
ভারত অধিকৃত জম্মু ও কাশ্মীরের পেহেলগামে ২২ এপ্রিলের কথিত সন্ত্রাসী হামলায় ২৬ জন পর্যটক নিহত হওয়ার পর এই হামলার জন্য সরাসরি পাকিস্তানকে দায়ী করে নরেন্দ্র মোদির সরকার। পাকিস্তান ভারতের এই অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে পেহেলগাম হামলাকে তাদের সাজানো নাটক অভিহিত করে আন্তর্জাতিক তদন্ত দাবি করে। কিন্তু ভারত তাতে সাড়া দেয়নি। এমনকি পেহেলগাম হামলায় পাকিস্তানের হাত আছে, এমন কোনো সুস্পষ্ট প্রমাণও হাজির করতে পারেনি মোদি সরকার।
পেহেলগাম হামলার পর ভারতের মেইনস্ট্রিম মিডিয়া ও রাজনৈতিক নেতাদের পক্ষ থেকে বারবার দাবি করা হতে থাকে, ভারত আবার পাকিস্তানের সন্ত্রাসবাদী হামলার শিকারে পরিণত হয়েছে। পাকিস্তান-সমর্থিত এই সন্ত্রাসী হামলার লক্ষ্যই হচ্ছে ভারতের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি, গণতান্ত্রিক স্থিতিশীলতা এবং ধর্মীয় ও সামাজিক সম্প্রীতিকে বিনষ্ট করা। পেহেলগাম হামলার পর ভারতের প্রভাবশালী সংবাদমাধ্যমগুলো মোদি সরকারের প্রতি এ আহ্বানও জানায় যে, পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারতের প্রয়োজন ‘জিরো রেড লাইন’ এবং প্রতিবেশী দেশটির ব্যাপারে ‘চূড়ান্ত সমাধান’ করার পদক্ষেপ নিতে হবে ভারতকে। এসব মিডিয়া জোরালো ভাষায় বলতে থাকে, ইসরাইলে ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের হামলার পর ইসরাইল সরকার গাজা উপত্যকায় যে ধরনের নির্বিচার হামলা শুরু করে কঠোর জবাব দিয়েছে হামাসকে, ভারতকেও একইভাবে পেহেলগাম হামলার উপযুক্ত জবাব দিতে হবে।
পেহেলগাম হামলার পর ভারতজুড়ে মুসলমানদের ওপর উগ্র হিন্দুদের হামলা, মারধর, বাড়িঘর, দোকান ও অন্যান্য ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ভাঙচুর এবং লুটপাট করা হয়। বিশেষ করে ভারতের বিভিন্ন স্থানে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কাশ্মীরি ছাত্রছাত্রী, চাকরিজীবী, ব্যবসায়ীদের ওপর হামলা ও নানাভাবে হয়রানি করা হয়। নিরাপত্তার অভাবে অনেক কাশ্মীরি মুসলমান তাদের বাড়িতে ফিরে যেতে বাধ্য হন। অন্যদিকে, পেহেলগাম হামলাকে পুঁজি করে অধিকৃত কাশ্মীরে কয়েক হাজার মুসলমানকে গ্রেপ্তার ও নির্যাতন করা হয়। অনেকে বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার হয়েছেন।
পেহেলগাম হামলা নিয়ে দুদেশের পাল্টাপাল্টি হুমকির মধ্যেই গত ৭ মে বুধবার ভোরে পাকিস্তানের কয়েকটি এলাকায় বিমান হামলা করে ভারত। ‘অপারেশন সিঁদুর’ নামে পরিচালিত এই হামলার পর মোদি সরকারের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়, পাকিস্তান-সমর্থিত সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোর কয়েকটি ঘাঁটিতে এসব হামলায় বহু সন্ত্রাসী নিহত হয়েছে। কিন্তু পাকিস্তান সরকার জানিয়েছে, কোনো কথিত সন্ত্রাসী ঘাঁটি নয়, বরং মসজিদ, মাদরাসা ও আবাসিক এলাকায় হামলা করে সাধারণ মানুষকে হত্যা করা হয়েছে, যাদের মধ্যে নারী-শিশুও আছে।
পেহেলগাম হামলার জন্য পাকিস্তান দায়ী- এ ব্যাপারে কোনো প্রমাণ বিশ্বের সামনে হাজির না করে পাকিস্তানে ৭ মের হামলা ছিল আন্তর্জাতিক আইনকানুন ও বিধিবিধানের গালে ভারতের চপেটাঘাত করার শামিল। উল্টো পাকিস্তানে হামলা করে। এর মাধ্যমে ভারত এটা প্রমাণ করার চেষ্টা করে, তারা বিশ্বের উদীয়মান সামরিক শক্তি। তারা কূটনীতির মাধ্যমে সংকট সমাধানের পরিবর্তে পেহেলগাম ইস্যুকে ব্যবহার করে ইসরাইলের মতো সামরিক পন্থাকে বেছে নেয় পাকিস্তানকে ‘শিক্ষা দেওয়া’র জন্য। এ জন্য তারা ‘অপারেশন সিঁদুর’ নামে অভিযানের যে নাম দিয়েছে, তারও বিশেষ তাৎপর্য রয়েছে।
