Image description

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর পাঁচ মাসের বেশি হলো দায়িত্ব নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। গত আগস্টে দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই পুলিশে আসে ব্যাপক রদবদল।

আন্দোলনকালে ছাত্র-জনতার ওপর নির্বিচার গুলিবর্ষণের অভিযোগে সে সময় আইজিপিসহ বাহিনীটির অনেক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও সদস্য গ্রেপ্তার হয়েছেন। অনেকে দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন। আবার কেউ দেশের ভেতরেই আছেন আত্মগোপনে। আবার শতাধিক কর্মকর্তাকে পাঠানো হয়েছে বাধ্যতামূলক অবসরে।

সংশ্লিষ্টরা দেশ রূপান্তরকে জানান, জুলাই আন্দোলনে ভূমিকার কারণে পুলিশের শীর্ষ কর্তাসহ ৯৫২ জনের বিরুদ্ধে হত্যাসহ একাধিক মামলা আছে। বেশ কয়েকজন কর্তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এত কিছুর পরও পুলিশের বিরুদ্ধে নতুন করে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। বিশেষ করে, মামলাবাণিজ্যে জড়াচ্ছে পুলিশের কর্মকর্তাসহ সদস্যদের নাম। সব মিলিয়ে এখন জনগণের কাঙ্ক্ষিত পুলিশ বাহিনী করতে বড় ধরনের শুদ্ধি অভিযান চালানোর কথা বলছেন দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা। তারা বলছেন, চলতি মাসের যেকোনো সময় বাহিনীতে বড় ধরনের রদবদল করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।
 
পুলিশের একটি সূত্র দেশ রূপান্তরকে জানিয়েছে, আসামি বা যানবাহন ধরার নামে এখনো অর্থ কামাচ্ছেন কিছু দুর্নীতিবাজ পুলিশ কর্মকর্তা থেকে শুরু করে কনস্টেবল। আর এসবের কারণে পুলিশে আরও আসছে বড় ধরনের শুদ্ধি অভিযান। যেসব কর্মকর্তা বা সদস্য দুর্নীতিতে জড়িত আছেন, নতুন করে তাদের তালিকা করা হচ্ছে। তা ছাড়া আইজিপি কমপ্লেইন সেলের অভিযোগগুলো নিষ্পত্তির উদ্যোগ নিয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা দেশ রূপান্তরকে জানান, বাংলাদেশের ইতিহাসে এই প্রথম সহিংসতায় এত মামলা ও আসামির সংখ্যা। ২০১৩ সালে বিএনপি-জামায়াত জোটের আন্দোলনের সময় দুই শতাধিক মামলা হয়েছে। আর আসামি করা হয়েছিল এক লাখের বেশি। কোটা সংস্কার নিয়ে সহিংসতায় দেড় হাজারের বেশি শিক্ষার্থী, নিরীহ লোকজন, বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর নেতাকর্মী মারা গেছেন। তা ছাড়া মারা গেছেন আওয়ামী লীগের কিছু নেতাকর্মীও। বিশেষ করে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময় যারা নিহত হয়েছেন, তাদের স্বজনসহ বাইরের লোকজন মামলা করেছেন। মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের শীর্ষ নেতা, থানা, জেলা, ইউনিয়ন ও ওয়ার্ডপর্যায়ের নেতাকর্মীদের আসামি করা হয়। আবার মামলায় ব্যবসায়ী ও নিরীহ লোকজনকে আসামি করা হচ্ছে। বিষয়টি নিয়ে সমালোচনা আছে। এসব মামলার পেছনে একশ্রেণির প্রতারকচক্র সক্রিয় আছে। তাদের নিয়ে কিছু অসাধু পুলিশ কর্মকর্তা বা সদস্য আসামি ধরা ও মামলাবাণিজ্য করছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। বিষয়টি নিয়ে ইতিমধ্যে পুলিশ সদর দপ্তর বিশেষ নির্দেশনাও দিয়েছে। নির্দেশনা পেয়ে পুলিশ কর্মকর্তারাও নড়েচড়ে বসেছেন।

