Image description

রাজস্ব আদায়ে ধস নেমেছে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনে। গত বছরের তুলনায় এবার লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) ও ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) রাজস্ব আদায়ে চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে। রাজস্ব আয় এমন কমে যাওয়ার কারণ হিসেবে সরকারের পটপরিবর্তন এবং পরবর্তী সময়ের রাজনৈতিক অস্থিরতাকে দায়ী করলেও সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রশাসনিক দুর্বলতা এবং জনসম্পৃক্ততার অভাব স্পষ্ট।

জানা গেছে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরের নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার অর্ধেকও আদায় করতে পারেনি ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন। সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তাদের মতে, রাজস্ব আদায়ের জন্য প্রশাসনিক সংস্কার জরুরি। একইসঙ্গে করদাতাদের বিভিন্ন মাধ্যমে উৎসাহ প্রদান করার গুরুত্বারোপ করেন অনেকে। না হলে পরবর্তী বছরগুলোতেও রাজস্ব আদায় কঠিন হয়ে পড়বে। এতে করপোরেশন দুটি নাগরিকদের সঠিক সেবা দিতে ব্যর্থ হবে।

সিটি করপোরেশন সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১ হাজার ৬৪৭ কোটি টাকা। গত ৩১ মে পর্যন্ত আদায় করতে পেরেছে ৮০৬ কোটি টাকা। অর্থাৎ লক্ষ্যমাত্রার অর্ধেকও আদায় করতে পারেনি উত্তর সিটি করপোরেশন।

অন্যদিকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১ হাজার ৩৩৮ কোটি টাকা। গত মে মাস পর্যন্ত রাজস্ব আদায় করতে পেরেছে ৭০৮ কোটি টাকা। এতে ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৬৩০ কোটি টাকা।

দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, মেয়র পদে বসতে বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেনের টানা ৪৩ দিনের আন্দোলনের কারণে করপোরেশনের কার্যক্রমে স্থবিরতা দেখা দেয়। এতে রাজস্ব বিভাগের স্বাভাবিক কার্যক্রম মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়েছে। ফলে নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার বড় একটি অংশ আদায় করা সম্ভব হয়নি। বিশেষ করে ট্রেড লাইসেন্স, হোল্ডিং ট্যাক্স এবং খাজনা আদায়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ খাতে চরম ভাটা পড়ে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ডিএসসিসির ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, সিটি করপোরেশনের ক্ষেত্রে ‘মে ও জুন’ মাসকে রাজস্ব আদায়ের গুরুত্বপূর্ণ সময় ধরা হয়। তবে রাজস্ব আদায়ের গুরুত্বপূর্ণ মাস মে-তে লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে ব্যর্থ হয় ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। এর মূল কারণ সবার জানা। এই ব্যর্থতার দায়ভার সরকারকেও নিতে হবে।

লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী রাজস্ব আদায় না হওয়ার বিষয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. জহিরুল ইসলাম বলেন, ২০২৪ সালে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের কারণে জুলাই ও আগস্ট পরবর্তী সময়ে, অর্থাৎ দুই মাসেরও বেশি সময় সিটি করপোরেশন রাজস্ব আদায় করতে পারিনি। তারপর মে-জুন মাসের একটি আন্দোলনের (ইশরাক হোসেনকে মেয়র পদে বসানোর দাবিতে আন্দোলন কর্মসূচি) কারণে আমাদের লক্ষ্যমাত্রার রাজস্ব আদায় করা যায়নি। তারপরও আমরা চেষ্টা করেছি। হয়তো নির্ধারিত লক্ষ্যে পৌঁছানো যায়নি, তবে রাজস্ব আদায় করা গেছে।

জানা গেছে, দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) রাজস্ব আদায় কার্যক্রম শতভাগ অনলাইনে করার চেষ্টা চলছে, যাতে করে করদাতারা সহজে সেবা পেতে পারেন। অনলাইনে কর দেওয়ার বিষয়ে দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী আরও বলেন, করদাতাদের ভোগান্তি কমাতেই অনলাইনে পুরোপুরি রাজস্ব আদায়ের চেষ্টা করছে ডিএসসিসি।

গত ২০১৯-২০ অর্থবছর থেকে ২০২০-২১, ২০২১-২২ ও ২০২২-২৩ অর্থবছরে ঢাকা দক্ষিণ সিটি যথাক্রমে ৫১৩ কোটি ৯৬ লাখ, ৭০৩ কোটি ৩১ লাখ, ৮৭৯ কোটি ৬৬ লাখ ও ১০৩১ কোটি ৯৭ লাখ টাকা রাজস্ব আদায় করেছিল। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে দক্ষিণ সিটি করপোরেশন ১ হাজার ৬১ কোটি ৫৬ লাখ টাকা রাজস্ব আদায়ের মাধ্যমে রেকর্ড সৃষ্টি করলেও ২০২৪-২৫ অর্থবছরে রাজস্ব আদায় অনেকটা কমেছে।