হিন্দুদের বিয়েতে দেখা যায়, কনের কপালে সিঁদুর পরিয়ে দিয়ে বর তাকে নিজের করে নেয়। পেহেলগাম হামলায় যেসব হিন্দুকে তাদের স্ত্রীদের সামনে হত্যা করা হয়েছে, তার প্রতিশোধ নিতেই এই অভিযানের এমন নামকরণ করা হয়। কিন্তু হামলায় বিধবা হওয়া হিন্দু নারীদের প্রতি সম্মান জানাতেই অভিযানের এমন নাম দেওয়া হয়েছে বলে ভারতের পক্ষ থেকে ব্যাখ্যা দেওয়া হচ্ছে, তা যথেষ্ট নয় বলে মনে করেন অনেক বিশ্লেষক।
তাদের মতে, এই নামের মধ্যে কার্যত কট্টর হিন্দুত্ববাদী একটি আদর্শিক ছায়া ও এজেন্ডা লুকিয়ে রয়েছে, যার সঙ্গে ইউরোপীয় ফ্যাসিবাদী আন্দোলনগুলোর অনেকটাই মিল আছে। ভারতের কট্টর হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলোও ফ্যাসিবাদী মানসিকতার এবং তারা মনে করে পাকিস্তান এবং পাকিস্তাননিয়ন্ত্রিত কাশ্মীর কার্যত ভারতেরই অংশ এবং ভারতের অধীনেই নিয়ে আসা উচিত। ইসরাইলের ধর্মীয় উগ্রপন্থি দলগুলো যেমন আশপাশের দেশগুলো দখল করে বৃহত্তর ইসরাইল রাষ্ট্র গঠনের স্বপ্ন দেখছে, ঠিক একইভাবে ভারতের উগ্র হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলোও তাদের স্বপ্নের ‘অখণ্ড ভারত’ গঠনের জন্য আফগানিস্তান থেকে মিয়ানমার পর্যন্ত সব দেশ দখল করার স্বপ্ন দেখে। ইসরাইলি সম্প্রসারণবাদী স্টাইলের অনুসরণ করেই ভারত ‘অপারেশন সিঁদুর’র পরিকল্পনা সাজিয়েছিল। গাজায় যুক্তরাষ্ট্র-সমর্থিত ইসরাইলি গণহত্যার সমর্থক যে কটি দেশ আছে, তার মধ্যে ভারত অন্যতম।
এমনকি ভারত ইসরাইলের গাজা অভিযানে ক্ষেপণাস্ত্র, ড্রোন, বোমা তৈরির উপাদান ও অন্যান্য সমরাস্ত্র দিয়ে সহায়তা করেছে। ইসরাইলের ওপর আন্তর্জাতিক অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা আরোপের প্রস্তাবকেও সমর্থন করেনি ভারত। ভারতের ১২০০০-এর বেশি শ্রমিক গিয়ে ইসরাইলে কাজ করছে ফিলিস্তিনি শ্রমিকদের পরিবর্তে। ভবিষ্যতে ইসরাইল ভারতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তানির্ভর সমরাস্ত্র কারখানা স্থাপনের পরিকল্পনাও করছে।
ইসরাইলের মতো ভারতও আন্তর্জাতিক আইনের তোয়াক্কা না করে পাকিস্তানের মসজিদ, মাদরাসা ও আবাসিক এলাকায় নির্বিচার হামলা চালিয়ে অনেক নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করেছে। ইসরাইল গাজা উপত্যকা ও অধিকৃত পশ্চিমতীরে ফিলিস্তিনিদের বাড়িঘর যেভাবে গুঁড়িয়ে দিচ্ছে প্রতিনিয়ত, একইভাবে ভারত সরকারও উন্নয়ন ও আধুনিকতার নামে দেশটিতে মুসলমানদের বাড়িঘর, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও মসজিদ-মাদরাসা গুঁড়িয়ে দিচ্ছে। মোট কথা, ইসরাইলি কট্টর ইহুদিবাদী মডেল অনুসরণ করে ভারতের উগ্র হিন্দুত্ববাদীরাও দেশটিতে মুসলিম নিধন কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে নরেন্দ্র মোদি ২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর থেকেই সারা ভারতে উগ্র হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির উত্থান ও মুসলিমবিদ্বেষ বাড়তে থাকে। এমনকি উগ্র হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলোর নেতারা প্রকাশ্যেই মুসলিম গণহত্যা শুরুর আহ্বান জানাতে শুরু করেন।
অন্যদিকে, অধিকৃত কাশ্মীরের স্বায়ত্তশাসন-সংক্রান্ত সংবিধানের ৩৭০ ধারা বাতিল করার পর ভারতের একমাত্র মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এই রাজ্যে ভারতের বিভিন্ন এলাকা থেকে হিন্দুদের এনে বসতি তৈরি করে রাজ্যে হিন্দু জনসংখ্যা বাড়ানো হচ্ছে। মোদির সরকার এটাও করেছে ইসরাইলি নীতি অনুসরণ করেই। ইসরাইল সরকার অধিকৃত পশ্চিমতীরে ফিলিস্তিনিদের তাদের বাড়িঘর থেকে উচ্ছেদ ও তাদের আবাদি জমি দখল করে সেখানে শত শত ইহুদি বসতি গড়ে তুলেছে। বছরের পর বছর ধরে ইসরাইলের এই তৎপরতা চলছে। অধিকৃত পশ্চিমতীরে ফিলিস্তিনিরা যেভাবে ধীরে ধীরে সংখ্যালঘুতে পরিণত হচ্ছে, অধিকৃত কাশ্মীরেও মুসলমানদের সংখ্যালঘুতে পরিণত করার নীতি অনুসরণ করছে নরেন্দ্র মোদির সরকার।
লেখক : মিডল ইস্ট আই থেকে অনুবাদ : মোতালেব জামালী