Image description

রীতিমতো চারদিকে ঢাকঢোল পিটিয়ে চালু করা হয় সর্বজনীন পেনশন। শুরুতে ব্যাপক জনকল্যাণের কথা বলা হলেও বাস্তবে এই উদ্যোগ ক্রমেই অন্তঃসারশূন্য হয়ে পড়ছে। যত দিন যাচ্ছে সর্বজনীন পেনশন তত গতি হারাচ্ছে।

সর্বজনীন পেনশনের প্রসার ঘটিয়ে বৃহৎ আকারে সুবিধা দেওয়ার স্বপ্ন দেখালেও তা ফিকে হতে শুরু করেছে। কারণ পরিকল্পনার সঙ্গে বাস্তবতায় রয়েছে অনেক ফারাক। ফলে বর্তমান পরিস্থিতিতে পিছিয়ে পড়ছে এই কর্মসূচি। ছয় মাস ধরে টানা কমছে নতুন গ্রাহক নিবন্ধন। ন্যূনতম চাঁদা এক হাজার টাকা ধরে হিসাব করলেও নিবন্ধিত গ্রাহকদের মধ্যে বর্তমানে মাত্র ১৪.৭৬ শতাংশ টাকা জমা দিচ্ছে। স্কিমভেদে ন্যূনতম চাঁদা এক হাজার ও দুই হাজার টাকা। স্কিমগুলোয় সর্বনিম্ন চাঁদা এক হাজার থেকে সর্বোচ্চ ১০ হাজার টাকা রয়েছে। এ হিসাবে বাস্তবে ১০ শতাংশের কম গ্রাহক চাঁদা পরিশোধ করছে।

জানা গেছে, বর্তমানে নিবন্ধিত তিন লাখ ৭৩ হাজার ২২৪ জন গ্রাহকের মধ্যে চলতি জানুয়ারি মাসে চাঁদা জমা পড়েছে পাঁচ কোটি ৫০ লাখ ৭৩ হাজার টাকা। নিবন্ধিত এই গ্রাহকরা ন্যূনতম এক হাজার টাকা করে চাঁদা দিলেও ৩৭ কোটি ৩২ লাখ ২৪ হাজার টাকা জমা হওয়ার কথা, কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। আস্থার ঘাটতিতে গতিহীন হয়ে পড়েছে সর্বজনীন পেনশন কার্যক্রম।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা জানান, ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকার ভোটের মাঠে জনতুষ্টির জন্য গত নির্বাচনের আগে ঘটা করে চালু করে সর্বজনীন পেনশন কর্মসূচি। ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চাওয়া পূরণ করতে গিয়েই পেনশন কর্মসূচির এই অবস্থা। শেখ হাসিনার অবাস্তব ইচ্ছা পূরণে তৎকালীন অর্থসচিব আব্দুর রউফ তালুকদার এমন কাজ করেছেন।

২০২৩ সালের ১৭ আগস্ট আনুষ্ঠানিকভাবে সর্বজনীন পেনশন কর্মসূচির উদ্বোধন করেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রথম মাসে চালু করা চারটি স্কিমে ১২ হাজার ৮৮৯ জন গ্রাহক যুক্ত হয়। এর পরে আর তেমন সাড়া মেলেনি। কর্মসূচি চালুর আট মাস পর এপ্রিল পর্যন্ত নিবন্ধনকারীর সংখ্যা এক লাখে পৌঁছে। তবে গত বছর মে ও জুন মাসে জেলায় জেলায় প্রচার ও সচেতনতা কর্মসূচি ঘিরে মানুষের কিছুটা আগ্রহ বেড়েছিল। তখন বেশ ভালো চাঁদাও জমা হয়েছে। ওই দুই মাসে দুই লাখের বেশি মানুষ কর্মসূচিতে যুক্ত হয়েছে। গত অর্থবছর অর্থাৎ জুন শেষে নিবন্ধিত গ্রাহক ছিল তিন লাখ ৩৮ হাজার ৯৪১ জন। তখন মোট চাঁদা জমা হয়েছিল ৯৯ কোটি ৪২ লাখ ৯১ হাজার টাকা।

