Image description
নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের খসড়া আইন

সংসদীয় আসনের সীমানা নির্ধারণে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) একচ্ছত্র ক্ষমতা কমিয়ে ‘বিশেষায়িত কমিটি’ গঠনের সুপারিশ করেছে নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশন। ইসির নেতৃত্বে ওই কমিটিতে থাকবেন নির্বাচন কর্মকর্তা, ভূগোলবিদ, মানচিত্রকার, পরিসংখ্যানবিদ, নগর পরিকল্পনাবিদ এবং জনসংখ্যাবিদ। ছয়টি মানদণ্ডের ভিত্তিতে ওই বিশেষায়িত কমিটি সংসদীয় আসনের সীমানা নির্ধারণ করবে। এক্ষেত্রে ছোট ও বড় জেলা এবং সিটি করপোরেশন এলাকার জন্য পৃথক আসন কোটা নির্ধারণ করা হবে।

এসব বিধান রেখে ‘জাতীয় সংসদের নির্বাচনি এলাকার সীমানা নির্ধারণ’ আইনের খসড়া তৈরি করেছে নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশন। ওই খসড়া পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছে আইন মন্ত্রণালয়। এদিকে আইন সংশোধন চূড়ান্ত না হওয়ায় সীমানা নির্ধারণ কাজে হাত দিতে পারছে না ইসি। বর্তমানে ইসিতে ৪৬টি আসনের সীমানা পরিবর্তন চেয়ে ৩২৩টি আবেদন জমা পড়েছে। সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।

জানা গেছে, গত ১৫ জানুয়ারি সরকারের কাছে জমা দেওয়া সুপারিশে সংসদীয় আসনের সীমানা নির্ধারণে ‘আলাদা স্বাধীন সীমানা নির্ধারণ কর্তৃপক্ষ’ গঠনের কথা বলেছিল নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশন। ওই সুপারিশ ইসির স্বাধীনতা খর্ব করবে বলে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানান প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এএমএম নাসির উদ্দীন। খসড়া আইনে আলাদা কর্তৃপক্ষ গঠনের সুপারিশ থেকে সরে এসেছে নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশন। সেখানে ইসির নেতৃত্বে ‘বিশেষায়িত কমিটি’ গঠনের প্রস্তাব করেছে। যদিও খসড়া এই আইনের কয়েকটি ধারা-উপধারা নিয়ে আপত্তি রয়েছে ইসির কর্মকর্তাদের। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক কর্মকর্তা জানান, বিশেষায়িত কমিটিতে যাদের রাখা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে সেটাও ইসির ক্ষমতা কিছুটা হলেও খর্ব করবে। এছাড়া জেলাভিত্তিক কোটা নির্ধারণ হলে বৈষম্যের অভিযোগ উঠবে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সদস্য ড. মো. আব্দুল আলীম যুগান্তরকে বলেন, আন্তর্জাতিক অনুসরণীয় নীতিমালা অনুসরণ এবং বাংলাদেশের বাস্তবতা বিবেচনায় নিয়ে এই আইনের খসড়া তৈরি করা হয়েছে। ‘বিশেষায়িত কমিটি’র মাধ্যমে সীমানা নির্ধারণের ক্ষেত্রে ইসির ক্ষমতা কমানো হয়নি। উলটো সীমানা নিয়ে তাদের যে দোষারোপ করা হয়, সেটা থেকে বাঁচানো হচ্ছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত, নেপাল ও ভুটানসহ অনেক দেশেই পৃথক কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে সীমানা নির্ধারণ করা হয়। সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে শুধু বাংলাদেশ ও পাকিস্তানে ওই নীতিমালা মানা হয়নি। এজন্য গত কয়েক নির্বাচনে ইসিকে অনেক বদনাম কুড়াতে হয়েছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনের সঙ্গে সংযুক্তি হিসাবে এই আইনের খসড়াও প্রধান উপদেষ্টার কাছে জমা দেওয়া হবে। রাজনৈতিক দলগুলোর মতামতের ভিত্তিতে ওই প্রতিবেদনের সুপারিশ বাস্তবায়নের কথা রয়েছে। এই খসড়া আইন পাশ হলে নতুন পদ্ধতিতে সংসদীয় আসনের সীমানা নির্ধারণ হবে।

জাতীয় সংসদের সাধারণ নির্বাচনের আগে সংসদীয় আসনের সীমানা পুনর্নির্ধারণ করা হয়। আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে ইসি প্রাথমিক কাজগুলো এগিয়ে রাখছে। তবে আইন সংশোধন না হওয়ায় ওই সীমানা নির্ধারণের বাস্তবিক কাজ শুরু করতে পারছে না। এছাড়া ইসিতে যে ৩২৩টি আবেদন জমা পড়েছে, সেগুলোও নিষ্পত্তি করতে পারছে না। ওইসব আবেদনের বেশির ভাগই ২০০১ সালের সীমানায় ফেরত যাওয়ার আবেদন করা হয়েছে।

