
লক্কড়-ঝক্কড় বাসেই চলছে রাজধানীর যাত্রী পরিবহন। অধিকাংশ বাসের রং উঠে গেছে, নেই লুকিং গ্লাস, দরজা-জানালা, সিট ভাঙা, বৃষ্টি এলে ছাদ দিয়ে পানি পড়ে। রাজধানীর রাজপথে যানজটের অন্যতম নিয়ামক এসব মেয়াদোত্তীর্ণ লক্কড়-ঝক্কড় বাস। এক নজর দেখলেই বাংলাদেশের দারিদ্র্যতা করুণ চিত্র ফুটে ওঠে। বেদেশি একজন পর্যবেক্ষক বিমানবন্দরে নেমে বাসগুলো দেখে সহজেই অনুমান করতে পারেন বাংলাদেশের দুরবস্থা।
অথচ অর্থনৈতিক দিক থেকে বাংলাদেশ ততটা অনুন্নত বা দরিদ্র নয়, যতটা রাজপথের বাসের বেহাল দশায় অনুমান করা যায়। এমতাবস্থায় বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার যখন বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আকর্ষণ করতে নানান উদ্যোগ নিচ্ছে, তখন এসব বাসের দুরবস্থা দেখেই বিনিয়োগকারীদের মুখ ফিরিয়ে নেয়ার আশঙ্কা করছেন ব্যবসায়ী নেতারা। তাতে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ থেকে বঞ্চিত হবে বাংলাদেশ। মেয়াদোত্তীর্ণ এসব বাস থেকে শুধু রাজধানীর সৌন্দর্য বিনষ্ট করছে বা আমাদেরকে দারিদ্র্যসীমার নিচে নামাচ্ছে তা নয়, যাত্রীরা যেমন টাকা দিয়ে সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, তেমনি এগুলো থেকে নির্গত কালো ধোঁয়া, শব্দদূষণ মানবদেহের ক্ষতি করছে। বাড়াচ্ছে স্বাস্থ্যঝুঁকি।
যাত্রীরা বলছেন, কোনো সভ্য দেশের রাজধানী শহরে কোনোভাবেই চলতে পারে না এসব বাস। দ্রুত রঙচটা, ভাঙাচোরা বাসের ব্যাপারে দ্রুত উদ্যোগ চান বিশেষজ্ঞরা। অথচ মালিক-শ্রমিক সমন্বয় পরিষদ দাবি করছে, বাস ও ট্রাকের আয়ুষ্কাল বাড়াতে হবে। অর্থাৎ বাসের আয়ুষ্কাল ২০ বছর থেকে ২৫ এবং ট্রাকের আয়ুষ্কাল ২৫ থেকে বাড়িয়ে ৩০ বছর করতে হবে। আগামী ১৫ দিনের মধ্যে এ দাবি না মানলে তারা ৭২ ঘণ্টা পরিবহন ধর্মঘটের আল্টিমেটামও দিয়েছেন।
সমন্বয় পরিষদের দাবি, মেরামত করে অধিকাংশ পুরাতন পরিবহন যানের ফিটনেস ফিরিয়ে আনা সম্ভব। অথচ বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক ড. মো. হাদিউজ্জামান মনে করেন, সহসাই আয়ুষ্কাল পেরিয়ে যাওয়া বাসকে ফিটনেসে ফেরানো সম্ভব নয়। তিনি বলেন, আমরা প্রায় সময় ফিটনেস নিয়ে অনেক কথা বললেও প্রকৃতপক্ষে এসব বাসের ফিটনেস নেই। ২০ বছরের পুরোনো এত সংখ্যক বাসকে ফিটনেসের আওতায় আনতে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করতে হবে। ইঞ্জিন ওভাররোলিং ছাড়াও কাঠামোগত যেসব পরিবর্তন আনতে হবে এতে আয়ের তুলনায় ব্যয় অনেক বেশি দাঁড়াবে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, বিগত আওয়ামী লীগ সরকার সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে কোনো কাজ করেনি। তার কারণ পুরোপুরি রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক। কর্তৃত্ববাদী শাসনের সাধে যে স্বজনতোষী