চলতি অর্থবছর শুরুর পর গত জুলাই মাসে গ্রাহকসংখ্যা দাঁড়ায় প্রায় তিন লাখ ৬০ হাজারে। এই মাসে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সর্বজনীন পেনশনের প্রত্যয় স্কিমকে বৈষম্যমূলক দাবি করে আন্দোলন শুরু করলে গত ৪ আগস্ট পুরো স্কিমই বাতিল ঘোষণা করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী।

সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থাপনা আইন, ২০২৩-এর ১৪(২) ধারা অনুযায়ী, ১ জুলাই ২০২৪ থেকে স্বশাসিত, স্বায়ত্তশাসিত ও রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানে চাকরিতে যোগদানকারী সব কর্মচারী বাধ্যতামূলকভাবে প্রত্যয় স্কিমের আওতাভুক্ত হবেন। চলতি অর্থবছরের বাজেট বক্তৃতায় বিষয়টির ঘোষণা দেন তৎকালীন অর্থমন্ত্রী। এর পরই আন্দোলন শুরু করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা।

জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা যায়, গত জুলাই থেকে কমতে শুরু করে নতুন গ্রাহক। জুলাইয়ে স্কিমে যুক্ত হয়েছে ২১ হাজার ৭০ জন। আগস্টে যুক্ত হয়েছে ১১ হাজার ৯৭০ জন। এরপর সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত স্কিমে গড়ে ৩০০ জন যুক্ত হয়। আর গত জানুয়ারি মাসে মাত্র ১৬৬ জন নতুন গ্রাহক যুক্ত হয়েছে। ছয় মাস ধরে প্রতি মাসে সাড়ে পাঁচ কোটি থেকে সাত কোটি টাকার মতো চাঁদা জমা পড়ছে। সব মিলিয়ে জানুয়ারি পর্যন্ত এই কর্মসূচিতে তিন লাখ ৭৩ হাজার ২২৪ জন গ্রাহক ১৫৪ কোটি ৫৩ লাখ ৭৩ হাজার ৫০০ টাকা চাঁদা জমা দিয়েছে। তবে এই স্কিম পরিচালনার জন্য গঠিত জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে বহন করা হচ্ছে। তাঁদের জন্য মাসে বর্তমানে প্রায় ৩০ লাখ টাকা ব্যয় হচ্ছে।

আগের সরকারের প্রতি আস্থার ঘাটতি এবং প্রচারণার অভাবে স্কিমের বিস্তারিত জানে না অনেকে। দীর্ঘ মেয়াদে টাকা রাখতে ভরসাও পাচ্ছে না তারা। তবে স্কিম চলমান ও আকর্ষণীয় করার পরামর্শ দিয়ে আসছেন অর্থনীতিবিদরা। প্রবাসীদের জন্য প্রবাস, বেসরকারি চাকরিজীবীদের জন্য প্রগতি, স্বকর্মে নিয়োজিতদের জন্য সুরক্ষা এবং স্বল্প আয়ের জনগোষ্ঠীর জন্য সমতা’—এই চারটি ক্যাটাগরির স্কিম চালু করা হয়। তবে এক বছরের বেশি সময় পার হলেও অনেকে এখনো জানে না যে এই স্কিমের সুবিধা-অসুবিধা কী।

খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, পেনশন স্কিমের সুবিধা-অসুবিধার বিষয়ে অবগত নয় বেশির ভাগ মানুষ। এখানে টাকা রাখলে সরকারি চাকরিজীবীদের মতো এককালীন আনুতোষিক দেবে না, শুধু প্রতি মাসে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য পেনশন পাওয়ার আশায় ঝুঁকি নিতে আগ্রহী নয় তারা। যারা যুক্ত হয়েছে তারাও আস্থাহীনতায় গুটিয়ে নিতে চাইছে।