এ প্রসঙ্গে পুলিশ সদর দপ্তরের এক কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘গণঅভ্যুত্থানে মামলা নিয়ে প্রতারক চক্র সক্রিয় হওয়া গুরুতর অভিযোগ এসেছে। আইনজীবী পরিচয় দিয়ে কেউ কেউ প্রতারক চক্রদের সহযোগিতা করছেন। তা ছাড়া প্রতারকদের সঙ্গে রাজনৈতিক দলের নেতাদেরও সুসম্পর্ক আছে। সুযোগ পেয়ে তারা মিলেমিশে অপকর্ম করেছেন। দুর্নীতিবাজ পুলিশ সদস্যও এসব অপকর্মে জড়িত বলে আমরা নিশ্চিত হয়েছি।’
 
ওই কর্মকর্তা বলেন, পুলিশে নানা ধরনের অনিয়ম ঠেকাতে বড় ধরনের আরও শুদ্ধি অভিযান আসছে। শিক্ষার্থী ও নিরীহ লোকজনের হত্যাকাণ্ডের পর পুলিশকে আরও ঢেলে সাজানোর পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। যেকোনো দুর্নীতি ঠেকাতে জিরো টলারেন্স নীতিতে যাচ্ছে পুলিশ সদর দপ্তর। এ নিয়ে পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নিয়ে কয়েক দফা বিশেষ বৈঠক করেছেন। যেসব পুলিশ কর্মকর্তা বা সদস্য বছরের পর বছর ধরে একই স্থানে চাকরি করে আসছেন, তাদের সরানো হচ্ছে। পাশাপাশি যারা অনিয়ম ও দুর্নীতিবাজের সঙ্গে জড়িত, তাদের তালিকা করা হচ্ছে। চলতি মাসের যেকোনো সময় বড় ধরনের রদবদল করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। ইতিমধ্যে একটি দীর্ঘ তালিকা করা হয়েছে। তার মধ্যে বেশ কয়েকজন ডিআইজি, অতিরিক্ত ডিআইজি, পুলিশ সুপার, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার, ইন্সপেক্টর, এসআই, এএসআই ও কনস্টেবল রয়েছেন।

সূত্র জানায়, রাজনৈতিক পটপরিবর্তন হলেও পুলিশে তেমন একটা পরিবর্তন হয়নি। তারপরও বর্তমান আইজিপিসহ ঊর্ধ্বতনরা পুলিশের নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড লাগাম টানার চেষ্টা চালিয়ে আসছেন। বৈঠকের পাশাপাশি বিভিন্ন ইউনিটপ্রধান, রেঞ্জ ডিআইজি, জেলার এসপিদের কাছে বিশেষ বার্তা পাঠানো হচ্ছে।
 
সম্প্রতি একটি গোয়েন্দা সংস্থার গোপন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে নিয়োগ পাওয়া পুলিশ কর্মকর্তা ও অন্য সদস্যরা ঘাপটি মেরে আছেন। নানা রকম অপরাধ কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছেন তারা। পেশাদার অপরাধীর মতোই মাদক কারবার, চাঁদাবাজি করছেন। যানবাহন থামিয়ে ‘উপরি’ওঠাচ্ছেন। পুলিশের পোশাক পরেই তারা করছেন এসব অপকর্ম। মাঝেমধ্যে ধরাও পড়ছেন দু-চারজন, বাকিরা থাকছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে।

অবশ্য আইজিপি দায়িত্ব নেওয়ার পরই পুলিশ সদস্যদের প্রতি কড়া হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছেন, জনগণের পুলিশ হতে হবে। কোনো দুর্নীতি বা অনিয়মের সঙ্গে জড়িত থাকলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। যারা মাদক কারবারে জড়িত বা কারবারিদের সহায়তা করছেন, তাদের কঠোরভাবে দমন করা হবে। পুলিশকে দুর্নীতি ও মাদকমুক্ত দেখতে চাই। ফোর্সের ডিসিপ্লিনের ব্যাপারে কঠোর হতে হবে। এ ক্ষেত্রে কোনো ধরনের ছাড় বা শৈথিল্য দেখানো যাবে না।
 
