শীতকালীন সবজি ও ফসল উৎপাদনে খ্যাতি ছিল উত্তরের দুই জেলা লালমনিরহাট ও নীলফামারীর। কয়েক বছরের ব্যবধানে এ দুই জেলার আলু, গম, সরিষা আবাদি জমিতে বেড়েছে তামাকের চাষ। কুষ্টিয়ার পরই দেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ তামাক উৎপাদনকারী জেলা এখন লালমনিরহাট। বিনামূল্যে বীজ, সার, কীটনাশক সুবিধা দেওয়ার পাশাপাশি ভালো দাম ও সুদমুক্ত ঋণসুবিধার কারণে উত্তরের জেলায় বাড়ছে তামাকের চাষ।
দেশের প্রান্তিক পর্যায়ে কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে বিভিন্ন সচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করেও কৃষকদের তামাক চাষ থেকে বিরত রাখা যাচ্ছে না। অন্যদিকে কার্যকর কোনো বিধি-নিষেধ না থাকায় তামাক কম্পানিগুলোর বিরুদ্ধেও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া যাচ্ছে না। অথচ দেশে তামাকের ব্যবহার শূন্যে নামিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে।
লালমনিরহাটের বড়বাড়ি ইউনিয়নের কৃষক মিজানুর রহমান এ বছর এক একর জমিতে করেছেন তামাকের চাষ। তিনি একটি বহুজাতিক কম্পানির সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়ে তামাক চাষ করেছেন। গত বছরের নভেম্বর মাসের শুরুতে তিনি পেয়েছেন বীজ। ধাপে ধাপে পেয়েছেন সার ও টাকা।
তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, তামাকে লাভ বেশি। ধানের মণ সর্বোচ্চ এক হাজার ৫০০ টাকা। আগের বছর তামাকের মণ বিক্রি করেছি আট হাজার টাকা। তামাকে কম্পানি বীজ, সার ও টাকা দেয়। তাই তামাক চাষ করি। একই কারণে একই গ্রামের আরেক কৃষক জোবেদ আলীও তামাক চাষ বাড়িয়েছেন।
বিবিএস তথ্যমতে, গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে দেশে ৯৩ হাজার ১০৭ একর জমিতে তামাকের উৎপাদন ছিল ৮৬ হাজার ৫৮৩ টন। কিন্তু সদ্যঃসমাপ্ত ২০২৩-২৪ অর্থবছরে এক লাখ এক হাজার ১০০ একর জমিতে উৎপাদন দাঁড়িয়েছে ৯৭ হাজার ৮১৪ টন। ফলে এক অর্থবছরের ব্যবধানে দেশে আবাদ বেড়েছে প্রায় ৯ শতাংশ। অন্যদিকে উৎপাদন বেড়েছে প্রায় ১৩ শতাংশ।
বিবিএসের ইয়ারবুক অব অ্যাগ্রিকালচারাল স্ট্যাটিস্টিকসের তথ্যমতে, দেশে সবচেয়ে বেশি তামাক উৎপাদনকারী জেলা কুষ্টিয়া। এ জেলাটি থেকেই আসছে দেশের মোট উৎপাদনের প্রায় ৪০ শতাংশ। অন্যদিকে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ অবস্থানে রয়েছে লালমনিরহাট। এ জেলায় উৎপাদন হচ্ছে দেশের মোট উৎপাদনের প্রায় ১৬ শতাংশ। তৃতীয় স্থানে রয়েছে মেহেরপুর জেলা। তামাক উৎপাদনে একসময় পাহাড়ি অঞ্চল এগিয়ে থাকলেও এখন সেটির আবাদ সম্প্রসারিত হচ্ছে দেশের বিভিন্ন জেলায়। বিশেষ করে উত্তরের তিন জেলায়।
তামাকবিরোধী জোট অ্যান্টি টোব্যাকো মিডিয়া অ্যালায়েন্সের সদস্য খোরশেদ আলম কালের কণ্ঠকে বলেন, উত্তরের জেলাগুলোতে তামাক চাষের কাগজে-কলমের তথ্যের চেয়ে প্রকৃত তথ্য আরো ভয়াবহ। এ অঞ্চলে সাতটি তামাক কম্পানির প্রতিনিধিরা মাঠ পর্যায়ে নিবিড়ভাবে কাজ করছেন। মৌসুমে প্রতিটি কম্পানির ৭০ লাখ থেকে এক কোটি কেজি তামাক কেনার লক্ষ্যমাত্রা থাকে। এই পরিস্থিতি চলতে থাকলে উত্তরের কৃষি ধ্বংস হবে অনিবার্য।
ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন টোব্যাকো কন্ট্রোল (এফসিটিসি) তথ্য অনুসারে, তামাক ব্যবহারজনিত রোগে বাংলাদেশে প্রতিবছর দেড় লাখের বেশি মানুষ অকাল মৃত্যুবরণ করছে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে তামাক ব্যবহার হার সবচেয়ে বেশি (৩৫.৩%) বাংলাদেশে। তা ছাড়া দেশে প্রতিনিয়ত প্রায় চার কোটি মানুষ ধূমপান না করেও বিভিন্ন পাবলিক প্লেস ও পাবলিক পরিবহনে পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হচ্ছেন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কঠোর তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন প্রণয়ন এবং তার প্রয়োগের মাধ্যমে তামাকের ব্যবহার হ্রাস করা সম্ভব। এটিই এখন পর্যন্ত বিশ্বব্যাপী একটি স্বীকৃত পদ্ধতি।
গত বৃহস্পতিবার একটি সেমিনারে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আখতার বলেছেন, তামাকজনিত রোগে মৃত্যু সাধারণ নয়, বরং তা হত্যাকাণ্ড।
উত্তরে তামাক চাষ সম্প্রসারণ বিষয়ে লালমনিরহাট কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের শস্য বিভাগের উপপরিচালক সৈয়দা সিফাত জাহান কালের কণ্ঠকে বলেন, কৃষকরা পণ্যটি বিক্রির নিশ্চয়তা পাচ্ছে। এছাড়া কম্পানি থেকে বীজ সার সবকিছুই পাচ্ছে। আমরা কৃষকদের সচেতন করার চেষ্টা করছি। তামাকের ক্ষতির দিকগুলো সরেজমিন দেখাচ্ছি।