অন্তর্বর্তী সরকারের ছয় মাস পূর্ণ হচ্ছে ৮ ফেব্রুয়ারি। এই সময়ে বিভিন্ন বিষয়ে বিএনপিসহ কয়েকটি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে কিছুটা দূরত্ব তৈরি হলেও বড় কোনো রাজনৈতিক চাপে পড়তে হয়নি সরকারকে। তবে দ্রুত নির্বাচনের দাবি উঠেছে। বিভিন্ন ইস্যুতে বিএনপির সঙ্গে জামায়াতে ইসলামীর মতবিরোধ এবং ছাত্রনেতৃত্বের রাজনৈতিক দল গঠনের প্রক্রিয়া নিয়ে দলগুলোর অস্বস্তি বেশ আলোচনার জন্ম দিয়েছে।
রাজনীতিবিদ ও বিশ্লেষকেরা বলছেন, ছাত্রদের নেতৃত্বে রাজনৈতিক দল গঠন নিয়ে দলগুলোর উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই। নির্বাচন নিয়ে বর্তমানে রাজনীতির হিসাব-নিকাশ পাল্টে গেলেও ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানকেন্দ্রিক বৃহত্তর ঐক্য অটুট রাখা গেলে রাজনৈতিক সংকট হবে না।
গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ৮ আগস্ট শপথ নেয় অন্তর্বর্তী সরকার। এই সরকারের প্রধান উপদেষ্টা শান্তিতে নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস। বিএনপি, জামায়াতসহ বিভিন্ন দল শুরু থেকে সমর্থন দিয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকার সংবিধান, নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কারসহ রাষ্ট্র সংস্কারের লক্ষ্যে কয়েকটি কমিশন গঠন করেছে। তবে রাষ্ট্রপতির পদ থেকে মো. সাহাবুদ্দিনকে অপসারণ দাবি নিয়ে ছাত্রনেতৃত্বের সঙ্গে বিএনপিসহ কয়েকটি দলের মতবিরোধ হয়। আরও কিছু বিষয় নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে বিএনপিসহ কয়েকটি দলের দূরত্ব তৈরি হয়েছে। এই দলগুলো দ্রুত নির্বাচনের দাবি করছে। বিভিন্ন বিষয়ে সরকারের সমালোচনাও করছে বিএনপি।
আওয়ামী লীগের ১৫ বছরের শাসন অবসানের পর রাজনীতির চর্চা উন্মুক্ত হলেও নির্বাচন নিয়ে এখনো সুনির্দিষ্ট সময় উল্লেখ না করাটা ভালোভাবে নিচ্ছেন না রাজনীতিবিদেরা। তাঁরা দ্রুত গণতন্ত্রে উত্তরণ করে জনগণের প্রত্যাশা পূরণে সরকারকে তাগিদ দিচ্ছেন।
সময়ের প্রয়োজনে ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে জাতীয় ঐক্য গড়ে উঠেছিল বলে মনে করেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন। তিনি আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘ওই ঐক্য ছিল স্বৈরাচারী ফ্যাসিস্ট সরকারের পতন ঘটাতে। সেটা তো ঘটে গেছে। এখন প্রত্যাশা পূরণের সময়।’ তিনি আরও বলেন, এই সরকারকে সবাই সংস্কারের জন্য সময় দিয়েছে। কিন্তু সরকার উল্লেখযোগ্য কিছু করতে পারেনি। তাই সরকারের প্রতি মানুষ একটু হতাশ।
অবশ্য বিভিন্ন বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে দৃশ্যমান মতবিরোধ নিয়ে উদ্বেগের কিছু নেই বলে মনে করছেন অনেকে। তাঁরা বলছেন, স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, ভোটাধিকার, গণতান্ত্রিক রূপান্তরসহ মোটাদাগে বৃহত্তর স্বার্থে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐক্য অটুট রয়েছে। এখন দলগুলোর মধ্যে নানা বিষয়ে যে বিতর্ক হচ্ছে, সেটা সুস্থ প্রতিযোগিতারই অংশ। এটা নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই।
