ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কয়েকজন সম্ভাব্য প্রার্থী নির্বাচনি ব্যয় মেটাতে জনসাধারণের কাছ থেকে ক্রাউড ফান্ডিং বা গণ-তহবিল সংগ্রহ করছেন। এ তালিকায় রয়েছেন কয়েকজন স্বতন্ত্র প্রার্থীও। ভোটের মাঠের পাশাপাশি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করেও তারা এই তহবিল তুলছেন।
এই ক্রাউড ফান্ডিংকে কেন্দ্র করে সাধারণ ভোটারদের মধ্যেও বেশ কৌতূহল দেখা যাচ্ছে। বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রার্থীদের দেওয়া আহ্বান, অর্থ সংগ্রহের স্বচ্ছতা ও ব্যয়ের হিসাব দেওয়ার প্রতিশ্রুতি অনেককে আকৃষ্ট করছে। একইসঙ্গে সাধারণ মানুষের মাঝে প্রশ্ন উঠেছে—জনগণের কাছ থেকে এভাবে টাকা নেওয়া বা ক্রাউড ফান্ডিং করা আইনসংগত কিনা বা নির্বাচন কমিশনের আইনের লঙ্ঘন কিনা। তবে ইসি বলছে, নির্বাচনি আইনে ক্রাউড ফান্ডিং অবৈধ নয়। কিন্তু সেক্ষেত্রে কতিপয় বিধি মনে চলতে হবে প্রার্থীকে।
ক্রাউড ফান্ডিং কী
অক্সফোর্ড ডিকশনারি অনুযায়ী, ক্রাউড ফান্ডিং হলো কোনও প্রকল্প বা কার্যক্রমের জন্য অনেক মানুষের কাছ থেকে অল্প অল্প পরিমাণ অর্থ সংগ্রহের একটি পদ্ধতি। সাধারণত ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহার করে এই অর্থ সংগ্রহ করা হয়।
এবারের নির্বাচনে যারা ক্রাউড ফান্ডিং করছেন
বাংলাদেশের নির্বাচনি রাজনীতিতে ক্রাউড ফান্ডিং তুলনামূলক নতুন হলেও এতে সাড়া পাচ্ছেন অনেকেই। সম্প্রতি, জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সিনিয়র যুগ্ম সদস্য সচিব (সদ্য পদত্যাগ করা) ডা. তাসনিম জারা এবং যুগ্ম আহ্বায়ক (সদ্য পদত্যাগ করা) ডা. তাজনূভা জাবীন ও দিলশানা পারুল নির্বাচনি ব্যয় মেটাতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ক্রাউড ফান্ডিং করেন।
একইভাবে, আমজনতার দলের সাধারণ সম্পাদক তারেক রহমানও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিকাশ ও নগদ নম্বরসহ ব্যাংক অ্যাকাউন্ট প্রকাশ করে দলের সমর্থকদের কাছে আর্থিক সহায়তার আহ্বান জানান।
ঢাকা–৮ আসন থেকে নির্বাচনে আগ্রহী ওসমান হাদিও তার ফেসবুক পেজ থেকে নির্বাচনি ক্যাম্পেইনের জন্য ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ও নগদ/বিকাশ/রকেট নম্বর উল্লেখ করে আর্থিক সহায়তা চেয়েছিলেন। তিনি লিখেছিলেন, ‘যারা আমার ইলেকশন ক্যাম্পেইনে আর্থিকভাবে সহযোগিতা করতে চান, তারা উল্লেখিত অ্যাকাউন্টে পাঠাতে পারেন। নির্বাচন শেষে সকল স্টেটমেন্ট আমরা পাবলিকলি প্রকাশ করবো, ইনশাআল্লাহ।’
তবে গত ১২ ডিসেম্বর দুপুরে রাজধানীর বিজয়নগর বক্স কালভার্ট রোডে মোটরসাইকেলে আসা দুই ব্যক্তির গুলিতে আহত হন ওসমান হাদি। গুরুতর অবস্থায় তাকে প্রথমে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে একটি অস্ত্রোপচারের পর তাকে এভারকেয়ার হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। পরে উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে সিঙ্গাপুরে পাঠানো হয়। ১৮ ডিসেম্বর রাত সাড়ে ৯টার দিকে সিঙ্গাপুর জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান।
এনসিপির সদ্য পদত্যাগ করা নেতা তাসনিম জারা ফেসবুকে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ও বিকাশ নম্বর দিয়ে লেখেন, “I need your help… নির্বাচনে একজন প্রার্থী আইনগতভাবে সর্বোচ্চ ২৫ লাখ বা ভোটার প্রতি ১০ টাকা খরচ করতে পারেন। কিন্তু বাস্তবে শোনা যায়, একজন প্রার্থী ২০ থেকে ৫০ কোটি টাকা খরচ করেন। অথচ নির্বাচন কমিশনের কাছে গিয়ে বলেন, মাত্র ২৫ লাখ টাকা ব্যয় করেছেন। ফলে সংসদে যাওয়ার যাত্রা শুরু হয় আইন ভাঙা ও মিথ্যা বলার মাধ্যমে। আমি এই অসততা ও মিথ্যার রাজনীতি করবো না।”
তিনি জানান, তার আসনে ভোটার সংখ্যা প্রায় ৪ লাখ ৭০ হাজার এবং নির্বাচন কমিশনের নিয়ম অনুযায়ী তিনি সর্বোচ্চ ৪৬ লাখ ৯৩ হাজার ৫৮০ টাকা ব্যয় করতে পারবেন। এই অর্থ জনগণের কাছ থেকেই সংগ্রহ করতে চান তিনি।
