গণ-অভ্যুত্থানে স্বৈরাচারী হাসিনার পতনের মাধ্যমে অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই বিভিন্ন ইস্যুতে ঢাকা-দিল্লি সম্পর্কে টানাপড়েন চলে আসছে। তবে দিল্লির সাথে সম্পর্ক শীতল হলেও বেইজিংয়ের সাথে সম্পর্কে গতি পাচ্ছে ঢাকা। ইতোমধ্যে এই সম্পর্ক অনন্য উচ্চতায় পৌঁছেছে।
বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সব সময়ই দ্বিপক্ষীয় প্রথম সফরে পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা দিল্লি যেতেন। প্রতিবেশী দেশ ও রাজনৈতিক কারণে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এমনকি প্রধানমন্ত্রীর প্রথম দ্বিপক্ষীয় সফর হতো দিল্লিতে। তবে অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে এবার ব্যতিক্রম দেখা গেল। অন্তর্বর্তী সরকারের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা এম তৌহিদ হোসেন এবার প্রথম দ্বিপক্ষীয় সফরে বেইজিং গিয়েছিলেন। আর এই সফরের মধ্যে দিয়ে দীর্ঘ দিনের বাংলাদেশের দীর্ঘ দিনের প্রচলিত কূটনৈতিক ধারা ভেঙে দিল্লিকে একটি বার্তাও দেয়া হলো যে, ঢাকা এখন বেইজিংকেই প্রাধান্য দিচ্ছে।
বাংলাদেশের অনেক রোগীই ভারতে চিকিৎসা নিয়ে থাকেন। অন্যান্য দেশের তুলনায় খরচ কম ও যাতায়াতে সহজ হওয়ার জন্যই প্রচুর বাংলাদেশি চিকিৎসার জন্য ভারতকেই বেছে নেন। তবে ৫ আগস্টের পট পরিবর্তনের পর ভারতে বাংলাদেশিদের ভিসা জটিলতা বেড়েছে। যদিও বাংলাদেশিদের জরুরি মেডিকেল ভিসা চালু রেখেছে ভারত। তবে বাংলাদেশিদের চিকিৎসার জন্য ভারতের বিকল্প হিসেবে চীনকে প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। বিশেষ করে চীনের কুনমিংয়ে যেন বাংলাদেশিরা সহজেই চিকিৎসা নিতে পারেন, সেই প্রস্তাব দিয়েছে বাংলাদেশ। এই উদ্যোগ সফল হলে বাংলাদেশিরা চীনে সহজেই চিকিৎসা নিতে পারবেন।
অন্যদিকে, রোহিঙ্গা ইস্যুতে দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে মধ্যস্থতা করছে চীন। যদিও রোহিঙ্গা সঙ্কটের সমাধান এখনো হয়নি। তবে রোহিঙ্গা ইস্যুতে এখনো চীনের ওপর ভরসা করে আছে বাংলাদেশ। আশা করা হচ্ছে, চীনের সহযোগিতা পেলে রোহিঙ্গা ইস্যুতেও সাফল্য আসবে।
বাংলাদেশ চীনের কাছ থেকে নেয়া ঋণের সুদের হার কমানোর প্রস্তাব করেছে। চীনা ঋণ ২-৩ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১ শতাংশে নামিয়ে আনার প্রস্তাব দিয়েছে। এছাড়া সব ধরনের ঋণ পরিশোধের সময়সীমা ২০ থেকে বাড়িয়ে ৩০ বছর মেয়াদি করার জন্য যে অনুরোধ চীনকে করা হয়েছে। এ বিষয়ে চীন বাংলাদেশকে আশ্বস্ত করেছে। বাংলাদেশের এই প্রস্তাবে চীন রাজি হলে দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক আরো জোরদার হবে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন।
চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের বৈশ্বিক তিনটি উদ্যোগ রয়েছে। এগুলো হলোÑ গ্লোবাল ডেভেলপমেন্ট ইনিশিয়েটিভ (জিডিআই), গ্লোবাল সিকিউরিটি ইনিশিয়েটিভ (জিএসআই), গ্লোবাল সিভিলাইজেশন ইনিশিয়েটিভ (জিসিআই)। এই তিনটি উদ্যোগে যোগ দিতে বাংলাদেশকে অনেক আগেই প্রস্তাব দিয়েছে চীন। তবে বাংলাদেশ এখনো এসব উদ্যোগে যোগ দেয়নি। পররাষ্ট্র উপদেষ্টা এম তৌহিদ হোসেনের বেইজিং সফরে আবারো চীন এই প্রস্তাব দিয়েছে। তবে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেছেন, প্রস্তাবগুলো আরো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখবে বাংলাদেশ, তারপর সিদ্ধান্ত নেবে।
পররাষ্ট্র উপদেষ্টা এম তৌহিদ হোসেন চীন সফরকালে বলেছেন, এ বছর বাংলাদেশ ও চীনের ৫০তম কূটনৈতিক সম্পর্কের বার্ষিকী। এই সময়ে দুই দেশের সম্পর্ক আরো গভীর হবে, ঘনিষ্ঠ হবে। এই সময়ে আমাদের অর্থনৈতিক ও অন্যান্য ক্ষেত্রে বিনিময় বাড়বে। এছাড়া সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রেও আমাদের আরো ঘনিষ্ঠ বিনিময় হবে। তবে এর আগে উপদেষ্টা চীন ও ভারত প্রশ্নে ভারসাম্যের কূটনীতির কথাও বলেছেন। তিনি বলেছেন, চীন, ভারত যুক্তরাষ্ট্রের মতো বড় শক্তিগুলোর সঙ্গে ভারসাম্য বজায় রেখেই এগিয়ে যেতে চায় বাংলাদেশ।
চীনে নিযুক্ত বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত মুন্সী ফয়েজ আহমেদ বলেন, বাংলাদেশের নতুন প্রেক্ষাপটে পররাষ্ট্র উপদেষ্টার এবারের চীন সফর বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। ব্যবসা-বাণিজ্য, রাজনীতি ও কূটনৈতিকসহ নানা কারণে চীন বাংলাদেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার। আবার ভারত আমাদের প্রতিবেশী দেশ। চীন ও ভারত উভয় দেশের সাথেই আমাদের ভালো সম্পর্ক রাখা প্রয়োজন।
গত ২০-২৪ জানুয়ারি চীন সফর করেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা। সফরকালে ২১ জানুয়ারি চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং আইয়ের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে করেন। একই সাথে বেইজিং ছাড়াও সাংহাই সফর করেন উপদেষ্টা। এ সফরের মধ্যে দিয়ে ঢাকা-বেইজিং সম্পর্কে নতুন মাত্রা যুক্ত হয়। কূটনৈতিক বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, বাংলাদেশ ও চীনের ৫০তম সম্পর্কের বার্ষিকীকে সামনে রেখে দুই দেশের সম্পর্ক আরো দৃঢ় হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। ইতোমধ্যে চীন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে আমন্ত্রণ জানিয়েছে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি প্রফেসর প্রফেসর ড. এ এস এম আমানুল্লাহ বলেন, আমি মনে করি চীনের আমন্ত্রণে প্রধান উপদেষ্টার সাড়া দেয়া উচিত। চীন আমাদের উন্নয়নের সহযোগী। ড. ইউনূস চীন সফরে গেলে নিশ্চয় বিনিয়োগ নিয়ে কথা হবে। তাতে আমাদের অনেক লাভ হবে। একই সাথে দুদেশের মধ্যে সম্পর্ক আরো গভীর হবে।