গণতন্ত্র মঞ্চের নেতা ও বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, ছয় মাস আগে বিশেষ একটি পরিস্থিতিতে ঐক্য হয়েছিল। এখন তো নির্বাচন সামনে। প্রতিটি দল ও জোট তাদের নিজ নিজ রাজনৈতিক অ্যাজেন্ডা নিয়ে, কর্মসূচি নিয়ে সামনে যাবে, এটাই স্বাভাবিক। রাজনৈতিকভাবে তর্ক-বিতর্ক হবে, সমালোচনা হবে। এটিকে সুস্থ রাজনীতির বহিঃপ্রকাশ বলে গণ্য করতে চান তিনি।
বিএনপির সঙ্গে বিভিন্ন ইস্যুতে মতবিরোধ হলেও জাতীয় ঐক্যে বড় কোনো সমস্যা দেখছে না জামায়াতে ইসলামীও। জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘জাতীয় ঐক্যের মধ্যে বড় কোনো ব্যত্যয় দেখছি না। তবে কিছু কিছু বক্তব্য ও আচরণ ঐক্যের পথে সমস্যা সৃষ্টি করছে।’ এ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দল ও নেতাদের কাছে আরও দায়িত্বশীল ভূমিকা প্রত্যাশা করেছেন তিনি।
অন্তর্বর্তী সরকারের ছয় মাসের দেশ পরিচালনা নিয়ে বিভিন্ন দলের নেতারা বলছেন, নিয়ন্ত্রণহীন বাজার, জনগণের জানমালের নিরাপত্তাহীনতাসহ নানান অস্বস্তিতে রয়েছে মানুষ। সরকার পরিস্থিতি সামাল দিতে পারছে না। সরকারের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর বোঝাপড়াও খুব একটা ভালো নয়। কিছুটা দূরত্ব এবং আস্থার ঘাটতি দেখা যাচ্ছে। ছাত্রদের রাজনৈতিক দল গঠনের সঙ্গে পরোক্ষভাবে সরকার যেভাবে জড়িয়ে যাচ্ছে, তা সরকারকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে, বিতর্কের মুখে ফেলছে এবং অপ্রয়োজনীয় সংকট তৈরি করবে। তাঁরা বলেন, নতুন দল গঠনে সরকারের পরোক্ষ সমর্থন অব্যাহত থাকলে দলগুলোর সঙ্গে দূরত্ব বাড়বে।
রাজনৈতিক দলগুলো বলছে, দ্রুত নির্বাচিত সরকার প্রয়োজন। সরকারের সদিচ্ছা থাকলে প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে চলতি বছরেই জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব। তবে এ ক্ষেত্রেও অন্তর্বর্তী সরকারকে নির্দলীয় চরিত্র বজায় রাখতে হবে।
নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না আজকের পত্রিকাকে বলেন, সংস্কারের নামে সময়ক্ষেপণ যুক্তিযুক্ত নয়। এর ফলে নানা সংকট দেখা দিচ্ছে, যে যা খুশি করছে। এই অবস্থায় জাতীয় নির্বাচন হওয়াটা খুব দরকার।
একাধিক রাজনৈতিক নেতা বলেছেন, সরকারের নিরপেক্ষতা প্রশ্নবিদ্ধ হলে এই সরকারের অধীনে আগামী জাতীয় নির্বাচন করা যাবে কি না, এ প্রশ্ন পরে বড় হয়ে দেখা দিতে পারে। সেই ঝুঁকিটা আছে।
সরকার গণতন্ত্র ফিরিয়ে দেওয়ার ওয়াদা করেছে উল্লেখ করে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘একটা সময়ের মধ্যে জনগণের সরকারের কাছে ক্ষমতা দিয়ে এই সরকারকে বিদায় নিতে হবে। সে কারণে যত দ্রুত সম্ভব নির্বাচন অনুষ্ঠান সরকারের জন্য এবং জনগণের জন্যও অত্যন্ত প্রয়োজন। নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করলে দেশের মানুষ নির্বাচনমুখী হবে।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সাব্বির আহমেদ বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে চলমান মতপার্থক্য স্বাভাবিক রাজনীতির অংশ। সরকারের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর বোঝাপড়া রয়েছে।