Image description

শীতের শেষ পর্যায়ে রাজধানীতে বাড়তে শুরু করেছে কিউলেক্স মশার উপদ্রব। দিনে কিছুটা কম থাকলেও সন্ধ্যা নামার সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয়ে মশার এই অসহনীয় উপদ্রব, অব্যাহত থাকে সারা রাত। রাজধানীবাসীর অভিযোগ, মশা নিধনে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের বস্তুত কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেই। মাঝেমধ্যে ওষুধ ছিটালেও তা কাজে আসছে না।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, রাজধানীতে পার ম্যান পার আওয়ার উড়ন্ত মশার ঘনত্ব তিন শর বেশি। অর্থাৎ একজন মানুষ যদি কোথাও টানা এক ঘণ্টা অবস্থান করে, তাহলে তাকে গড়ে তিন শ মশা আক্রমণ করছে, যা গত বছরে ছিল গড়ে ২৫-এর নিচে। সে হিসাবে গত বছরের তুলনায় মশা বেড়েছে ১২ গুণ।

রাজধানীতে মশার লার্ভার ঘনত্ব প্রতি ডিপে (ঘনত্বের পরিমাপ) ৮৭-এরও বেশি। অথচ গত বছরে এই সময়ে রাজধানীতে মশার লার্ভার ঘনত্ব প্রতি ডিপে ছিল গড়ে ১২ থেকে ১৭টি। বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন, ঘনত্বটি ফেব্রুয়ারি ও মার্চ মাসে আরো বাড়বে। ফলে দ্রুত নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে তা চরমে পৌঁছতে পারে।

এমন পরিস্থিতিতে সিটি করপোরেশন বলছে, মশার উৎপাত কমাতে নিয়মিত ক্রাশ প্রগ্রাম, লার্ভিসাইড বা কীটনাশক প্রয়োগ, কীটনাশকের গুণাগুণ যাচাই, বিশেষজ্ঞদের দিয়ে কমিটি গঠন, নিয়মিত সভা করাসহ সব প্রচেষ্টা অব্যাহত আছে। কিন্তু এতেও কাজ হচ্ছে না।

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ইমরুল কায়েস চৌধুরী কালের কণ্ঠকে বলেন, শুধু কীটনাশক ছিটিয়ে মশার উপদ্রব নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। আমরা নিয়মিত ক্রাশ প্রগ্রাম, লার্ভিসাইড বা কীটনাশক প্রয়োগ করছি। কিন্তু তা কোনো কাজে আসছে না। কারণ এ শহরে ড্রেন, ডোবা, নর্দমা, বিল, ঝিল ও খালে পানির প্রবাহ নেই। এসব স্থানে দীর্ঘদিন ধরে মানুষ ময়লা-আবর্জনা ফেলছে। এতে পানির ঘনত্ব বেড়ে মশা প্রজননের উপযোগী পরিবেশ তৈরি হয়েছে।

তিনি বলেন, মশা নিয়ন্ত্রণে অনেক ধরনের কমিটি হয়েছে। কারিগরি কমিটি, স্পেশাল টাস্কফোর্স কমিটি, ওয়ার্কিং কমিটি, ওয়ার্ড লেভেল কমিটি, এখন আবার নতুন কীটনাশকের গুণাগুণ যাচাইয়ের জন্য কমিটি। এসব কমিটিতে বিশেষজ্ঞরা রয়েছেন। কিন্তু মশা নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছে না। কারণ আমাদের শহর একটি অপরিচ্ছন্ন শহর। ড্রেন, ডোবা, নর্দমা, বিল, ঝিল ও খালে ময়লার স্তূপ, যা পরিষ্কার করে পানির প্রবাহ তৈরি করা সম্ভব হচ্ছে না।

 

কীটনাশকেও কমছে না মশা

রাজধানীর বাংলামোটর এলাকার বাসিন্দা খালিদ হোসেন। একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন তিনি। স্থানীয় দোকান থেকে মশার কয়েল কেনার সময় উপস্থিত অন্যদের সঙ্গে আলাপ করছিলেন। আলোচনার বিষয় মশার যন্ত্রণা। সবার কথায় একটা বিষয়ই উঠে আসেরাজধানীতে মশার উপদ্রব অনেক বেড়েছে। কোনোভাবেই এ থেকে মুক্তি পাওয়া যাচ্ছে না।

