তা চলবে না)’।
একই সঙ্গে ট্রাম্প সতর্ক করেছেন, যদি ব্রিকসের ৯টি সদস্যদেশ ডলারের বৈশ্বিক আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ করার চেষ্টা করে, তাহলে তাদের পণ্য আমদানিতে ১০০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হবে।
ট্রাম্পের এই হুমকি তাঁর নির্বাচনী প্রচারণায় দেওয়া প্রতিশ্রুতির অনেক পরে এসেছে। ভোটের প্রচারণার প্রথম দিনেই তিনি কানাডা ও মেক্সিকো থেকে আমদানি হওয়া পণ্যের ওপর ২৫ শতাংশ শুল্ক বসানোর কথা বলেছিলেন।
ট্রাম্পের সুরক্ষাবাদী নীতির প্রধান নিশানা হলো চীন। আর সে পরিপ্রেক্ষিতে চীন ১০ শতাংশ বাড়তি শুল্কের মুখোমুখি হয়েছে। এটি অবাক করার মতো কিছু নয়। কারণ, চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে চলমান বাণিজ্যযুদ্ধ ক্রমেই বাড়ছে। তবে ট্রাম্প তাঁর আক্রমণের দৃষ্টি এখন যুক্তরাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ মিত্র ও ব্রিকসের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ভারতের দিকে ঘুরিয়েছেন।
ডলারের প্রতি সমর্থনের অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করে এখন পর্যন্ত ভারত যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সংঘাত এড়াতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু ট্রাম্পের নীতি ভারতের জন্য এখন একটি বড় কৌশলগত চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠেছে। তাঁর নীতি ভারত সরকারকে নিজের অবস্থান পুনর্বিবেচনা করতে বাধ্য করেছে।
চীন-ভারতের ‘বন্ধুত্ব’
পরিস্থিতি মোকাবিলায় ভারত বিকল্প পথ খুঁজছে এবং তার অংশ হিসেবেই তারা নীরবে চীনের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নত করার দিকে ঝুঁকছে। এটি একটি বড় ভূরাজনৈতিক পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিতে পারে।
সাম্প্রতিক মাসগুলোতে চীন-ভারত উষ্ণ সম্পর্কের লক্ষণ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। ভারত ও চীন কয়েক বছরের সামরিক অচলাবস্থার অবসান ঘটানোর জন্য গত অক্টোবরে একটি চুক্তিতে পৌঁছায়।
এই চুক্তি রাশিয়ার কাজান শহরে অনুষ্ঠিত ব্রিকস সম্মেলনের ফাঁকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের মধ্যে একটি চমকপ্রদ বৈঠকের পথ প্রশস্ত করে। এ ছাড়া চীনা বিনিয়োগ আকর্ষণের ক্ষেত্রে ভারতীয় কর্মকর্তাদের নতুন উদ্যমও বড় পরিবর্তনের আরেকটি ইঙ্গিত।
যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের সম্পর্ক কেন ‘শীতল’
এদিকে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের সম্পর্ক শীতল হতে শুরু করেছে। গত আগস্টে একটি গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হন। এর পর থেকে নরেন্দ্র মোদির পছন্দের ভারতীয় সংবাদমাধ্যম, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কর্মী এবং হিন্দু আধিপত্যবাদী মিত্ররা এই গণবিক্ষোভকে সিআইএর শাসন বদলানোর ‘অপারেশন’ হিসেবে চিত্রিত করেছে। এমনকি তাদের কেউ কেউ সতর্ক করে বলেছে, ‘আমেরিকান ডিপ স্টেট’ ভারতকেও অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করতে পারে।
এর পর থেকে মোদির দল বিজেপি স্পষ্টভাবে মার্কিনবিরোধী অবস্থান নিচ্ছে। তারা অভিযোগ করছে, যুক্তরাষ্ট্র ইচ্ছাকৃতভাবে ভারতের বড় ব্যবসায়ী গৌতম আদানির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছে। মোদির ঘনিষ্ঠ মিত্র আদানি যুক্তরাষ্ট্রে সিকিউরিটিজ জালিয়াতি ও ঘুষের অভিযোগের মুখোমুখি হয়েছেন। বিজেপি এ ঘটনাকে ভারতের সরকারকে দুর্বল করার একটি চেষ্টা হিসেবে দেখছে।