পরে দল থেকে পদত্যাগ করে স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার ঘোষণা দেন তাসনিম জারা। সে সময় তিনি জানান, যারা তাকে নির্বাচনের জন্য বিকাশের মাধ্যমে অর্থ পাঠিয়েছেন, তারা চাইলে টাকা ফেরত পাবেন। এজন্য একটি ফরম পূরণ করতে হবে বলেও তিনি তার পোস্টে উল্লেখ করেন।
এনসিপি থেকে সদ্য পদত্যাগ করা আরেক নেত্রী তাজনূভা জাবীন ফেসবুক স্ট্যাটাসে নির্বাচনি খরচ চেয়ে লেখেন, “আমার জন্য নির্বাচন কমিশন কর্তৃক নির্ধারিত খরচের পরিমাণ ৩৩ লাখ টাকা। আপনাদের টাকাতেই আমরা নির্বাচন করব। আপনাদের কাছেই প্রত্যেকটা পয়সার কৈফিয়ত দেবো।”
তিনিও পরদিন দল থেকে পদত্যাগের ঘোষণা দেন। ভেরিফায়েড ফেসবুক অ্যাকাউন্টে দেওয়া পোস্টে তিনি বলেন, “আমি আপনাদের পাঠানো ডোনেশন এক এক করে ফেরত দেব। আমাকে একটু সময় দেবেন।”
এনসিপির আরেক নেত্রী দিলশানা পারুল সিরাজগঞ্জ-৩ আসনে প্রার্থী হতে আর্থিক সহায়তা চেয়ে পোস্টার ছাপিয়ে নিজের ফেসবুক পেজে পোস্ট করেন। পোস্টারে নিজের বিকাশ নম্বর উল্লেখ করে তিনি লেখেন, “সৎ রাজনীতির জন্য আপনার সহায়তা প্রয়োজন। আমার টাকায় আমার এমপি—সেটা হোক ১০ টাকা। কালো টাকা নয়, জনগণের শক্তি চাই।”
ঢাকা-৪ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী মোহাম্মদ মিজানুর রহমানও ফেসবুকে ব্যাংক ও বিকাশ নম্বর দিয়ে লেখেন, “মনোনয়নপত্র জমা এবং অন্যান্য কাজের জন্য আগামীকাল ৬০ হাজার টাকা দরকার। আমাদের হাতে ১০ হাজার টাকা আছে। আরও ৫০ হাজার টাকা লাগবে।”
আইনে যা বলা আছে
গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ, ১৯৭২-এর ৯০চ ধারায় বলা আছে, কোনও নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল ব্যক্তি, কোম্পানি, একাধিক কোম্পানির গ্রুপ বা বেসরকারি সংস্থা থেকে অনুদান গ্রহণ করতে পারবে। তবে ব্যক্তির ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ১০ লাখ টাকা এবং কোম্পানি বা প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ৫০ লাখ টাকা বা সমমূল্যের সম্পদ বা সেবা গ্রহণ করা যাবে।
তবে সব মিলিয়ে কত টাকা সংগ্রহ করা যাবে, সে বিষয়ে আইনে স্পষ্ট কোনও সীমা উল্লেখ নেই। আবার এই গণ তহবিল কীভাবে ব্যয় হবে বা নির্বাচন কমিশন কীভাবে তা তদারকি করবে—সে বিষয়েও নির্দিষ্ট নির্দেশনা নেই। এর মধ্যেই প্রার্থী এই পদ্ধতিতে নির্বাচনি ব্যয় সংগ্রহের পথে হাঁটছেন।
নির্বাচন কমিশন কী বলছে
নির্বাচনি ব্যয় মেটাতে প্রার্থীদের ক্রাউড ফান্ডিংয়ের বিষয়ে জানতে চাইলে নির্বাচন কমিশনার আব্দুর রহমানেল মাছউদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, “প্রার্থীরা ব্যক্তি, কোম্পানি, গ্রুপ অব কোম্পানিজ বা বেসরকারি সংস্থা থেকে ডোনেশন নিতে পারবেন। তবে একজন ব্যক্তির কাছ থেকে ১০ লাখ টাকা এবং একটি কোম্পানির কাছ থেকে ৫০ লাখ টাকার বেশি নেওয়া যাবে না।”
তিনি বলেন, ২০ হাজার টাকার বেশি অনুদান হলে সেটি ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে হতে হবে, যাতে হিসাবযোগ্যতা থাকে।
ক্রাউড ফান্ডিং প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “আমি সরাসরি এতে কোনও অন্যায় দেখি না। আমাদের দেশ গরীব দেশ। আমেরিকায়ও তো এভাবেই নেওয়া হয়।”
তিনি আরও বলেন, “হলফনামায় কোনও তথ্য ভুল দিলে ওই সংসদ সদস্যের প্রার্থিতা পাঁচ বছরের মধ্যে যেকোনও সময় বাতিল করতে পারবে নির্বাচন কমিশন।”
উল্লেখ্য, গত ৩ নভেম্বর আইন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা পরিষদের নীতিগত অনুমোদনের পর গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) সংশোধন করে নতুন অধ্যাদেশ জারি করা হয়। সেখানে বলা হয়, একজন প্রার্থী তার নির্বাচনি এলাকায় ভোটার প্রতি সর্বোচ্চ ১০ টাকা ব্যয় করতে পারবেন। এর বেশি ব্যয় করলে নির্বাচন কমিশন আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে পারবে।