যে পদ্ধতিতে সীমানা নির্ধারণ : জানা গেছে, খসড়া আইনে ১০টি ধারা প্রস্তাব করা রয়েছে। এতে ছয়টি মানদণ্ডের ভিত্তিতে সংসদীয় আসনের সীমানা নির্ধারণের কথা বলা হয়েছে। সেখানে কম জনসংখ্যার জেলাগুলোতে আসনের কোটা নির্ধারণের কথা বলা হয়েছে। মানদণ্ডগুলো হচ্ছে-প্রশাসনিক সীমানার অখণ্ডতা, নদী ও পাহাড়ের অবস্থানসহ অন্যান্য ভৌগোলিক ও জাতিগত বৈশিষ্ট্য এবং যোগাযোগ সুবিধা যতদূর সম্ভব বজায় রাখা; সর্বশেষ জনশুমারি প্রতিবেদন অনুসরণ করা; পল্লি এলাকার ক্ষেত্রে ইউনিয়ন এবং সিটি করপোরেশন ও পৌরসভার ক্ষেত্রে ওয়ার্ড কোনোভাবেই বিভক্ত করা যাবে না; পার্বত্য তিন জেলায় তিনটি আসন সংরক্ষণ করা; মেহেরপুর, পিরোজপুরসহ ছোট জেলাগুলোর জনসংখ্যা বিবেচনায় নিয়ে একটি আলাদা জনসংখ্যা কোটা নির্ধারণ করা এবং সেখানে জনসংখ্যার ব্যবধান হবে সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ এবং বৃহত্তর জেলার জনসংখ্যা বিবেচনা করে সেখানকার জন্য আলাদা কোটা নির্ধারণ করা।

প্রস্তাবিত আইনে সীমানা নির্ধারণে যেসব অভিযোগ বা আবেদন জমা হবে সেগুলো জেলা পর্যায়ে গিয়ে শুনানি করে নিষ্পত্তির নতুন বিধান যুক্ত করা হয়েছে। বিদ্যমান আইন অনুযায়ী, বিগত নির্বাচন কমিশনগুলো ঢাকায় নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ে বসেই শুনানি নিয়ে নিষ্পত্তি করে আসছে।

এ পদ্ধতিতে সীমানা নির্ধারণ নিয়ে জটিলতা হবে বলে মনে করছেন ইসির কর্মকর্তারা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক কর্মকর্তা জানান, জনসংখ্যার ভিত্তিতে আসন পুনর্বিন্যাস করা হলে ঢাকা, গাজীপুর, চট্টগ্রামসহ গুরুত্বপূর্ণ শহর এলাকায় আসন সংখ্যা বাড়বে, অন্যদিকে গ্রামে কমবে। এতে বৈষম্যের সৃষ্টি হবে। আর জনসংখ্যার সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ ব্যবধানের যে কথা উল্লেখ করা হয়েছে, তা অনুসরণ করা হলে প্রশাসনিক সীমানা ও ভৌগোলিক অক্ষুণ্নতা রক্ষা করা যাবে না। তারা বলেন, এ কারণে নির্বাচন কমিশন সম্প্রতি যে খসড়া আইন তৈরি করেছে, সেখানে জনসংখ্যার পাশাপাশি ভোটার সংখ্যা বিবেচনায় নেওয়ার কথা উল্লেখ করা হয়েছে।

জানতে চাইলে নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের এক সদস্য জানান, আন্তর্জাতিক নীতিমালায় এক আসনের সঙ্গে আরেক আসনের ভোটার সংখ্যার সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ ব্যবধান রাখার সুযোগ রয়েছে। প্রস্তাবিত আইনে আমরা ওই নীতিমালা অনুসরণ করেছি। তারা জানান, এই ধারাটি আবারও পর্যালোচনা করা হচ্ছে। সেখানে ভোটার সংখ্যা যুক্তের চিন্তা করা হচ্ছে। এছাড়া গ্রামের আসন যাতে না কমে, সেজন্য পৃথক কোটা নির্ধারণের কথা বলা হয়েছে।

প্রস্তাবিত আইনেও ৮(৩) উপধারা : বিদ্যমান সীমানা নির্ধারণ আইনের ৮(৩) উপধারা নিয়ে আপত্তি রয়েছে নির্বাচন কমিশনের। নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবিত আইনেও একই বিধান বহাল রাখা হয়েছে। ওই উপধারায় শুধু যেসব এলাকায় প্রশাসনিক পরিবর্তন হয়েছে, সেসব অন্তর্ভুক্ত করে আসনের সীমানা নির্ধারণের কথা বলা হয়েছে। এই উপধারা অনুযায়ী নির্বাচনি এলাকার আয়তন, ভৌগোলিক অখতা, জনসংখ্যা ইত্যাদি বিষয় আমলে নিয়ে সীমানা নির্ধারণের সুযোগ নেই। সংশ্লিষ্টরা জানান, এই উপধারা প্রস্তাবিত আইনের ৬ ধারার সঙ্গে সাংঘর্ষিক।

সম্প্রতি নির্বাচন কমিশনার আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ ওই উপধারা নিয়ে কমিশনের আপত্তির কথা জানান। গত ৩০ জানুয়ারি কমিশনের এক সভা শেষে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, আইনের ‘৮(৩)’ উপধারা একটি টাইপিং মিসটেক আছে বলে আমরা মনে করি। আমরা এটা সংশোধনের জন্য সরকারের কাছে পাঠাব।