মিরপুর-১০ এলাকার চা দোকানি নাজমুল ইসলাম বলেন, যতক্ষণ দোকানদারি করি সারাক্ষণ কয়েল জ্বালিয়ে রাখি। কিন্তু এতেও কাজ হয় না। রাতে বাসায় ফিরে গেলে সেখানেও শান্তি নাই। ঘরে-বাইরে মশার উৎপাতে টেকা কঠিন। পাঁচ মিনিট দাঁড়িয়ে দেখেন, চা খেতে খেতে সবাই অন্য কথা বলার চেয়ে মশার আলাপই করছে বেশি।

বনানীর বাসিন্দা রকিব হোসেন বলেন, স্থির হয়ে কোথাও বসা বা কিছুই করা যায় না। মশা কামড়াতেই থাকে। আগের চেয়ে মশার উৎপাত কয়েক গুণ বেড়েছে। সিটি করপোরেশন থেকে মাঝেমধ্যে কীটনাশক ছিটাতে আসে। এতেও এক দিনের বেশি মশার উৎপাত কমে না।

গত কয়েক দিন রাজধানীর বাংলামোটর, হাতিরঝিল, ধানমণ্ডি, মোহাম্মদপুর, আগারগাঁও, মিরপুর, বনানী ও উত্তরা ঘুরে বিভিন্ন পেশার মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দিনরাত সারাক্ষণ মশারি নয়তো মশার কয়েল জ্বালিয়ে রাখতে হয়। কিন্তু এতেও কাজ হচ্ছে না। রাজধানীবাসীর অভিযোগ, সিটি করপোরেশন মশক নিধনে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না। আবার মশা নিধনের কীটনাশকের গুণাগুণ নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন তারা।

হুমকিতে জনস্বাস্থ্য

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণাপ্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, রাজধানীর বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সঠিক না হওয়ায় কীটপতঙ্গ বাড়ছে। বিশেষ করে মশা। শহরের পরিবেশ পরিচ্ছন্ন রাখার প্রধান দায়িত্ব সরকার ও নগর কর্তৃপক্ষের। দ্বিতীয় পর্যায়ে কমিউনিটি, তৃতীয় পর্যায়ে ব্যক্তিগত ও পারিবারিক। আমরা শুধু ব্যক্তি ও পরিবারের ঘাড়ে দায় চাপিয়ে দায়িত্ব এড়াতে চাই। কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে এটা একটা সমন্বিত পরিকল্পনার বিষয়, যা সরকার ছাড়া সম্ভব না।

তিনি বলেন, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ছাড়া মশা নিয়ন্ত্রণ কখনো সম্ভব না। শহরকে যদি আমরা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন না রাখি এবং বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ঠিক না করিমশা, তেলাপোকা, ইঁদুর এ ধরনের কীটপতঙ্গ বাড়তে থাকবে। আর সেটা দিন দিন বাড়ছেও। এ জন্য আবাসস্থল, পাবলিক স্পেস, ড্রেন, নর্দমা নিয়মিত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা জরুরি। এখানে নাগরিকদেরও দায়িত্ব রয়েছে। তাদের যথাযথ স্থানে ময়লা ফেলতে হবে।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা (অতিরিক্ত দায়িত্ব) ডা. নিশাত পারভীন কালের কণ্ঠকে বলেন, রাজধানীতে কিউলেক্স মশা বেড়েছে। কিভাবে এই মশা কমিয়ে আনা যায় সে বিষয়ে আমাদের চেষ্টা অব্যাহত আছে। আমরা তারুণ্য উৎসবের অধীনে সপ্তাহব্যাপী ক্র্যাশ প্রগ্রাম চালাচ্ছি। এর মাধ্যমে ড্রেন, ডোবা, নর্দমা পরিষ্কার-পরিচ্ছন করা হচ্ছে। আশা করি সামনে মশার উপদ্রব কমে আসবে।