নীলফামারীর ডোমার উপজেলার পাটোয়ারী পাড়া গ্রামের বাসিন্দা শামসুল হক। জীর্ণশীর্ণ শরীর, বয়স ৭০ কি ৮০, তা-ও ঠিক বলতে পারছেন না। শুধু জানিয়েছেন, সংসারে অভাব-অনটন লেগে আছে। এখন ঘুম হারাম হঠাৎ জানতে পারা ঋণের খবরে। টাকা দিতে না পারলে জেলের ভাত খাওয়ানোর হুমকি দেওয়া হয়েছে। যে ঋণের কথা বলা হচ্ছে, তাঁর নামে সেটি নিয়েছিলের বেসরকারি সংস্থা (এনজিও) স্বনির্ভর বাংলাদেশ-এর কর্মকর্তা-কর্মীরা।
শামসুল হক জানান, তাঁর ছবি ও খালি চেকে স্বাক্ষর নিয়েছিলেন স্বনির্ভর বাংলাদেশ-এর স্থানীয় শাখার তিন কর্মী ও একজন ব্যাংক কর্মকর্তা। হাতে ৮০০ টাকা ধরিয়ে দিয়ে তাঁরা বলেছিলেন, এটি ‘ভিক্ষা ঋণ’, পরিশোধ করতে হবে না। অথচ এখন জানতে পেরেছেন, তাঁর নামে নেওয়া ঋণের পরিমাণ ছিল ৩০ হাজার টাকা। ওই কর্মকর্তারা বাকি টাকাটা ভাগ-বাঁটোয়ারা করে আত্মসাৎ করলেও এখন দায় চেপেছে হতদরিদ্র গ্রাহকের কাঁধে।
শুধু শামসুল হক নন, সোনালী ব্যাংকের চিলাহাটি শাখা থেকে তাঁর মতো ৮৪০ জন গ্রাহককে স্বনির্ভর বাংলাদেশ-এর মাধ্যমে ২ কোটি ৭৪ লাখ টাকা বিতরণ করা হয়। এর মধ্যে অন্তত দুই শ গ্রাহক প্রতারিত হয়েছেন। সঠিক তথ্য অজানা থাকায় তাঁদের ঋণের পুরোটাই দীর্ঘদিন ধরে খেলাপি।
জানতে চাইলে সোনালী ব্যাংকের চিলাহাটি শাখার ব্যবস্থাপক সাদেকুল ইসলাম আজকের পত্রিকাকে বলেন, স্বনির্ভর বাংলাদেশের আয়োজনে ৮৪০ জন গ্রাহকের মাঝে ২ কোটি ৭৪ লাখ টাকার ঋণ শুধু তাঁর শাখা থেকে বিতরণ করা হয়, যার পুরোটা বছরের পর বছর খেলাপি। টাকার পরিমাণ কম থাকায় মামলা হয়নি। এনজিওটির কার্যক্রম বন্ধ থাকায় সব গ্রাহককে চিহ্নিতকরণ এবং খেলাপি ঋণ আদায়ে বেগ পেতে হচ্ছে।
স্বনির্ভর বাংলাদেশ ১৯৮১ সাল থেকে কার্যক্রম পরিচালনা করছে। শুরুতে নানা সেবামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করলেও ক্ষুদ্র ঋণ বিতরণের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার পর থেকে অনিয়ম-জালিয়াতিতে জড়িয়ে পড়েন সংস্থাটির কর্মকর্তারা। ঋণ বিতরণের নামে স্বনির্ভর বাংলাদেশ-এর এমন জালিয়াতির তথ্য উঠে এসেছে মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটির (এমআরএ) পরিদর্শন প্রতিবেদনে। এমআরএ জানিয়েছে, বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক বিভিন্ন বাণিজ্যিক ব্যাংকের অর্থায়নে ৪০টি জেলায় ৩৩টি এরিয়া অফিস এবং ৭৭৫টি শাখার মাধ্যমে এনজিওটির বিতরণ করা ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ৮০০ কোটির বেশি। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, সংস্থাটির ঋণ কার্যক্রম যতটা বিস্তৃত, ততটা বিস্তার ঘটেছে কর্মকর্তাদের প্রতারণার ফাঁদও।