দেশের বিদ্যুৎ খাত তিন বছর ধরে নিয়মিত বকেয়া অর্থ পরিশোধের চাপে আছে। অর্থসংকটে থাকায় বিল দিতে পারছে না বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। আবার চাহিদামতো ডলার না পাওয়ায় বিদেশি কোম্পানির বিল পরিশোধ করতে পারছে না সরকার। এরই মধ্যে গত বছরের নভেম্বর পর্যন্ত পিডিবির বকেয়া দাঁড়িয়েছে ৪০ হাজার কোটি টাকার বেশি।
বিদ্যুৎ খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বকেয়া শোধ না হলে জ্বালানি আমদানি করে বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো তাদের উৎপাদন ধরে রাখতে পারবে না। এতে গ্রীষ্মে লোডশেডিং তীব্র হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। তবে, আসছে গ্রীষ্মে বিদ্যুৎ সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে সরকার বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে ডলার ছাড় করে বকেয়া বিল পরিশোধের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান আজ (বুধবার) আসছে রমজানে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সরবরাহ পরিস্থিতি নিয়ে এক আন্তমন্ত্রণালয় সভা শেষে এ বিষয়ে গণমাধ্যমকর্মীদের কাছে বিস্তারিত তুলে ধরবেন।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, পিডিবির বকেয়া ৪০ হাজার কোটি টাকার মধ্যে বিদ্যুৎ কেন্দ্রে ব্যবহৃত গ্যাস বিল বকেয়া জমেছে ১৯ হাজার কোটি টাকার বেশি। আর গ্যাস বিল না দিলে পিডিবিকে গ্যাস সরবরাহ অব্যাহত রাখতে পারবে না বাংলাদেশ তেল, গ্যাস ও খনিজসম্পদ করপোরেশন (পেট্রোবাংলা)। সরকারি-বেসরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো পাবে ২১ হাজার কোটি টাকা। বেসরকারি খাতে বকেয়ার পরিমাণ প্রায় ১৬ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে ফার্নেস তেলভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বকেয়া ১০ হাজার কোটি টাকা। আর অন্যান্য বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বিপরীতে বকেয়া পাঁচ থেকে ৬ হাজার কোটি টাকা। ভারতের আদানির কাছে বকেয়া ৮ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। বর্তমানে চাহিদা কম থাকায় সক্ষমতার অর্ধেক সরবরাহ করছে আদানি। বকেয়া শোধে জুন পর্যন্ত সময় বেঁধে দিয়ে ১৯ জানুয়ারি পিডিবির কাছে আদানি কর্তৃপক্ষের দেওয়া চিঠি পৌঁছেছে।
চিন্তার বিষয় হচ্ছে, বকেয়া শোধ না হলে জ্বালানি আমদানি করে বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো তাদের উৎপাদন ধরে রাখতে পারবে না। বেসরকারি উদ্যোক্তারা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলছেন, বিদ্যুতের বিল সাধারণত ৩০ দিনের মধ্যে পরিশোধের বাধ্যবাধকতা থাকলেও পিডিবি তা মানছে না। এতে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য প্রয়োজনীয় জ্বালানি তেল কেনা যাচ্ছে না। এ ছাড়া ফার্নেস তেল আমদানি করতে সর্বোচ্চ ৪৫ দিন থেকে ৪০ দিন সময় প্রয়োজন হয়। কিন্তু বকেয়া টাকা পাওয়া না গেলে গ্রীষ্মে বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালানো সম্ভব হবে না। এতে গ্রীষ্মে যে সময় বিদ্যুতের চাহিদা বেশি থাকে সে সময় ফার্নেস তেলভিত্তিক কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহ সম্ভব হবে না। ফলে গরমে লোডশেডিং বাড়বে।
তবে গ্রীষ্মে বিদ্যুতের সরবরাহ স্বভাবিক রাখতে সরকার বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে ডলার ছাড় করে বকেয়া বিল পরিশোধের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক আগামী মার্চ মাস থেকে বেসরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর পাশাপাশি ভারত থেকে আমদানি করা বিদ্যুতের বকেয়া পরিশোধে ডলার ছাড়তে রাজি হয়েছে। বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি সীমিত রাখা এবং গ্রীষ্মে বিদ্যুতের বর্ধিত চাহিদা পূরণের জন্য গত ৩ ফেব্রুয়ারি অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক সভায় এ সিদ্ধান্ত হয়েছে। এতে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি উপদেষ্টাও উপস্থিত ছিলেন। সভায় ভারতের আদানি গ্রুপ ও রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান এনপিটিসি বিদ্যুৎ ভেপার নিগাম লিমিটেড ত্রিপুরা থেকে বিদ্যুৎ আমদানি অব্যাহত রাখতে বকেয়া পরিশোধের বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। একই সঙ্গে বেসরকারি বিদ্যুৎ কোম্পানিগুলোর পাওনা ভর্তুকির অর্থ পরিশোধের বিষয়েও গুরুত্ব দিয়ে আলোচনা হয়।
মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, পিডিবি গ্রাহকদের কাছে গড় ৮ টাকা ৯০ পয়সা দামে বিদ্যুৎ বিক্রি করে। কিন্তু পিডিবি বিদ্যুৎ ক্রয় করে ১২-১৩ টাকায়। দামের এই পার্থক্যের কারণে যে ক্ষতি পিডিবি করছে তা পুষিয়ে ওঠার সামর্থ্য নেই। এই অর্থ পিডিবি সরকারের কাছে ভর্তুকি চায়। সরকার ভর্তুকি দিলে পিডিবি তার পাওনা দিতে পারবে। পিডিবির কাছে বকেয়া টাকা দেওয়ার জন্য সরকারকে বলেছি। এই টাকা পেলেই বকেয়া পরিশোধের ব্যবস্থা হবে। বর্তমানে টাকা ছাড়ের প্রক্রিয়া চলছে। এরই মধ্যে তা অর্থবিভাগে আছে।
পিডিবির চেয়ারম্যান মো. রেজাউল করিম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আসছে গ্রীষ্ম এবং সেচ মৌসুমে বিদ্যুৎ পরিস্থিতি নিয়ে সবাই সচেতন। পরিস্থিতি সামাল দিতে গ্যাস সরবরাহ বৃদ্ধির চেষ্টা করব। একই সঙ্গে কয়লা সরবরাহ ঠিক রাখার চেষ্টা করব। পিডিবির অর্থনৈতিক অবস্থা তেমন শক্তিশালী নয়। আমরা এখন চেক অ্যান্ড ব্যালান্স করে কাজ করছি। সরকারের থেকে কিছু পাওনা পাচ্ছি। তবে এই অর্থ আরেকটু বেশি পেলে পরিস্থিতি কিছুটা ভালো থাকত।