Image description
তিন ব্যাংকে আলম আহমেদের ঋণ, ৮৪ কোটি সুদসহ ১৬০ কোটি টাকা , ২৬২ কোটি সুদসহ ৫৫৭ কোটি , ৩০৩ কোটি সুদসহ ৬৩৬ কোটি

হাবিব হোটেল ইন্টারন্যাশনাল ও মরিয়ম কনস্ট্রাকশনের নামে তিন ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছেন আলম আহমেদ। সেই টাকায় রাজধানীর তেজগাঁওয়ে গড়ে তুলেছেন তারকা হোটেল ‘হলিডে ইন’। বছরের পর বছর হোটেল ব্যবসাও করছে, কিন্তু ব্যাংকের ঋণের টাকা পরিশোধ করেননি। তিন ব্যাংকের প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা পরিশোধ না করে পাড়ি জমিয়েছেন বিদেশে। পাওনা টাকা উদ্ধার নিয়ে এখন ব্যাংকগুলো রয়েছে দুশ্চিন্তায়।

জানা যায়, গাজীপুরের কাপাসিয়ার বাসিন্দা আলম আহমেদ মরিয়ম কনস্ট্রাকশন লিমিটেড ও হাবিব হোটেল ইন্টারন্যাশনালের নামে ২০১৬-১৮ সময়ে রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা এবং বেসরকারি ন্যাশনাল ব্যাংক ও ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক থেকে সব মিলিয়ে ৭২৫ কোটি টাকা ঋণ নেন। কিন্তু সেই ঋণের এক টাকাও পরিশোধ করেননি। বরং একাধিকবার ঋণ পুনঃ তফসিল করা হয়েছে। তারপরও সেই ঋণ এখন খেলাপিতে পরিণত হয়েছে। খেলাপি হিসেবে পরিণত হওয়ার পর সুদাসল মিলিয়ে তাঁর কাছে তিন ব্যাংকের পাওনা দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৩৫৩ কোটি টাকা।

ব্যাংকাররা বলছেন, বিগত সময়ে রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে ব্যাংকগুলো থেকে বিশেষ সুবিধার মাধ্যমে এই টাকা নিয়েছেন আলম আহমেদ। ব্যাংকগুলোর একটি সিন্ডিকেট অনৈতিক সুবিধার বিনিময়ে আলমকে এই অর্থ দিয়েছে। অর্থ দেওয়ার সময় তাঁর বন্ধকি সম্পদের মূল্য কত, আসলে এই জমি আছে কি না, তা নিরীক্ষা করা হয়নি।

ব্যাংক কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, আলম আহমেদ জনতা ব্যাংক থেকে ২০১৬ সালের ৪ জানুয়ারি ৩০৩ কোটি টাকা ঋণ নেন। রাজধানীর তেজগাঁওয়ে ৩৩ কাঠা জমির ওপর নির্মিত ‘হলিডে ইন’ হোটেল ও জমি দেখিয়ে হাবিব হোটেল ইন্টারন্যাশনালের নামে ওই ঋণ নেন তিনি। এর পর থেকে গত আট বছরে একটি টাকাও পরিশোধ করেননি। বরং বছরের পর বছর ঋণ পুনঃ তফসিল করা হয়।

ব্যাংকটির ২০২৪ সালের ৩০ সেপ্টেম্বরের আর্থিক প্রতিবেদন অনুসারে এই ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৬৩৬ কোটি টাকা।

ঋণ কেন আদায় হয়নি, জানতে চাওয়া হলে জনতা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মজিবুর রহমান আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘এ বিষয়ে আমার কোনো মন্তব্য নেই। ঋণ নেওয়া হয়েছে জনতা ব্যাংক ভবন শাখা থেকে, শাখার প্রধানেরা ভালো বলতে পারবেন।’

ন্যাশনাল ব্যাংক লিমিটেডের গুলশান শাখা থেকে গাজীপুরের কাপাসিয়ায় ১ হাজার ৯৫০ কাঠা জমি বন্ধক দেখিয়ে ২০১৮ সালের ১৯ মার্চ ২৬২ কোটি টাকা ঋণ নেন আলম আহমেদ। বন্ধকি জমির মূল্য দেখানো হয় ২১৮ কোটি টাকা। সেই ঋণের এক পয়সাও ফেরত দেননি। ফলে সুদসহ ২০২৪ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর সময়ে তাঁর কাছে ব্যাংকটির পাওনা দাঁড়িয়েছে ৫৫৭ কোটি টাকা।

