Image description

ঢাকার বিভিন্ন বস্তি এবং জেনেভা ক্যাম্প অপরাধী তৈরির আখড়ায় পরিণত হয়েছে। নানা অপরাধ কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি এসব জায়গায় প্রতিনিয়ত তৈরি হচ্ছে নতুন নতুন অপরাধচক্র। ঘিঞ্জি পরিবেশ আর ভাসমান লোকজনের বসবাসের কারণে বস্তি এলাকাগুলো মনিটরিংয়ে রাখতে পারছে না আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এই সুবাদে দাগি অপরাধীরাও এসে গা-ঢাকা দেয় ঢাকার বিভিন্ন বস্তিতে। আর তাদের সংস্পর্শে বস্তির নিম্ন আয়ের মানুষের অনেকেই জড়িয়ে পড়েন বিভিন্ন অপকর্মে।

রাত সাড়ে ১০টা। দারুসসালাম থানাধীন বুদ্ধিজীবী সিটি কলোনির একটি কাঠের দোকানের সামনে বসেছিলেন মিলন, সুজন ও সোহান। এমন সময় বস্তিকেন্দ্রিক কিশোর গ্যাং ‘উরাধুরা’ গ্রুপের একটি সশস্ত্র দল তাদের ওপর হামলা চালায়। এলোপাতাড়ি আঘাতে ঘটনাস্থলেই মারা যান মিলন। সুজন ও সোহানকে গুরুতর অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এ ঘটনায় মিলনের মা দারুসসালাম থানায় মামলা করেন। সূত্র জানিয়েছে, একটি ছিনতাইয়ের ঘটনার প্রতিবাদ করায় মিলনকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। উরাধুরা গ্রুপের সদস্যরা অধিকাংশই ভাসমান ও বস্তির নিম্ন আয়ের পরিবারের সদস্য। বুধবার মিরপুরের বুদ্ধিজীবী কবরস্থান ও আশপাশ এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এই গ্যাংয়ের সদস্যরা এলাকায় মাদক ব্যবসা, ছিনতাইসহ বিভিন্ন অপকর্ম চালিয়ে আসছে। তবে দারুসসালাম থানা পুলিশ বলছে, চক্রের ৫ সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়েছে।

মঙ্গলবার যাত্রাবাড়ীর দনিয়া কলেজের সামনে কিশোর গ্যাংয়ের এলোপাতাড়ি হামলায় নিহত হয়েছেন মিনহাজুর রহমান নামে এক প্রকৌশলী। ওই গ্যাংয়ের সদস্যরা স্থানীয় বস্তিতে বাস করে বলে জানা গেছে।

মোহাম্মদপুরের জেনেভা ক্যাম্প। ৯টি সেক্টর আর ৩০টি সরু গলিতে বিভক্ত। এখানে ৫০ হাজারের বেশি লোক বাস করেন। দেড় হাজারের বেশি অপরাধী রয়েছে। সশস্ত্র সন্ত্রাসীর সংখ্যা প্রায় ৩শ। ‘অপরাধের বিষফোড়া’ আখ্যায়িত জেনেভা ক্যাম্প এতটাই ঝুঁকিপূর্ণ যে, এখানে অভিযান চালাতে ভয় পায় পুলিশ। এই ক্যাম্পে মাদক ব্যবসায়ীরা সব ধরনের মাদকের পসরা সাজিয়ে বসেন। সেবনও চলে নির্বিঘ্নে। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর থানা থেকে লুট করা অস্ত্র দিয়ে নিজেদের ক্ষমতার জানান দিতে সংঘাতে জড়ায় বস্তির একাধিক গ্রুপ। তাদের হানাহানিতে লাশ পড়ে জেনেভা ক্যাম্পের ৬ জনের। আহত হন দুই শতাধিক। পরে যৌথবাহিনী অভিযান চালিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। আগে জেনেভা ক্যাম্পের নিয়ন্ত্রণ করত পঁচিশ ও ইশতিয়াক। তাদের মৃত্যুর পর শীর্ষ মাদক কারবারি বুনিয়া সোহেল ও তার গ্রুপের টুনটুন, রানা, রাজন ওরফে কালু, কলিম জাম্বু, মোহাম্মদ আলী, আহম্মদ আলী ও বানর আরিফ, চুয়া সেলিম গ্রুপের আরমান, কোপ মনু, আকরাম, গইল হীরা, উলটা সালাম, শান্ত, পিচ্চি রাজা, ফাট্টা আবিদ, পিস্তল নাঈম ও শাহজাদাসহ অন্যরা মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে।