অন্যদিকে বিগত ২০১৯-২০, ২০২০-২১, ২০২১-২২ ও ২০২২-২৩ অর্থবছরে যথাক্রমে ডিএনসিসির রাজস্ব আদায় ছিল ৬১২ কোটি, ৬৯২ কোটি, ৭৯৪ কোটি ও ১০৫৮ কোটি টাকা। আর ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ১ হাজার ৭৮ কোটি টাকা রেকর্ড রাজস্ব আদায় করেছে ডিএনসিসি।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে ৫২টি খাত থেকে রাজস্ব আদায় হয় বলে জানিয়েছেন কর্মকর্তারা। বিদায়ী অর্থবছরে দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের হোল্ডিং ট্যাক্স আদায়ের টার্গেট ছিল ৫৬০ কোটি টাকা। কিন্তু গত মে মাস পর্যন্ত দক্ষিণ সিটি ৩০৮ কোটি টাকা রাজস্ব আদায় করতে পেরেছে। এই খাতে সংস্থাটির ঘাটতি ২৫২ কোটি টাকা। বাজার সালামি আদায়ের লক্ষ্য ছিল ১০০ কোটি, আদায় হয়েছে সাড়ে ৩৪ কোটি টাকা।

অন্যদিকে বাজার ভাড়া আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৪০ কোটি টাকা, আদায় হয়েছে ২৬ কোটি টাকা। গুরুত্বপূর্ণ খাত ট্রেড লাইসেন্স ফি ১৫০ কোটির মধ্যে আদায় হয়েছে ৯৩ কোটি ৮৩ লাখ। বিজ্ঞাপন খাতে ১২ কোটি লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে আদায় হয়েছে প্রায় ৬ কোটি টাকা। স্থাবর সম্পত্তি হস্তান্তর করের ১৫০ কোটি টাকা টার্গেট থাকলেও আদায় করা হয়েছে ৮১ কোটি টাকা। বাস/ট্রাক টার্মিনাল ফি ২০ কোটির মধ্যে আদায় হয়েছে ৬ কোটি ৮০ লাখ। বাকি খাতগুলোতেও লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী রাজস্ব আদায় হয়নি।

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের রাজস্বের বড় অংশ আসে কর (হোল্ডিং, পরিচ্ছন্নতা, লাইটিং, স্বাস্থ্য) খাত থেকে। আলোচ্য সময়ে এই খাতে উত্তর সিটির রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৭৫০ কোটি টাকা। সংস্থাটি আদায় করতে পেরেছে ৪৯২ কোটি ৫১ লাখ টাকা। পাঁচটি খাতে সংস্থাটির রাজস্ব আদায় হয়নি। খাতগুলো হচ্ছে বাজার সালামি, রিকশার লাইসেন্স ফি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বা ট্রেনিং সেন্টার ফি, মেলা এবং বাণিজ্যিক প্রদর্শনীর ওপর ফি ও টিউটোরিয়াল স্কুল বা কোচিং সেন্টার ফি। বাকিগুলোতেও লক্ষ্যমাত্রার রাজস্ব আদায়ে ব্যর্থ হয়েছে এই সিটি করপোরেশন। এর মধ্যে বাজার ভাড়া আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৬ কোটি, আদায় করতে পেরেছে ৩ কোটি টাকা।

ট্রেড লাইসেন্স ১৩০ কোটি টাকার মধ্যে আদায় হয়েছে ৮৩ কোটি টাকা। প্রমোদ কর ১ কোটি ৫০ লাখের মধ্যে আদায় করতে পেরেছে সাড়ে ৬৭ লাখ। সম্পত্তি হস্তান্তর করের ৪৬০ কোটি টাকার মধ্যে আদায় করা গেছে ১৯০ কোটি ৫০ লাখের কিছু বেশি। করপোরেশন এলাকায় অবস্থিত তারকাখচিত হোটেল এবং সার্ভিস অ্যাপার্টমেন্টে অবস্থানকারীর ওপর নগর কর ৩০ কোটির মধ্যে আদায় করেছে প্রায় ৪ কোটি ৪৩ লাখ টাকা। বিজ্ঞাপনে ৭ কোটি টাকা আদায় করতে পেরেছে, যদিও লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১৬ কোটি ৩৬ লাখের কিছু বেশি টাকা।

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, জুলাই আন্দোলনের পরবর্তী সময়টাতে রাজস্ব আদায় তেমন হয়নি। তাই গত বছরের যে লক্ষ্যমাত্রা তা পূরণ হয়নি। আমরা করদাতাদের কর দিতে নানাভাবে উৎসাহিত করছি। কর দেওয়ার সিস্টেম কিন্তু অনলাইনে পুরোপুরি আমি এসে করেছি। তবু অনেকে কর দিতে অনাগ্রহী। কর দেয়ার নানান উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কিছু দিন আগে তো উত্তর সিটি করপোরেশনের উদ্যোগে মেলাও করা হয়েছে।

করদাতাদের কীভাবে নিয়মিত কর দেওয়ায় উৎসাহিত করা যায় বা সিটি করপোরেশন কী উদ্যোগ নিয়েছে এ বিষয়ে ডিএনসিসির প্রশাসক বলেন, সময়মতো করদাতারা কর না দিলে জরিমানা দেবে। জরিমানার ভয়ে হলেও কর দেবে। এবার রাজস্ব আদায়ে আমাদের লক্ষ্যমাত্রা গত বছরের তুলনায় দ্বিগুণ।