জানতে চাইলে ন্যাশনাল ব্যাংকের গুলশান শাখার প্রধান সাবির আলী মোল্লা আজকের পত্রিকাকে বলেন, মরিয়ম কনস্ট্রাকশনের নামে ২৬২ কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে। এখন মালিকদের পাওয়া যাচ্ছে না। পাওনা আদায়ে কোম্পানির সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হচ্ছে। বিষয়টি বাংলাদেশ ব্যাংককে অবহিত

করা হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক পদক্ষেপ গ্রহণ করছে।

সাবির আলী মোল্লা বলেন, কোম্পানির পক্ষ থেকে যে সম্পদ বন্ধক রাখা হয়েছে, তার বর্তমান মূল্য কত, তা বের করতে ব্যাংকের পক্ষ থেকে নিরীক্ষক নিয়োগ করা হবে। সেখান থেকে তথ্য পেলেই মামলা করা হবে। এ ছাড়া দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) বিষয়টি অনুসন্ধান করছে।

ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের গুলশান শাখা থেকে ২০১৬ সালে ২৪ মার্চ ৮৪ কোটি টাকা ঋণ নেন আলম আহমেদ। গত ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সুদসহ এই ঋণ দাঁড়িয়েছে ১৬০ কোটি টাকায়।

এ বিষয়ে ব্যাংকটির গুলশান শাখার প্রধান খন্দকার শহীদ হাসান আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘জানুয়ারি মাসে ঋণের অর্থ দেওয়ার কথা রয়েছে। এর সময়ের মধ্যে যদি টাকা পরিশোধ না করে তবে পরবর্তী করণীয় ঠিক করা হবে। এর চেয়ে বেশি কিছু বলতে পারব না।’

কেন ঋণ পরিশোধ করা হয়নি—জানতে মরিয়ম কনস্ট্রাকশন ও হাবিব হোটেল ইন্টারন্যাশনালের মালিক আলম আহমেদের সঙ্গে গত ২৪ ডিসেম্বর থেকে ১৬ জানুয়ারি পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। কিন্তু আলম পলাতক রয়েছেন। তাই যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।

পরে যোগাযোগ করা হলে হলিডে ইনের মার্কেটিং কমিউনিকেশন ম্যানেজার মানফুজা মাসুদ চৌধুরী বলেন, ‘হোটেল তৈরি করতে গ্রুপের মালিক কোন ব্যাংক থেকে কত ঋণ নিয়েছেন, সে তথ্য আমাদের কাছে নেই। তিনি কোথায় আছেন, তা-ও জানা নেই।’

হোটেল ব্যবসা কেমন চলছে জানতে চাইলে মানফুজা মাসুদ চৌধুরী বলেন, ‘পরিবর্তিত পরিস্থিতির পর থেকে সারা দেশের অবস্থা ভালো নেই। এই সময়ে আমাদের হোটেলের ব্যবসায়িক অবস্থাও ভালো ছিল না। এখন পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে, ইনকামও বাড়ছে। প্রতিদিন ৪০ থেকে ৪৫ শতাংশ রুম এখন ভাড়া হচ্ছে।’

অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, হাবিব হোটেল ইন্টারন্যাশনাল ও মরিয়ম কনস্ট্রাকশন লিমিটেডসহ বেশ কিছু গ্রুপকে বিগত সরকারের সময় ব্যাংকগুলো অনৈতিক সুবিধা নিয়েছে। এর মাধ্যমে গ্রাহকদের টাকা লোপাট হয়েছে। ব্যাংকগুলো অর্থ সংকটে পড়েছে। ফলে ব্যাংক গ্রাহকদের আমানতের টাকা ফেরত দিতে পারছে না।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান আজকের পত্রিকাকে বলেন, ব্যাংকের ভেতরে ও বাইরে যে অনৈতিক রীতি চলমান রয়েছে, তা বন্ধ করতে হবে। যারা অনিয়ম, লোপাটের সঙ্গে জড়িত, তাদের বিরুদ্ধে দ্রুত শাস্তিযোগ্য ব্যবস্থা নিতে হবে। এ বিষয়ে জানতে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ব্যাংকার ও দালালদের সহযোগিতায় বিগত সময় ব্যাংকিং খাতে অর্থ লোপাট হয়েছে, তারই প্রমাণ জনতা ব্যাংকের ঋণ।