সিন্ডিকেট গঠন করে বেসরকারি পূবালী ব্যাংকের শত শত কোটি টাকা আত্মসাৎ ও বিদেশে পাচারের বিষয়ে অনুসন্ধান শুরু করেছে দুদক। ব্যাংকটির চেয়ারম্যান মঞ্জুরুর রহমান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং সিইও মোহাম্মদ আলীর নেতৃত্বে কমপক্ষে পাঁচ পরিচালকের একটি চক্র দীর্ঘদিন ধরে ব্যাংকটিতে লুটপাট ও অনিয়ম চালিয়ে যাচ্ছে। চক্রের সদস্যদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য দু-এক দিনের মধ্যে নোটিশ পাঠানো হবে। দুদকের সংশ্লিষ্ট নথি থেকে এ তথ্য জানা গেছে।
এদিকে পূবালী ব্যাংকের চক্রের বিরুদ্ধে পৃথক তদন্তে নেমেছে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)। সংস্থাটির একজন যুগ্ম পরিচালকের নেতৃত্বে ঋণ বিতরণে অনিয়ম, ডলার কারসাজি, অর্থ পাচার, নিয়োগে অনিয়ম, বন্ধকী সম্পত্তি স্বল্পদামে বিক্রিসহ বিভিন্ন অভিযোগ খতিয়ে দেখা হচ্ছে। ওইসব তদন্ত ধামাচাপা দেওয়ারও অপচেষ্টা চলছে বলে জানা গেছে।
দুদক সূত্র জানায়, গত সেপ্টেম্বর মাসে জনৈক ফরহাদ হোসেন কমিশনে একটি অভিযোগ দেন। সেখানে পূবালী ব্যাংকের চেয়ারম্যান মো. মঞ্জুরুর রহমান, ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও মোহম্মদ আলী, ব্যাংকটির সাবেক চেয়ারম্যান এবং আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য হাফিজ আহমেদ মজুমদার, পরিচালক ফাহিম আহমেদ ফারুক ও অন্য পরিচালক খবিরুজ্জামান ইয়াকুবের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ উত্থাপন করেন। কমিশন অভিযোগটি আমলে নিয়ে অনুসন্ধানপূর্বক প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দিয়েছে। দুদকের সমন্বিত জেলা কার্যালয় ঢাকা-১-এর সহকারী পরিচালক মো. হাফিজুর রহমানকে গত সোমবার অনুসন্ধান কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
দুদক সূত্র জানায়, পূবালী ব্যাংকের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগগুলোর মধ্যে রয়েছে ব্যাংকটিতে পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের ছত্রছায়ায় একটি শক্তিশালী চক্র ব্যাপক অনিয়ম, নিয়োগবাণিজ্য, ভয়াবহ রকমের ডলার কারসাজি, সম্পত্তি বিক্রি, ঋণ বিতরণের অনিয়মসহ নানা দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েছে। বৈদেশিক মুদ্রা ক্রয়-বিক্রয় এবং বাণিজ্যের আড়ালে রহস্যজনক অর্থ লেনদেন সংক্রান্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি তদন্ত ইতঃপূর্বে ক্ষমতার দাপটে বন্ধ হয়ে গেছে। পূবালী ব্যাংকের দুষ্টচক্রের অন্যতম হোতা ছিলেন পতিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপদেষ্টা প্রয়াত এইচটি ইমামের ভাগনে মোহাম্মদ আলী। যিনি দীর্ঘদিন ধরে ব্যাংকটিতে এমডি ও সিইও পদে আছেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর সাইদুর রহমান ও এস কে সুরের সহযোগিতায় চক্রের সদস্যরা ব্যাংকটিকে লুটপাটের আখড়ায় পরিণত করেন। ২০২৩ সালে ব্যাংকটির একটি চক্র ডলার কারসাজির মাধ্যমে বিপুল অর্থ লুট করে নেয়। বিভিন্ন এক্সচেঞ্জ হাউস থেকে ডলার কিনে ২১১ কোটি টাকা বেশি ব্যয় বা আত্মসাৎ করেছে। মঞ্জুরুর রহমান ও মোহাম্মদ আলী চক্র কিছুদিন আগে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে প্রবাসীদের এক্সচেঞ্জ করা শত শত কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা ব্যাংকিং চ্যানেলে না দিয়ে বিদেশে পাচার করেন। দুদকের এনফোর্সমেন্ট টিমের অভিযানেও এই অর্থ পাচারের প্রমাণ পাওয়া যায়।