রাজধানীর মিরপুরের বাসিন্দা বেসরকারি চাকরিজীবী মোহাম্মদ শাহজাহান বলেন, অনেক আশা নিয়ে সর্বজনীন পেনশন কর্মসূচিতে নিবন্ধন করেছি, কিন্তু ঘোষণায় সর্বজনীন হলেও বাস্তবে বেশ বৈষম্য রয়েছে। শুরুতে কিছুদিন চাঁদা দিলেও কয়েক মাস ধরে আর চাঁদা দিচ্ছি না। বরং জমা টাকা তুলে নেওয়ার পরিকল্পনা করেছি।

তিনি বলেন, শিক্ষকরা সঠিক বিষয় তুলে ধরে দাবি জানিয়েছেন। ওই বিষয়গুলো সমাধান না করে তাদের আগের সুবিধা বহাল রাখা হয়েছে। ফলে সর্বজনীন পেনশনের গ্রাহকরা বৈষম্যের শিকার হবে।

আস্থা ফেরাতে উদ্যোগী কর্তৃপক্ষ

পেনশন কর্তৃপক্ষ জনসাধারণের আস্থার ঘাটতি দূর করতে আশ্বাস দিচ্ছে, জমা করা টাকার গ্যারান্টি দেবে সরকার। পেনশন কর্তৃপক্ষ জানায়, জনসাধারণকে অবহিত করতে প্রচারণার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আগস্টের পর পেনশন স্কিমের গতি অনেকটা থেমে ছিল। এখন সেটা কাটতে শুরু করেছে।

গত ১৪ অক্টোবর অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদের সভাপতিত্বে সর্বজনীন পেনশন কর্তৃপক্ষের পরিচালনা পর্ষদের প্রথম সভায় অংশগ্রহণ বাড়াতে বিধিমালা পরিবর্তন করে সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির পাশাপাশি বেশ কিছু নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়।

ওই সিদ্ধান্তের আলোকে শিগগিরই স্কিমগুলোর প্যাকেজে পরিবর্তন আসছে। এককালীন আনুতোষিক ও বীমা সুবিধা দেওয়ার ঘোষণা দেওয়া হতে পারে। এ ছাড়া সরকারি প্রকল্পে আবাসন সুবিধাসহ অন্যান্য সুবিধা বাড়ানো হবে। এমনকি কেউ মারা গেলে পুরো টাকা দেওয়ার সুযোগ আসতে পারে। এই স্কিমে যারা আছে এবং আগামী দিনে যারা যুক্ত হবে সবাই এসব সুবিধা পাবে বলে জানান সংস্থাটির কর্মকর্তারা। তাঁরা জানান, এখন পর্যন্ত জমা টাকা শুধু ট্রেজারি বন্ডে বিনিয়োগ করা হয়েছে। আগামী দিনে আবাসন, পাঁচতারা হোটেল, ইন্টারন্যাশনাল হাসপাতালসহ নানা ক্ষেত্রে বিনিয়োগ করার পরিকল্পনা আছে। বর্তমানে পেনশন স্কিমে ১২টি ব্যাংক এবং এমএফএসে নগদ ও বিকাশ রয়েছে। আরো ১০টি ব্যাংকের সঙ্গে চুক্তি করা হবে। পেনশন স্কিমে ৯টি করপোরেট প্রতিষ্ঠান যুক্ত হয়েছে। আগস্টের পরেও একটি প্রতিষ্ঠান যুক্ত হয়েছে। প্যাকেজের সুবিধা বাড়লে তখন সবাই যুক্ত হবে। 

জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষের সদস্য মো. গোলাম মোস্তফা কালের কণ্ঠকে বলেন, গত ৫ আগস্টের পর থেকে অনেকে মনে করেছে পেনশন স্কিম নেই। এ জন্য চাঁদা দেওয়ায় ধীরগতি গেছে। এখন বিপিএল ও একুশে বইমেলায় প্রচারণা শুরু করা হয়েছে। এতে গতি কিছুটা বাড়ছে। তা ছাড়া আগে চাঁদা দেওয়ার সময় হলে খুদে বার্তা দেওয়া হতো। এটা অনেকে ঠিকভাবে দেখে না। সমতায় যুক্ত গ্রাহকের অনেকে পড়তে পারে না। এ কারণে এখন ভয়েস মেসেজ দেওয়া হচ্ছে।