এ ধরনের মনোভাব দীর্ঘদিনের ভারত-যুক্তরাষ্ট্র বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের সম্পূর্ণ বিপরীত এবং এটি শীতল যুদ্ধের সেই সময়ের কথা মনে করিয়ে দেয়, যখন আনুষ্ঠানিক জোটনিরপেক্ষ ভারত সোভিয়েত ইউনিয়নের দিকে ঝুঁকেছিল।
এই পরিবর্তনের পেছনে বেশ কয়েকটি কারণ আছে। এর মধ্যে বৈশ্বিক নেতৃত্ব হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের সামর্থ্য ও ইচ্ছা কমে যাওয়ার পাশাপাশি চীন ও ভারতের নিজেদের কৌশলগত অবস্থান শক্তিশালী করার প্রচেষ্টাকে প্রধান কারণ বলা যেতে পারে।
আসলে বিশ্ব অর্থনীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটে যাওয়ার ফলে যুক্তরাষ্ট্র এখন ভারতের মতো এমন কিছু দেশের কাছে আকর্ষণ হারাচ্ছে, যে দেশগুলো প্রতিরক্ষার জন্য আর আগের মতো ওয়াশিংটনের ওপর নির্ভর করে না।
অন্যদিকে বৈশ্বিক সরবরাহ শৃঙ্খলে চীনের আধিপত্য এখন ফুৎকারে উড়িয়ে দেওয়া অসম্ভব হয়ে পড়েছে। কারণ, দেশটি এখন বিশ্বের বৃহত্তম উৎপাদনশীল শক্তি। চীনের পরের ধাপে থাকা ৯টি বৃহত্তম উৎপাদনকারী দেশের সম্মিলিত উৎপাদনের চেয়েও তাদের উৎপাদন বেশি। ফলে চীন ভারতের নিজস্ব শিল্পভিত্তি সম্প্রসারণে সহায়তা করার ক্ষমতা রাখে।
ভারত সরকারের বার্ষিক অর্থনৈতিক সমীক্ষায় এ বিষয়ের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, ‘ভারতীয় উৎপাদনশীলতা বাড়াতে এবং বৈশ্বিক সরবরাহ শৃঙ্খলে ভারতকে সংযুক্ত করতে’ দেশটিকে অবশ্যই ‘চীনের সরবরাহ শৃঙ্খলে নিজেকে যুক্ত করতে হবে।’
এ লক্ষ্য অর্জনের জন্য প্রতিবেদনে চীনা প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) আকর্ষণের ওপর জোর দিয়ে একটি বাস্তববাদী দৃষ্টিভঙ্গি নেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
চীনের সঙ্গে সরাসরি সহযোগিতার পক্ষে ভারত সরকারের এমন সমর্থন অল্প কিছুদিন আগেও কল্পনা করা কঠিন ছিল।
১৯৬২ সালের ভারত-চীন যুদ্ধের পর থেকে দুই দেশের মধ্যে বৈরী সম্পর্ক চলছে। ২০২০ সালে লাদাখে সংঘর্ষে ২০ জন ভারতীয় সেনা নিহত হওয়ার পর ভারত চীনের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেয়। তারা চীনা বিনিয়োগ ও আমদানিতে কড়াকড়ি আরোপ করে; চীনা অ্যাপ নিষিদ্ধ করে এবং চীনা কর্মকর্তাদের ভিসা সীমিত করে।
তবে এসব সিদ্ধান্ত ভারতের ব্যবসার জন্য বড় ক্ষতি ডেকে এনেছে। চীনা আমদানির ওপর নির্ভরশীল অনেক ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ ছাড়া এফডিআইয়ের প্রবাহ কমতে থাকায় ভারত গুরুত্বপূর্ণ চীনা বিনিয়োগ থেকে বঞ্চিত হয়েছে।
এদিকে বিশ্ব যখন চীনের সরবরাহ শৃঙ্খল থেকে সরে আসছে, চীনা কোম্পানিগুলো তখন তাদের কারখানাগুলো অন্য দেশে সরিয়ে নিচ্ছে। ২০২৩ সালে চীনা বিনিয়োগ ৩ গুণ বেড়ে ১৬০ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে। এ বিনিয়োগের বেশির ভাগই ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া, হাঙ্গেরি ও সার্বিয়ার মতো দেশে গেছে।
চাকরির সংকট ও তরুণদের বেকারত্বের সমস্যায় জর্জরিত ভারত এখন চীনের এ বিনিয়োগের সুযোগ কাজে লাগাতে চাইছে।