অর্থনীতি তারা গড়ে তুলেছিল, তার প্রধান একটি জায়গা ছিল যোগাযোগ অবকাঠামো খাত। বাজেটে এ খাতেই সবচেয়ে বেশি ব্যয় হয়েছে, একের পর এক মেগা প্রকল্প হয়েছে। তাতে ক্ষমতার একেবারে প্রথম বৃত্তে থাকা লোকদের সম্পদ বেড়েছে আলাদিনের চেরাগের মতো। সেই সম্পদের একটি বড় অংশই পাচার হয়ে গেছে। এ বাস্তবতার বিপরীতে চরম দুর্নীতি-নির্ভর পরিবহন খাত বর্গা দেয়া হয়েছে দলীয় মাফিয়া ও মাস্তানদের হাতে।
বলা চলে, সবচেয়ে বেশি রাজনৈতিক দুর্বৃত্তকে পুনর্বাসন করা হয়েছিল এ খাতেই। এ কারণে সড়কে নৈরাজ্য আর অরাজকতার যে বিষচক্র তৈরি হয়েছে, তার নিষ্ঠুর বলি হতে হয়েছে নাগরিকদের। ফলে সবাই আশা করেছিলেন, গণ-অভ্যুত্থানের পর সড়কে শৃঙ্খলা ফিরবে। ঢাকার মানুষেরা একটি সুশৃঙ্খল বাস ব্যবস্থা পাবে। অভ্যুত্থানের পর প্রথম কয়েক দিন যখন পুলিশ ছিল না, তখন ছাত্ররাই ঢাকার সড়কগুলোতে শৃঙ্খলার নজির তৈরি করেছিলেন। বাসসহ অন্য যানবাহগুলো লেন মেনে চলাচল করতে শুরু করেছিল। সবার মধ্যেই আইন মানার একটি আকাক্সক্ষাও তৈরি হয়েছিল।
বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর রাজধানীর আত্মপরিচয় খাটো করে রাখা মেয়াদোত্তীর্ণ ও লক্কড়-ঝক্কড় সব বাস ছয় মাসের মধ্যেই সড়ক থেকে সরানোর বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়েছিল আন্তঃমন্ত্রণালয়ের বৈঠকে। সে সময় বিআরটিএর চেয়ারম্যান বলেছিলেন, সারা দেশে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) ফিটনেসবিহীন মোট ১৪ হাজার মেয়াদোত্তীর্ণ বাস ও ট্রাক রয়েছে।
চলতি বছরের মে মাস থেকে এসব যান সড়কে আর চলতে দেয়া হবে না। রাজধানীর মিরপুরে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) বিভাগীয় কার্যালয়ের ভিআইসি সেন্টারের সভাকক্ষে এক মতবিনিময় সভায় এ তথ্য জানানো হয়। তার মানে, তখন থেকে লক্কড়-ঝক্কড় বাস-ট্রাক সরাতে আরো পাঁচ মাস সময় নিয়েছিল বিআরটিএ। সে হিসেবে মে মাস থেকে অভিযান শুরু হওয়ার কথা থাকলেও ঈদ ও শিক্ষাবোর্ডের পরীক্ষার অজুহাতে অভিযানের তারিখ পেছানো হয়। চলতি মাসের মাঝামাঝি সময় থেকে স্বল্প পরিসরে অভিযান শুরু হলে বেঁকে বসেন মালিক-শ্রমিকরা। ঢাকার বাইরে বিচ্ছিন্নভাবে অভিযানের বিরোধিতা করে পরিবহন ধর্মঘটও পালিত হয়। সেটিকেই রেফারেন্স হিসেবে মালিক-শ্রমিকরা এসব বাসের আয়ুষ্কাল বাড়ানোর দাবি করে ধর্মঘটের আল্টিমেটাম দিয়েছে।
জানা গেছে, মানসম্পন্ন বাসে যাত্রীসেবা নিশ্চিতে সড়ক পরিবহন আইন, ২০১৮ সালে বাস-মিনিবাসের ইকোনমিক লাইফ বা অর্থনৈতিক আয়ুষ্কাল নির্ধারণের কথা বলা হয়। এটি কার্যকরে আওয়ামী লীগ আমলেই বাসের আয়ু ২০ বছর বেঁধে দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছিল। তবে সপ্তাহ না ঘুরতেই অজানা কারণে সেই প্রজ্ঞাপন বাতিল করা হয়।