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, স্বনির্ভর বাংলাদেশ-এর মাধ্যমে ১৯৯৮ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত নীলফামারীর ডোমার উপজেলায় কেতকীবাড়ি ও ভোগডাবুড়ী ইউনিয়নে দেড় শতাধিক গ্রাহকের নামে ক্ষুদ্র ঋণ দেওয়া হয়। এই ঋণগ্রহীতাদের অনেকে জানেন না, তাঁদের নামে ঋণ আছে। মূলত ‘ভিক্ষা ঋণ’ নাম দিয়ে তাঁদের ছবি ও স্বাক্ষর নিয়ে ওই ঋণ সৃজন করে একটি চক্র। একেকজনের নামে ২৫-৩৫ হাজার ঋণ নেওয়া হলেও তাঁরা পান ৮০০ থেকে ২০০০ টাকা। মূলত স্বনির্ভর বাংলাদেশ-এর তৎকালীন কর্মকর্তা ওমর ফারুক ওরফে কাজল, মোকাররম হোসেন, মারুফ হোসেন, স্থানীয় দালালখ্যাত আশিকুর ও সাবুল এবং সোনালী ব্যাংক কর্মকর্তা আবু ফয়েজ সংঘবদ্ধভাবে এই প্রতারণা করেন।
জানতে চাইলে স্বনির্ভর বাংলাদেশ-এর তৎকালীন ইউনিট ম্যানেজার ববি বেগম বলেন, ‘হাতে টাকা পায়নি এমন অভিযোগ আমার কাছে কেউ করেনি। এটা রহস্যজনক। তবে ঋণ যে আদায় হয়নি, সেটা সত্য।’
পটুয়াখালীর বাউফল উপজেলার মদনপুরা ইউনিয়নের হোসনাবাদ কেন্দ্রে স্বনির্ভর বাংলাদেশ-এর সদস্য ছিলেন রওশন আরা নামের এক গৃহিণী। এনজিওটির সদর ইউনিয়নের কর্মকর্তা নাজমা বেগম তাঁকে ঋণ দেওয়ার কথা বলে বাউফল অগ্রণী ব্যাংকের নিচে ডেকেছিলেন। সেখানে তাঁর কাছ থেকে স্বাক্ষর ও ছবি নেওয়ার পর বলা হয়, ‘এখন চলে যান, ঋণ পাস হলে জানানো হবে।’ রওশন আরা ঋণের তথ্য জানতে পেরেছেন ঠিকই, তবে অন্তত চার বছর পর। যদিও ওই ঋণের কোনো টাকা পাননি তিনি।
একই এলাকার ভুক্তভোগী হানিফ হাওলাদার জানান, তাঁর বাড়িতে স্বনির্ভরের একটি কেন্দ্র ছিল। তখন ২৫ হাজার ঋণ নিয়ে সময়মতো পরিশোধ করেছিলেন। কিন্তু সম্প্রতি অগ্রণী ব্যাংকের শাখা থেকে আব্বাস নামের এক কর্মকর্তা ৫ লাখ টাকা ঋণ বকেয়ার বিষয়ে জানিয়েছেন। টাকা না দিলে মামলা করার ভয় দেখাচ্ছেন। সেই ভয়ে সপরিবার এলাকা ছেড়ে ঢাকায় গা ঢাকা দিয়ে নির্মাণশ্রমিকের কাজ করছেন তিনি।
সহজ শর্তে কৃষিঋণের নামে অগ্রণী ব্যাংকের বাগেরহাটের কচুয়া উপজেলার গোয়ালমাঠ শাখা থেকে ১ কোটি ৭৭ লাখ টাকা বিতরণ করা হয়েছে। স্বনির্ভর বাংলাদেশ-এর মাধ্যমে বিতরণ করা এই ঋণের অধিকাংশই সংস্থাটির ক্রেডিট ম্যানেজার সরদার আলমগীর হোসেন অন্যদের সঙ্গে যোগসাজশে আত্মসাৎ করেছেন বলে জানা গেছে।
ঋণ জালিয়াতিতে জড়িত স্বনির্ভর বাংলাদেশ এখন কোনো ধরনের কার্যক্রমে নেই বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি সূত্র জানিয়েছে, ৬ শতাংশ কমিশনের বিনিময়ে প্রায় ৯০০ কোটি টাকা ঋণ বিতরণ করেছে স্বনির্ভর বাংলাদেশ। এখন তারা শত শত গ্রাহককে খুঁজে পাচ্ছে না। ঋণের অর্থ তছরুপ করার কারণে নথিপত্র সংরক্ষণ করা হয়নি। এখন নতুন করে অর্থ তছরুপের লক্ষ্যে অর্থায়ন চাইছে সংস্থাটি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক হুসনে আরা শিখা আজকের পত্রিকাকে বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক ক্ষুদ্রঋণ বিতরণে নীতিমালা মেনে চলার পরামর্শ দিয়েছে। গ্রাহকের