একসময় এফডিআইয়ের বড় উৎস ছিল যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু এখন তারা নিজ দেশে কারখানা বাড়ানোর চেষ্টা করছে এবং এর মধ্য দিয়ে তারা ভারতের সঙ্গে বিনিয়োগের প্রতিযোগিতায় নেমেছে।
এ প্রতিযোগিতা ট্রাম্পের নতুন মেয়াদে আরও বাড়বে বলে মনে করা হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের এ প্রতিযোগী মনোভাব ভারতকে চীনা ব্যবসায়ী ও কর্মকর্তাদের দ্রুত ভিসা দিতে এবং চীনা বিনিয়োগ প্রস্তাব অনুমোদনের মতো সুবিধা দিতে বাধ্য করেছে।
ভারতের নতুন নীতি যেভাবে চীনের জন্যও উপকারী
ভারতের এই নতুন নীতি চীনের জন্যও উপকারী। চীনের অর্থনীতি ধীর হওয়ায় তাদের কোম্পানিগুলো ভারতের দ্রুত বাড়তে থাকা বাজারের দিকে নজর দিচ্ছে। ধারণা করা হচ্ছে, চলতি দশকের শেষে ভারত বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি হয়ে উঠবে। ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক বাড়ানো চীনের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের চাপ মোকাবিলায় একটি শক্তিশালী রক্ষাকবচ হতে পারে।
তবে এ ক্ষেত্রে ভারতের জন্যও ঝুঁকি রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের শুল্কযুদ্ধে সবার মনোযোগ থাকলেও ভারত ট্রাম্পের নজরে আছে। ট্রাম্প একাধিকবার ভারতকে ‘শুল্কের বড় অপব্যবহারকারী’ বলেছেন এবং তিনি তাঁর প্রথম মেয়াদে ভারতের বিশেষ বাণিজ্য-সুবিধা বাতিল করেছিলেন। ফলে ট্রাম্পের দিক থেকে ভারতের বিরুদ্ধে আরও কঠোর পদক্ষেপ আসার আশঙ্কা আছে।
এটি নিশ্চিত, যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ‘মেজর ডিফেন্স পার্টনার’ হিসেবে স্বীকৃত ভারত চীনের সঙ্গে সম্পর্ক বাড়ানোর মূল্য হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে থাকা তার কৌশলগত সম্পর্ক নষ্ট করতে চাইবে না। তবে এটিও ঠিক, অন্যান্য উদীয়মান শক্তির মতো ভারতও বিশ্বে মার্কিন নেতৃত্বাধীন উদার আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার প্রতি, বিশেষ করে ডলারের আধিপত্যের প্রতি ক্রমবর্ধমানভাবে হতাশ।
যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে ভারতের সংখ্যালঘুদের প্রতি আচরণের জন্য কখনো কখনো সমালোচনা আসার কারণে এ অশান্তি আরও তীব্র হয়েছে। গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে দুর্বল করে এবং মিডিয়ার ওপর নিয়ন্ত্রণ বাড়িয়ে মোদির সরকার আন্তর্জাতিক সমালোচনার শিকার হচ্ছে। এ সমালোচনায় মোদি প্রচণ্ড বিরক্ত।
মোদির জন্য একটা ভালো ব্যাপার হলো, ট্রাম্প হয়তো ভারত-রাশিয়া সম্পর্ক কিংবা ভারতের মুসলিমবিরোধী নীতি নিয়ে খুব বেশি মাথা ঘামাবেন না; কারণ, তাঁর কাছে এসব বিষয়ের তেমন কোনো গুরুত্ব নেই।
তবে মোদি যদি ভারতকে হিন্দু রাষ্ট্রে পরিণত করার বিষয়ে আরও বেশি উদ্যোগী হন, তাহলে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন নিশ্চিত করতে চাইবেন এবং ট্রাম্পকে তিনি বোঝাতে চাইবেন যে তাঁর হাতে বিকল্প শক্তি আছে।
এই দৃষ্টিকোণ থেকে ভারত চীনের সঙ্গে সম্পর্ক বাড়ানোকে এমন একটি কৌশল হিসেবে দেখতে পারে, যার মধ্য দিয়ে ট্রাম্প কোনো কঠোর সিদ্ধান্ত নিলে যাতে ট্রাম্পকে ভারত বলতে পারে, ‘পারো তো অন্য কোনো বেকুব খুঁজে নাও।’
স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট; অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ
-
দেবাশীষ রায় চৌধুরী টু কিল আ ডেমোক্রেসি: ইন্ডিয়া’স প্যাসেজ টু ডেসপটিজম গ্রন্থের সহলেখক।