দুদক সূত্র জানায়, ব্যাংকটির বর্তমান চেয়ারম্যান মঞ্জুরুর রহমান ডেল্টা লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির ২৫ লাখ গ্রাহকের আমানতের ১ হাজার ১৪১ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন। পূবালী ব্যাংকের অন্যতম অংশীদার ডেল্টা লাইফ ইন্স্যুরেন্স। মঞ্জুর রহমান ডেল্টা লাইফে তার চার সন্তানকে পরিচালক পদে নিয়োগ করেছেন। মঞ্জুরের কন্যা আদিবা রহমানকে প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার পদ দিয়েছেন। ডেল্টা লাইফ ইন্স্যুরেন্সের হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাট করে তিনি আওয়ামী লীগ সরকারের ছত্রছায়ায় থেকে পূবালী ব্যাংকেও লুটপাট অব্যাহত রাখেন। ডেল্টা লাইফ ইন্স্যুরেন্স পূবালী ব্যাংকের শেয়ারধারী হিসেবে পরিচালক হয়েছিলেন মঞ্জুরুর রহমান। ডেল্টা লাইফের ২ হাজার ৯০০ কোটি টাকা আত্মসাতের জন্য প্রতিষ্ঠানটির ডাটাবেজ সার্ভারের গুরুত্বপূর্ণ সব তথ্য মুছে ফেলার অভিযোগ রয়েছে মঞ্জুরুর রহমানে বিরুদ্ধে।
এ ছাড়া পূবালী ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান হাফিজ আহমেদ মজুমদারের বিরুদ্ধেও বিশদ অভিযোগ রয়েছে। তিনি চেয়ারম্যান থাকাকালে অনিয়ম-জালিয়াতির দায়ে ১০ পরিচালককে সরানোর নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ব্যাংকিং নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে মঞ্জুরুর রহমানের আগে প্রায় এক যুগ পূবালী ব্যাংকের চেয়ারম্যানের পদ আঁকড়ে ছিলেন। পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের ক্ষমতার জোরে ব্যাংক কোম্পানি আইন আর বাংলাদেশ ব্যাংকের বিভিন্ন নির্দেশনাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে কয়েকজন পরিচালক দীর্ঘদিন পরিচালক পদে অধিষ্ঠিত। ব্যাংকটির সাবেক চেয়ারম্যান ও সাবেক এমপি হাফিজ আহমেদ মজুমদার বর্তমানে আত্মগোপনে আছেন। এ ছাড়া ভাইস চেয়ারম্যান হাবিবুর রহমান, পরিচালক ফাহিম আহমেদ ফারুক চৌধুরী ও এম খাবিরুজ্জামান ইয়াকুবসহ কয়েকজন এই সিন্ডিকেটের মূলহোতা বলে দুদকে জমা হওয়া নথিতে উল্লেখ করা হয়েছে।
অভিযোগে আরও বলা হয়, সাবেক এমপি হাফিজ আহমেদ মজুমদার বর্তমানে ডেল্টা লাইফ ইন্স্যুরেন্সের চেয়ারম্যান। তার আগে চেয়ারম্যান ছিলেন মঞ্জুরুর রহমান। তারা দুজনই প্রায় দেড়যুগ ধরে পূবালী ব্যাংক ও ডেল্টা লাইফ ইন্স্যুরেন্সের চেয়ারম্যানের পদ দখল করে লুটপাট ও অর্থ আত্মসাৎ করছেন।
পূবালী ব্যাংকের বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) প্রধান এ এফ এম শাহীনুল ইসলাম কালবেলাকে বলেন, এই বিষয়ে আমার কাছে এখনো কোনো তথ্য আসেনি। তদন্ত চলমান। আর কিছু বলতে পারব না।
দুদকের উপপরিচালক মো. আখতার হোসেন বলেন, অভিযোগ জমা হওয়ার পর তা আমলে নিয়ে তদন্ত শুরু হয়েছে। তদন্ত কর্মকর্তা অভিযোগ সংশ্লিষ্টদের জিজ্ঞাসাবাদ করবেন। এ বিষয়ে ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আলীর কাছে জানতে চাইলে তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।