সঙ্গে প্রতারণার অভিযোগ গুরুত্বসহকারে দেখা হচ্ছে। অপরাধের তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে স্বনির্ভর বাংলাদেশ-এর চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মো. মামুন-অর-রশিদ আজকের পত্রিকাকে বলেন, দীর্ঘদিনের কোন্দল, মামলা ও দখলবাজির কারণে প্রতিষ্ঠানটির কার্যক্রম কয়েক বছর ধরে বন্ধ। কোথাও কোনো শাখা চলছে না। এতে ঋণ বিতরণ ও আদায় বন্ধ রয়েছে। ফলে কমিশনও বন্ধ। এমনকি ব্যাংক হিসাব ফ্রিজ থাকায় ঋণের কমিশন ও এফডিআরের অর্থ ব্যবহার করা যাচ্ছে না। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন বন্ধ হয়ে পড়েছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে অর্থ দরকার। অর্থ পেলে কার্যক্রম আবার চালু করা সম্ভব। তখন ঋণ আদায় হবে।
বিভিন্ন ব্যাংকের পাশাপাশি পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশন (পিকএসএফের) থেকে অর্থ নিয়েও ঋণ বিতরণ করেছে স্বনির্ভর বাংলাদেশ। কিন্তু পিকেএসএফের ঋণ বিতরণের তথ্য গোপন করেছে বলে জানিয়েছে সংস্থাটি। ঋণ বিতরণের নামে স্বনির্ভর বাংলাদেশ এমন জালিয়াতির তথ্য উঠে এসেছে মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটি (এমআরএ) পরিদর্শন প্রতিবেদনেও।
পিকেএসএফের সহকারী মহাব্যবস্থাপক ও আরটিআই কর্মকর্তা নাসির উদ্দিন বলেন, ২০২২ সাল পর্যন্ত স্বনির্ভর বাংলাদেশের মাধ্যমে পিকেএসএফের ঋণের পরিমাণ ৩১ কোটি ১৫ লাখ ২২ হাজার টাকা। সুদ ও সার্ভিস চার্জ বাবদ বকেয়া ৪ কোটি ৫৪ লাখ ৪৪ হাজার টাকা। পাওনা আদায়ে স্বনির্ভর বাংলাদেশকে ইতিমধ্যে লিগ্যাল নোটিশ দেওয়া হয়েছে।
এমআরএর পরিদর্শন প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২৩ সালে পরিচালিত পরিদর্শনে স্বনির্ভর বাংলাদেশ-এর বহুবিধ অনিয়ম ও জালিয়াতির ঘটনা উঠে এসেছে। ২০১৭ সাল থেকে সংস্থাটির মাঠপর্যায়ের সব কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। এমনকি এমআরএ থেকে প্রাপ্ত মূল সনদ, পরিচালনা পর্ষদের সভার কার্যবিবরণীও পরিদর্শনকে দল দেখাতে পারেনি এনজিওটি। হিসাব ও নিরীক্ষা প্রতিবেদন, সাধারণ বাজেট অনুমোদন, নিরীক্ষক নিয়োগ, ভাতা পুনর্নির্ধারণ, রেজিস্টার বই, ক্যাশ ও ব্যাংক বই, সাধারণ খতিয়ান, এফডিআর রেজিস্টার, স্থায়ী সম্পদ রেজিস্টার, অপচয় রেজিস্টার সংরক্ষণের নির্দেশনা থাকলেও পরিদর্শনে গিয়ে এসব নথিপত্র পায়নি পরিদর্শক দল।
স্বনির্ভর বাংলাদেশ-এর পরিচালক এনামুল হক আজকের পত্রিকাকে বলেন, প্রতিষ্ঠানটি ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ীদের ঋণ পেতে সহায়তা করে আসছে। কিন্তু সংগত কারণে কার্যক্রম থেমে গেছে। নতুন করে চালুর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে অর্থছাড়ে নির্দেশনা চাওয়া হয়েছে। অর্থ পেলে গ্রাহকদের সঙ্গে যোগাযোগ হবে। ঋণ আদায় হবে।