বিআরটিএ সূত্র জানায়, দেশে পুরোনো লক্কড়-ঝক্কড় যানবাহনের সংখ্যা ৮০ হাজার ৩০৯। রাজধানীর ২৯০টির বেশি রুটে চলা প্রায় ছয় হাজার বাসের বেশির ভাগই রঙচটা। অনেক বাসের মেয়াদ শেষ হলেও বন্ধ হয়নি যাত্রী পরিবহন।
জানা গেছে, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার বিশ্বব্যাংকের প্রকল্পের আওতায় ঢাকায় বৈদ্যুতিক বাস সেবা চালুর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ঢাকার বায়ুদূষণ ও পরিবেশের কথা মাথায় রেখে এ প্রকল্প হাতে নেয়া হচ্ছে। অথচ পুরাতন বাস রাস্তা থেকে তুলে দেয়ার বিষয়ে শুরু থেকেই সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে সরকার। এ সুযোগে ঢাকার পরিবহন-ব্যবস্থায় সুনামির মতো ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা যুক্ত হয়ে এর সংখ্যা ছাড়িয়েছে ১৪ লাখ। এর ফলে যানজট এখন রাজধানীবাসীর নিত্যসঙ্গী। সব মিলিয়ে ঢাকার সড়ক গত এক বছরে আরো বেশি নৈরাজ্যকর আর বিশৃঙ্খল হয়ে উঠেছে। সারা দেশে দুর্ঘটনা ও হতাহতের সংখ্যা আগের তুলনায় বেড়েছে। মোটরসাইকেল ও ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা গণপরিবহনের বিকল্প হয়ে ওঠায় হতাহত মানুষের সংখ্যা কমানো যাচ্ছে না। রঙচটা ও লক্কড়-ঝক্কড় বাস, নোঙরা সিট ও শ্বাস বন্ধ করে দেয়া কালো ধোঁয়া আর কানে তালা লাগা হাইড্রোলিক হর্ন।
এ প্রসঙ্গে নিউরোবিশেষজ্ঞ প্রফেসর ডা. শহীদুল্লাহ সবুজ ইনকিলাবকে বলেন, আমাদের দেশে যেভাবে লক্কড়-ঝক্কড় বাস চলে, বিশ্বের কোথাও এমন দেখা যায় না। এমনকি পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত ও শ্রীলঙ্কায়ও নয়। এগুলো আমাদের দারিদ্র্যতাকেই তুলে ধরে বিদেশিদের কাছে। হর্ন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমরা মাঝে মধ্যেই বিদেশিদের কাছে লজ্জা পাই যখন তারা আমাদের কাছে প্রশ্ন করেন, তোমাদের দেশে গাড়িগুলো এত হর্ন বাজায় কেন? কে কার জন্য কেন হর্ন দিচ্ছেÑ সে কারণও খুঁজে পান না তারা। তিনি বলেন, হর্ন মানব দেহের কান ও ব্রেইনের মারাত্মক ক্ষতি করে। কালো ধোঁয়া মানুষের শ্বাসকষ্ট ও হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায়। কালো ধোঁয়ার কারণে ঢাকার বাতাসে সিসার পরিমাণ অত্যধিক বেশি উল্লেখ করে তিনি বলেন, এই সিসা মানুষের ব্রেইনের জন্য ক্ষতিকর এবং স্মৃতিশক্তি কমায়। এতে করে অল্প বয়সেই মানুষ ব্রেইনের রোগের আক্রান্ত হচ্ছে। যেটার প্রতিফলন আমার মতো অনেকেই প্রত্যক্ষ করছে।
বুয়েটের অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক প্রফেসর ড. মো. হাদিউজ্জামান গত বছরের অক্টোবরে বলেছিলেন, মাত্র ছয় হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করা গেলেই ঢাকার গণপরিবহন ব্যবস্থার খোলনলচে বদলে দেয়া সম্ভব। একই ছাতার নিচে একটি সিটি বাস সার্ভিস চালু করতে হবে, যেখানে সরকারের নিয়ন্ত্রণ থাকবে।