
বাংলাদেশে দিন দিন এক অস্বাস্থ্যকর সংস্কৃতি গভীরভাবে শেকড় গেড়ে বসছে—সবাই রাজনীতিবিদ হতে চায়, আর রাজনীতিই যেন জীবনের একমাত্র ‘ক্যারিয়ার অপশন’। স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী, শিক্ষক, পেশাজীবী, আমলা, শ্রমজীবী, এমনকি বস্তিবাসীও কেউ বাদ যাচ্ছে না এই প্রবণতা থেকে। রাস্তার মোড়ের চায়ের দোকান থেকে শুরু করে ফেসবুক লাইভ বা টিকটক ভিডিও—রাজনীতিই মূল বিষয়। এই ধারাবাহিকতাই আমাদের সামনে এক ভয়াবহ প্রশ্ন তুলে ধরছে : যদি সবাই রাজনীতিবিদ হতে চায়, তাহলে দেশটা চলবে কীভাবে?
একটি দেশের অগ্রগতির জন্য দরকার পেশাগত বৈচিত্র্য, দক্ষতার উন্নয়ন এবং সৃজনশীলতার বিকাশ। উন্নত রাষ্ট্রগুলোতে একজন চিকিৎসক, বিজ্ঞানী, প্রকৌশলী, আইটি বিশেষজ্ঞ কিংবা গবেষকের মতো পেশাজীবীর সম্মান এবং গুরুত্ব রাজনীতিবিদের চেয়ে কম নয়। অথচ আমাদের এখানে রাজনীতি যেন একমাত্র পথ হয়ে উঠেছে জীবনে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার। এই বিপজ্জনক মনোভাব তরুণ সমাজকে তার প্রকৃত লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত করছে। একজন শিক্ষার্থী, যার সময়টা হওয়া উচিত শেখা, অনুশীলন ও দক্ষতা অর্জনের, সেই সময়টা সে ব্যয় করছে মিছিল-মিটিং ও রাজনৈতিক প্রচারণায়।
আরও দুঃখজনক হলো, এই রাজনীতির পেছনে দৌড় এক আদর্শগত চর্চা নয় বরং ক্ষমতার আশ্রয়ে সুযোগ খোঁজার একটা কৌশল হয়ে উঠেছে। কেউ ছবি তুলে ফেসবুকে পোস্ট করছে নেতার পাশে দাঁড়িয়ে, কেউ বড় ভাইয়ের সুনজরে থাকার জন্য রাত জেগে পোস্টার মারছে। পক্ষান্তরে, প্রকৃত জ্ঞান অর্জন, গবেষণা, চিন্তা-ভাবনা ও আত্মবিকাশের কাজগুলো থেকে তরুণরা ক্রমাগত বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে।
আমার নিজের দীর্ঘদিনের জাপান অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, আধুনিক উন্নত জাতিগুলো কীভাবে নিজেদের শিক্ষাব্যবস্থা ও সমাজ কাঠামোকে রাজনীতির বাইরে রেখে গড়ে তুলেছে। সেখানে জাতীয় নির্বাচন হলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী বুঝতেই পারে না কোনো নির্বাচন চলছে। তারা সকাল ৮টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত গবেষণা, ল্যাব ও লাইব্রেরিতে সময় দেয়। স্নাতক, মাস্টার্স, বা পিএইচডি পর্যায়ে প্রতিটি শিক্ষার্থী যেন একেকটি স্বয়ংসম্পূর্ণ গবেষণা-ইউনিট। সেইজন্যই জাপান স্বাস্থ্য, প্রযুক্তি, কৃষি, পরিবেশ কিংবা মানবসম্পদ—সবক্ষেত্রেই অভাবনীয় অগ্রগতি অর্জন করেছে।
অন্যদিকে আমাদের এখানে শিক্ষার্থীরা প্রয়োজনীয় ক্লাসেও উপস্থিত থাকতে পারছে না। বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠনের দখলদারিত্বে শিক্ষার্থীদের জিম্মি করে রাখা হচ্ছে। একবার কেউ জায়গা পেলে তাকে বাধ্য করা হচ্ছে মিটিং-মিছিলে অংশ নিতে। রাজনৈতিক কর্মসূচি চালাতে গিয়ে শিক্ষাকে অগ্রাধিকারহীন করে ফেলা হচ্ছে। শুধু ছাত্ররাই নয়, বস্তিবাসী, রিকশাচালক, দিনমজুর—তাদেরও কয়েকশ টাকা দিয়ে ট্রাকে তুলে এনে সমাবেশে বিপুল জনসমাগম ঘটিয়ে জনপ্রিয়তার শোডাউন করা হচ্ছে। এটি শুধু জনসচেতনতার অবক্ষয় নয়, বরং সামগ্রিক জাতিসত্তার এক ধ্বংসাত্মক সংকেত।
রাজনীতিকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা এই ‘পাওয়ার কালচার’-এর ফলাফল আরও ভয়াবহ। ছাত্ররাজনীতি এখন আর আদর্শ বা নেতৃত্ব তৈরির প্ল্যাটফর্ম নয়, বরং চাঁদাবাজি, দখলদারিত্ব ও টেন্ডার বাণিজ্যের আঁতুড়ঘর। যার ফলে রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়া হাজারো তরুণ এক সময় হতাশা, দারিদ্র্য এবং সামাজিক বিচ্ছিন্নতায় নিপতিত হয়। তবুও এই ক্ষতিকর মোহ থেকে তরুণদের ফিরিয়ে আনা যাচ্ছে না।
এদিকে এই একচোখা রাজনীতিকেন্দ্রিক সমাজে আমরা তৈরি করছি না পর্যাপ্ত সংখ্যক দক্ষ ডাক্তার, প্রকৌশলী, আইটি এক্সপার্ট, বিজ্ঞানী, লেখক, সমাজকর্মী কিংবা নীতিনির্ধারক। পরিণতিতে, ভবিষ্যতে প্রয়োজনীয় পেশাজীবীদের আমদানি করতে হতে পারে—যেটি একটি জাতির জন্য চরম লজ্জা ও আত্মঘাতী ব্যর্থতা। শিক্ষাব্যবস্থার প্রতি জাতির দৃষ্টিভঙ্গি আজ এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, কেউ যদি পড়াশোনায় ভালো করে, তাহলে অভিভাবক বা শিক্ষক তাকে সাবধান করে দেন : ‘রাজনীতিতে জড়াস না।’ অথচ শিক্ষাজীবনে রাজনীতি হওয়া উচিত ছিল চিন্তা ও নেতৃত্ব বিকাশের ক্ষেত্র, নৈতিকতা ও সমাজকল্যাণের অনুশীলন। আজ তা হয়ে উঠেছে বিশৃঙ্খলা, হানাহানি আর ক্ষমতার মঞ্চ।
এই পরিস্থিতি রাজনীতিবিদদের জন্যও নিরাপদ নয়। যখন পুরো সমাজ রাজনীতিতে ডুবে যায়, তখন দলের ভেতরেই শুরু হয় বিভক্তি, নেতৃত্বের জন্য হিংসা, মারামারি এবং নৈতিক পতন। রাজনীতির এই কলুষতা ভবিষ্যতে নিজেদের জন্যই গর্ত খুঁড়ে দেবে।
এখন করণীয় কী?
প্রথমত, আমাদের শিক্ষা ও সমাজ কাঠামোয় ভারসাম্য ফিরিয়ে আনতে হবে। রাজনীতি থাকবে, তবে তা হবে গঠনমূলক, নীতিনিষ্ঠ এবং গণমুখী। একে ‘পাওয়ার প্রজেক্ট’ না বানিয়ে সমাজসেবার বাহন হিসেবে ব্যবহার করতে হবে।
দ্বিতীয়ত, তরুণদের আগ্রহ তৈরি করতে হবে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, সাহিত্য, চিকিৎসা, উদ্যোক্তা কর্মকাণ্ড এবং গবেষণার প্রতি। প্রত্যেককে বোঝাতে হবে—দেশ গঠনে রাজনীতি একটি পথ হতে পারে, তবে সেটিই একমাত্র পথ নয়।
তৃতীয়ত, নীতিনির্ধারকদের উচিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপমুক্ত রাখা এবং গবেষণাভিত্তিক জ্ঞান চর্চার পরিবেশ তৈরি করা। দেশের উন্নয়ন কেবল তখনই সম্ভব, যখন আমরা সকল পেশা ও দক্ষতার প্রতি সম্মান দেখাই এবং প্রতিটি ক্ষেত্রের মেধাবীদের উৎসাহ দেই। একজন প্রকৃত নেতা প্রয়োজন, কিন্তু তার চেয়ে বেশি প্রয়োজন ১০০ জন দক্ষ চিকিৎসক, গবেষক, শিক্ষক ও প্রযুক্তিবিদ।
যদি সবাই রাজনীতিবিদ হতে চায়, তবে দেশ চলবে না—দলের ছায়া থাকবে, কিন্তু বাস্তব উন্নয়ন থাকবে অনুপস্থিত। এখনই সময় আত্মসমালোচনা করে দেশ ও জাতির ভবিষ্যতের জন্য সঠিক পথ বেছে নেওয়ার।
লেখক প্রফেসর ড. মো. আবদুল জলিল শিক্ষাবিদ, লেখক ও গবেষক ডিন, ফাকাল্টি অফ সায়েন্স এবং ফ্যাকাল্টি অফ টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং বিজিএমইএ ইউনিভারসিটি অফ ফ্যাশন অ্যান্ড টেকনোলজি, ঢাকা