ক্যাম্পে আটকে পড়া পাকিস্তানিদের সংগঠন স্ট্র্যান্ডেড পিপলস জেনারেল রিহ্যাবিলিটেশন কমিটি-এসপিজিআরসির আহ্বায়ক এম শওকত আলী যুগান্তরকে বলেন, মূলত মাদক ব্যবসার আধিপত্যকে কেন্দ্র করেই ক্যাম্পে সহিংসতা হচ্ছিল। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাঁড়াশি অভিযানে পরিস্থিতি এখন স্বাভাবিক। তবে এখনো বন্ধ হয়নি মাদক বিক্রি।

বনানীর কড়াইল বস্তির বাসিন্দা রোকেয়া বেগম কাজ করেন বাসাবাড়িতে। তিনি জানান, বস্তিতে থাকলেও সংসার সুখেরই ছিল। স্বামী রিকশা চালাত। কিন্তু মাদকের নেশায় জড়িয়ে স্বামী জলিল এক পর্যায়ে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে। সে বস্তি থেকে চলে যায়। এখন দুই সন্তান নিয়ে তিনি জীবন-যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছেন। রোকেয়া বেগম বলেন, বস্তির নারীদের বড় দুঃখ তাদের স্বামীদের নেশাপানি। যা আয় হয়, তা স্বামীরা মাদক সেবনে উড়িয়ে দেয়।

দেশে সর্বশেষ ২০১৪ সালে বস্তিশুমারি হয়। শুমারি অনুযায়ী ঢাকার দুই সিটিতে বস্তি রয়েছে ৩ হাজার ৩৯৪টি।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একাধিক সূত্রে জানা গেছে, দেশের বিভিন্ন এলাকার দুর্ধর্ষ অপরাধী এমনকি বিভিন্ন চাঞ্চল্যকর মামলার সাজাপ্রাপ্ত আসামিও গ্রেফতার এড়াতে ছদ্মবেশে বিভিন্ন বস্তির বাসাবাড়িতে আশ্রয় নেয়। এরা নিজেদের নাম-পরিচয় পালটে নকল জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরি করে।

ডিএমপির এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা যুগান্তরকে জানিয়েছেন, ভাসমান অপরাধীরা কম ধরা পড়ায় এদের ডাটাবেজের অন্তর্ভুক্ত করা যাচ্ছে না। এরা কোনো এলাকায় অপরাধ করার পর সেই এলাকা থেকে দ্রুত সরে পড়ে। আবার অন্য এলাকায় গিয়ে অপরাধকর্ম করে। যে কারণে তাদের শনাক্ত করা দুরূহ হয়ে পড়ে। তা ছাড়া এসব অপরাধীর কেউ কেউ নকল জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরি করছে। এসব পরিচয়পত্র দিয়ে তারা সিমকার্ড কিনছে। কোনো অপরাধ ঘটানোর পর তারা সেই সিমকার্ডটি ফেলে দিয়ে আবার নতুন সিমকার্ড নিচ্ছে। ভুল তথ্যের কারণে তাদের আইনের আওতায় আনতেও বেগ পেতে হয়। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের জনসংযোগ বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার মুহাম্মদ তালেবুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, প্রতিনিয়ত অপরাধীদের আইনের আওতায় আনা হচ্ছে। সব ধরনের অপরাধীদের আইনের আওতায় আনার সক্ষমতাও রয়েছে পুলিশের। তবে ভাসমান অপরাধীদের ক্ষেত্রে একটু বেগ পেতে হয়। তিনি জানান, যেসব অপরাধী ধরা পড়ে তাদের নাম-ঠিকানা-পরিচয় এবং অপরাধের ধরন ডাটাবেজে লিপিবদ্ধ করা হয়। অপরাধের ধরন, মামলাসহ বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত ডাটাবেজে লিপিবদ্ধ থাকে।

অপরাধ বিশ্লেষক মো. সাখাওয়াত হোসেন যুগান্তরকে বলেন, বস্তিগুলোতে অপরাধীরা পরিচয় গোপন করে অবস্থান করার সুযোগ পাচ্ছে। পরিসংখ্যান না থাকলেও এ সংখ্যা একেবারে কম নয় বলে মনে করেন তিনি। তার মতে, ঢাকায় প্রতিদিন কত সংখ্যক লোক ঢুকছে কিংবা বেরিয়ে যাচ্ছে, সেই বিষয়ে যদি কোনো সংস্থা তদারকি করত তবে অপরাধীদের মাঝে একটা ভয় কাজ করত। পরিচয় গোপন করে তারা এভাবে বস্তিতে অবস্থান করে অপরাধ করার সাহস পেত না। সমাজবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. নেহাল করিম বলেন, অপরাধ নির্মূল করতে হলে আগে আইনের শাসন বাস্তবায়ন করতে হবে। সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। নতুবা অপরাধ নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব নয়। তিনি বলেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে না থাকার কারণে নিত্যনতুন অপরাধ ঘটছে। পেশাদার অপরাধীদের পাশাপাশি কেউ কেউ অভাবের কারণেও চুরি-ছিনতাইয়ের মতো অপরাধে জড়াচ্ছে।