পুলিশ সদর দপ্তরের এক কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘পুলিশে কোনো দুর্নীতিবাজদের স্থান নেই। কেউ অনিয়ম বা দুর্নীতি করলে তাকে শাস্তি পেতেই হবে। কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। জনগণের পুলিশ হতে হলে পুলিশকে মাদকমুক্ত হতে হবে। দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত হয়ে কেউ যদি বড়লোক হতে চান, তাহলে তিনি পুলিশের চাকরি ছেড়ে দিয়ে ব্যবসা করুক। তদবির করে নিয়োগ বা বদলি হওয়া যাবে না। নিজস্ব গতিতে সবকিছু চলবে। যেসব পুলিশ সদস্য নানা অনিয়ম বা দুর্নীতিতে জড়িত আছেন, তাদের তালিকা করার কাজ শুরু হয়েছে। বছরের পর বছর ধরে যেসব পুলিশ কর্মকর্তা বা সদস্য একই রেঞ্জ, জেলা বা মেট্রো এলাকায় আছেন, তাদের সরিয়ে অন্যত্রে বদলি করা হবে। বিশেষ করে থানার ওসিদের ব্যাপারে আমরা কঠোর অবস্থানে আছি। কিছু পুলিশ কর্মকর্তার দুর্নীতি, অনিয়ম এবং অপকর্মের কারণে পুলিশের ভাবমূর্তি সংকটের মধ্যে পড়েছে। পুলিশের আইনে আছে যে কেউ দুই বছরের বেশি একই স্থানে থাকতে পারেন না। কিন্তু অনেকেই নানা তদবির করে পাঁচ থেকে সাত বছরের অধিকও থেকে যাচ্ছেন। আবার দেখা যায়, বদলির অর্ডার এলে রাজনৈতিক নেতা বা অন্য কাউকে দিয়ে তদবির করে বদলির অর্ডার বাতিল করে দেন। কিন্তু এবার আইজিপি স্যার কঠোর অবস্থানে আছেন। তিনি বলে দিয়েছেন, যে তদবির করতে আসবেন, তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

পুলিশ জানায়, পটপরিবর্তনের পরও আইজিপি কমপ্লেইন সেলে পুলিশের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ আসছে। তা ছাড়া পাঁচ বছরে অন্তত এক লাখ পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ এলেও নেওয়া হয়নি কোনো ব্যবস্থা। বর্তমানে সব অভিযোগ আমলে নিয়ে নিষ্পত্তির সিদ্ধান্ত নিয়েছে পুলিশ সদর দপ্তর। তা ছাড়া যেসব পুলিশ কর্মকর্তা বা সদস্য দুর্নীতিতে জড়িত আছেন, তাদের বিষয়ে দুদক সহযোগিতা চাইলে, তাদের সব ধরনের সহায়তাও করবে বলে জানা গেছে। পুলিশের আইনে বলা আছে, কোনো পুলিশ সদস্য অপরাধমূলক কাজে জড়ালে তার বিরুদ্ধে দুই ধরনের বিভাগীয় শাস্তির (লঘু ও গুরু) বিধান আছে। গুরুদণ্ডের আওতায় চাকরি থেকে বরখাস্ত, পদাবনতি, পদোন্নতি স্থগিত, বেতন বৃদ্ধি স্থগিত ও চাকরিকালীন সুযোগ-সুবিধা রহিত করা হয়। অপরাধ প্রমাণ হলে বরখাস্ত করা হয়। গুরুদণ্ডের বিরুদ্ধে আপিলের সুযোগ আছে। ছোট অনিয়ম বা অপরাধের জন্য দায়িত্ব থেকে প্রত্যাহার, অপারেশনাল ইউনিট থেকে পুলিশ লাইনস বা রেঞ্জে সংযুক্ত করে লঘুদণ্ড দেওয়া হয়। বিসিএস ক্যাডারের পুলিশ কর্মকর্তাদের ক্ষেত্রে সরকারি চাকরি আইন-২০১৮ (শৃঙ্খলা ও আপিল) অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হয়। সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) থেকে তদূর্ধ্ব কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ খতিয়ে দেখতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগে একটি সেল রয়েছে। অভিযোগ আসার পরপরই তদন্ত শুরু হয়।
 
কয়েকজন পুলিশ সুপার দেশ রূপান্তরকে বলেছেন, ‘মাসখানেক আগে পুলিশ সদর দপ্তর থেকে একটি নির্দেশনা আসে দুর্নীতিবাজ পুলিশ সদস্যদের অপরাধ ঠেকাতে জেলায় বিশেষ টিম গঠন করতে। আমরা সেই প্রক্রিয়া শুরু করেছি। ওই টিমের কাজ হবে শুধু অপরাধের সঙ্গে সম্পৃক্ত পুলিশ সদস্যদের কর্মকাণ্ড নজরদারি করে আইনের আওতায় আনা।’